নির্মল বর্মন
প্রাবন্ধিক সুবোধ ঘোষ কথাসাহিত্যিক হয়েও প্রাবন্ধিক হিসেবেও খ্যাতি যশ লাভ করলেও কালের অমোঘ নিয়মে আজ বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিক। সুবোধ ঘোষের বিচিত্র জীবনযাপন ও বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ভরপুর মানুষটি ১৯০৯ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর বিহারের হাজারিবাগ জন্ম। সেন্ট কলম্বাস কলেজের ছাত্র। এমনকি দার্শনিক মহেশ ঘোষের লাইব্রেরীর ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও মিঃ:ঘোষ মাত্র পনেরো বছর বয়স থেকেই আর্থিক অনটনের স্বীকার । ফলতঃ জীবিকার সন্ধানে নেমে নানাবিধ কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন । দৃষ্টান্তস্বরূপ :- 'চায়ের ব্যবসা','ট্যুইশন','বেকারী ব্যবসা', 'মালগুদামের স্টোরকিপার_',ট্রাক ড্রাইভার','ঝাড়ুদার','বাসের কন্ডাক্টর' ও 'সার্কাস পার্টির ক্লাউন' এর চাকরি করেছেন। তাঁর কাছে কোনো কিছুই সাধারণ ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য ছিল না।ভাবতে অবাক লাগে আর্থিক অস্বচ্ছতা থাকা সত্ত্বেও স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে জেলও সময় কাটিয়েছেন। অবশেষে তিরিশের দশকের শেষ পর্যায়ে আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী'র রবিবাসরীয় বিভাগের সহকারী হিসেবে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রাবন্ধিক সুবোধ ঘোষ গান্ধীজির সঙ্গে দাঙ্গাবিধবস্ত নোয়াখালি পরিভ্রমণের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য সঙ্গী ছিলেন । কথাসাহিত্যিক ঘোষ সাহেব ভারত-চীন যুদ্ধের পর প্রভাবশালী পত্রিকার প্রতিবেদকরূপে নেফা পৌঁছে যান। তৎকালীন সময় ও সমাজে সুবোধ ঘোষের লেখা তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল।
🍂
ভারতের কাশ্মীর উপত্যকার দৃশ্যাবলী সম্পর্কেও তাঁর ভাবনা চিন্তার প্রতিবেদন যুথবদ্ধ। ''কালপুরুষ'' ছদ্মনামে বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর পুস্তকাদি রচনা করে আপামর জনসাধারণের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর আদিবাসী জীবন কথ ও যাত্রা সঙ্গে ভারতীয় সামরিক ইতিহাসের খ্যাতিমান গৌরবজ্জ্বল লেখক হিসেবে , সুযশের অধিকারী ছিলেন ছিলেন।১৯৮০সালের ১০ই মার্চ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের পুস্তকাদি:-
''রঙ্গবল্লী'', ''কাগজের নৌকা'', ''ভারতীয় ফৌজের ইতিহাস'', ''ভারতীয় আদিবাসী'', ''কালপুরুষের কথা'', 'বিচিন্তা-সাহিত্য-সংস্কৃতি', ''শিল্পভাবনা'' ইত্যাদি।
সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ "কংগ্রেস সাহিত্য সংঘ" এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। সাহিত্য চর্চার জন্য 'আনন্দ পুরস্কার', 'ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার ', কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'জগত্তারিনী পদক' পেয়েছিলেন।
প্রাবন্ধিক সুবোধ ঘোষের ''শিল্পভাবনা'' (১৯৯৬) পুস্তকের গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ:- ''আলপনা'' বিষয়টি বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় যে তাঁর প্রাবন্ধিক সত্ত্বার অতিসত্বর রূপ বৈশিষ্ট্য প্রকাশ ঘটেছে। বস্তুতঃ 'আলপনা' প্রবন্ধটিতে লেখক লোক সাহিত্য ও শিল্পের ইতিহাস পাশাপাশি তুলে ধরেছেন । ফলত: বর্তমান সময় ও সমাজের জনজীবনেও লোকশিল্প ওতোপ্রোতভাবে বিজড়িত সে দিকটি যুক্তিনিষ্ঠ তত্ত্ব তালাশ সহ বিশ্লেষণ করেছে।
"আলপনা" প্রবন্ধের মূলসুর:-
১. 'আলপনা' শুধু বাংলা ভাষা ভাষীদের লোকশিল্প নয়, ভারত ও ভারতের বাইরে সভ্য-অসভ্য দলমত নির্বিশেষে সকল জাতির মধ্যেই এই শিল্পকলার নিদর্শন যথেষ্টই। উদাহরণ:- "ছোটনাগপুরের ওঁরাও ও মুণ্ডাদের''।
২.''আলপনা''মূলত: চিত্রশিল্প আর এই 'লোকশিল্প' সত্যি আটপৌরে শিল্প'।
৩. 'প্রাচীন চিত্র অক্ষরের ক্রমবিবর্তিত রূপ আলপনা'--এই মত লেখক প্রায়ই মানেন নি, কারণ ''চিত্র আগে, অক্ষর পরে"।
৪.'আলপনা'র চিত্রকল্প টেকনিক মূলতঃ রেখাঙ্কন'র পদ্ধতিতে যুতসই। বস্তুতঃ রেখার ঋজুতার বালাই কোথাও নেই বললেই চলে। প্রত্যেকটি টান যেন "সুবলয়িত-প্রত্যেকটি বর্তুল"।
৫. বাংলার ব্রতকথা পার্বণের সঙ্গে "আলপনা"র চিত্রকল্প ওতোপ্রোতভাবে অবিচ্ছিন্ন।
৬.' আলপনা' চিত্রের থিম ''টেকনিকে বৃত্তের স্থান খুব বেশী''। ' আলপনা শিল্পের শিল্পীরা প্রায়ই সর্বত্রই নারী ঐতিহ্য'। 'এক সময় মেয়েদের ব্রতনিষ্ঠার সঙ্গে আলপনানিষ্ঠা' পাশাপাশি ছিল, কাজলরেখার এ কাহিনীতে তার বর্ণনায় এসেছে ।'
৭. 'আলপনা" হল গুরুত্ব-একটি ব্যবহারিক শিল্পকলা। এই শিল্পরীতি 'শাড়ি', 'শাল', 'শালোয়ার', 'কার্পেটে' ও গৃহ
সজ্জায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 'আলপানায় সামাজিকভাবে মানুষ্য জাতির উৎকর্ষ প্রতিফলিত।'
৮. ' আলপনা ' শিল্পরীতি আজও মাথা উঁচু করে বেঁচে আছে অথচ অন্যান্য বহু শিল্প আজ দেখা মিলে না। এই প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক সুবোধ ঘোষের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য:---
“আলপনা চিত্রশিল্প আজ ও বেঁচে আছে। এর এই প্রাণবত্তার মূলে হল তার লোকময়তা। একটা বিশ্ববিদ্যালয় যা করতে পারে না, আলপনা প্রথা তাই করেছে। শিল্পকে সমাজের রক্তমাংসের ভিতর এমনভাবে আত্মস্থ করে নেবার উদাহরণ খুব কমই পাওয়া যায়।"
প্রাবন্ধিক সুবোধ ঘোষের ইতিহাসচেতনা, শিল্পভাবনা, যুক্তিনিষ্ঠা মনন,অত্যন্ত সহজ সাবলীল ভাষায় প্রতিফলিত হলেও দেশ ও দশের মূল্যবান বিচারে বিস্মৃতপ্রায় সাহিত্যিকের দোরগোড়ায় সামিল।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments