জ্বলদর্চি

বার্লিনের ডায়েরি --২০ তম পর্ব চিত্রা ভট্টাচার্য্য

বার্লিন টিয়ার পার্ক গেট

বার্লিনের ডায়েরি 
২০ তম পর্ব  
চিত্রা ভট্টাচার্য্য                              

সুদূরের পিয়াসী মন শূন্যে ওড়া পাখির মত তার শক্ত দুটি ডানা মেলে বাস্তবের জগৎ ছেড়ে দূর থেকে দূরান্তরে ক্লান্তি হীন উড়ে চলেছে। শ্রীময়ী শীতের দুপুরের আবছা রোদে পিঠ দিয়ে ভেজা চুল এলিয়ে সবকাজ ফেলে  তার নিজের বাড়ির ছোট্ট ছাদে পুরোনো ডায়েরিটি হাতে  নিমগ্ন  ।  পাতা উল্টে November 18th /2015 তে ...এসে থমকে দাঁড়িয়েছে সেদিনের কথা মনে পড়ছে । ওরা বার্লিনের টিয়ার গারটেন  পার্কে মানে চিড়িয়াখানায় বেড়াতে গিয়েছিল। সে ও প্রায় নয় বছর আগে, বাজেয়াপ্ত  ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়ে যাওয়া পেট মোটা ডায়েরির পাতায়  ঘটনার ঘনঘটায় মেঘাচ্ছন্ন দুপুরে কালো কালিতে লেখা গুলো মায়াবী উষ্ণতা বয়ে নিয়ে এলো। সে সময়ে বেড়ানোর তুচ্ছাতিতুচ্ছ মুহূর্তর স্বপ্নে বোনা সেই দিন গুলোর স্মৃতি, ওকে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরেছে। স্মৃতি রোমন্থনে ছেঁড়া ডায়েরির ক্ষয়ে যাওয়া পাতা গুলো যে এমন বন্ধুর মত পাশে এসে দাঁড়াবে , তা ও কখনো ভাবে নি। তার  থেকে একটি একটি করে ফুল কুড়িয়ে নিয়ে শ্ৰীময়ীর এ মালা গাঁথা।   ''বার্লিনের ডায়েরি '' ওর ভ্রমণ কাহিনীর  প্রতিটা পাতা সাজিয়ে তোলা।   
ট্যানাগার একাকী

ড্রেসড্রেন থেকে ফেরার পর অদ্রিজা বিভিন্ন কাজের চাপে দুই সপ্তাহ ধরে ল্যাব ও কনফারেন্স ব্যস্ত থাকায় বেশ কিছুদিন  ওরা কোথাও বেড়াতে যায় নি । মাঝে এক বুধবার এলো খুব ঝরঝরে রোদের পরশ মেখে ।  ঘড়িতে তখন সাড়ে সাত টার সকাল। ঘুম ভাঙতেই ঘরের সংলগ্ন বারান্দাতে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়িয়ে শিশু সূর্যের শান্ত উজ্জ্বল সোনালী আলোর আভাস দেখতে পেয়ে শ্রীর মন ভরে উঠেছিল। এ বাড়ির কাঁচের জানলা , ঐ এক টুকরো ব্যালকনি যেন ওদের আবহাওয়া দপ্তর। ওয়েদার রিপোর্টের যাবতীয়  খবর সকাল বেলা এখানে এসে দাঁড়িয়ে ওরা পরখ করে।  বৃষ্টি পড়ছে কিনা ? রোদ উঠবে কি ?হাওয়ার গতি বা  শীতের তীব্রতা কত ?--কুয়াশা ঢাকা থাকবে ? না তুষার পাতের সম্ভাবনা আছে ? সেদিন  মেঘের কালো ওড়নার আড়াল থেকে আলোর রশ্মি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ে চারদিক উজ্জ্বল হয়ে ছিল ।  
দল ছুট উট

            চিড়িয়াখানায় বেড়াতে  যেতে শ্রী ,ঋষভের এতখানি  বয়সে ও অঢেল উৎসাহ।ওরা ছোটবেলার খুশিতে ফিরে গিয়েছে ।   মাঝে কতদিন অবহেলায় চলে গিয়েছে , জীবন পথে নতুন গল্প রা ভীড় করে পুরোনো স্মৃতি কে বিবর্ন করে দিতে চাইলেও শ্রী কলম হাতে নিয়ে দেখে কিছুই হারায় নি, যে যার নিজের জায়গায় নির্বাক ছায়া ছবির মত,কোথাও  চলমান কোথাও বা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বরং ছেঁড়া পাতা গুলোর সাহায্যে কল্পনার মাধুরী মিশিয়ে জীবনের কাব্যে এক অপরূপ গল্প হয়ে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে।                                                                                                                        অদ্রিজা ল্যাবে বেশ সকালেই বেড়িয়ে যাবার আগে বলে প্রতিদিনই প্রায় সকাল দশ টা থেকে সন্ধ্যে ছটা পর্যন্ত দর্শনার্থীর ভীড়ের জন্য টিয়ার গারটেন পার্ক  খোলা থাকে। রাস্তা ভুল করে পথ হারিয়ে ফেলার কোনো সম্ভাবনা নেই ,  এই  এপার্টমেন্ট থেকে খুব বেশী দূরে নয় মাত্র পাঁচটা স্টপেজ।  টিয়ার গারটেন পার্কই বাসের শেষ গন্তব্য স্থান ,শুধু চিড়িয়াখানার গেটে পৌঁছে টিকিট কেটে নিলে সারাদিন মনের মত সময় খেয়াল খুশি মত কাটবে। তোমরা বাড়িতে সময় না কাটিয়ে সেখানে অবশ্যই বেড়াতে যাবে।    

🍂

  ছোটবেলার আলিপুর চিড়িয়াখানা বেড়াতে যাবার আনন্দে ভরা স্মৃতি আজও মনে পড়লে  এক স্বর্গীয় সুখ শ্রী কে  জড়িয়ে ধরে। ছেলেবেলায় বাবা মার হাত ধরে প্রায় প্রতিবছরই বড় দিনের ছুটিতে ২৫শে ডিসেম্বরে ভাইবোনেরা একসাথে  চিড়িয়াখানায় বেড়াতে যাওয়া হতো এবং ঐ  দিন গুলোতে বাড়িতে যেন উৎসব শুরু হয়ে যেত ।শক্ত সূতোয় মালায় গাঁথা সেই নানা রঙের দিন গুলো। রঙিন সোয়েটার ,পালক লাগানো নানান রঙের টুপি। চকলেট কমলা লেবু কেক লুচি আলুরদম ,জয়নগরের মোয়ার সাথে নলেন গুড়ের সন্দেশ ..একরাশ খুশি আর ভাই বোনের খুনসুটি ।আজ এতো দিন পরে ও গালফোলা ,ঝুঁটি বাঁধা চুলে  ,কাজল ধ্যাবড়ানো চোখের ছোটবেলা একান্তে উঁকি দিয়ে যায় । সাজানো বনভূমি

তারপরে কালের পরিক্রমায় নিজের বাচ্চাদের,নিয়ে রঙিন টুপি , রঙ বেরঙের সোয়েটারে,কমলা লেবু চকলেট কেক মিষ্টি র সাথে  লাঞ্চ বক্স ,পুরোনো খবরের কাগজ শতরঞ্চির সাথে শীতের দুপুরে চিড়িয়াখানা। সেই স্মৃতির অজানা বাতাস দূর থেকে ঢেউ তোলে। উত্তেজনার ঝড় বইছে শ্রীময়ীর মনে ,এ  কলকাতার বা ভারতবর্ষের কোনো চিড়িয়া খানা নয়, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বার্লিনের চিড়িয়াখানা।   

 ঋষভ ব্রেকফাষ্টের টেবিলে বসে। খাবার সাজিয়ে দিয়ে শ্রী বলে শুনেছি  ,পৃথিবী বিখ্যাত দশ টি চিড়িয়াখানার মধ্যে বার্লিনের টিয়ার গারটেন পার্কের এই চিড়িয়াখানা টি অন্যতম প্রসিদ্ধ।  জানতো ! এই পশু শালাটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৮৪৪ সালে,প্রোসিয়ার রাজা উইলিয়াম চতুর্থর ব্যক্তিগত উদ্যোগে। ঋষভ শ্রীময়ীর  মুখের কথাটি কেড়ে নিয়ে বলে , রাজার নেশা বা হবি ছিল পশু পাখিদের পোষা,যত্নকরা , প্রতিপালন , সংগ্রহ এবং সংরক্ষন করা। তাদের ভালোবেসেই এই পশুরালয় টি গড়ে তুলে নাম রাখলেন টিয়ার গারটেন।জার্মান ভাষায় জন্তু জানোয়ার কে টিয়ার বলে তাই এখানে চিড়িয়াখানা মানে টিয়ার গারটেন পার্ক। শ্রী  বলে  সেদিন গাইড বুকেও দেখেছিলাম , প্রায় ৩৫হেক্টর জমি নিয়ে বিশাল এক ভূখণ্ডে বার্লিন শহরের বুকে পৃথিবীর এই ঐতিহ্যময় চিড়িয়াখানাটি গড়ে উঠেছিল। শহরের মাঝে কৃত্রিম বন জঙ্গল দিয়ে মানুষ নির্মিত পশু উদ্যানটির সুদূর প্রসারিত সীমানা জুড়ে অবস্থান ভারী দৃষ্টি নন্দন এবং অবশ্যই শহরবাসীর কাছে ও বিশেষ গৌরবের। যদিও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় এখানের বেশীর ভাগ জীব জন্তু বোমার আঘাতে আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে  গিয়েছিলো। তবে এখনো তাদেরই বংশধর দের রাজত্ব চলছে , এবং  প্রচুর সজীব পশু পাখি প্রতিটি প্রান্ত আলো করে সদর্পে বিরাজমান পশুরালয়ে ।  উন্নত শিরে তারা স্বগর্বে  নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। 

  লাঞ্চ বক্স জলের ফ্লাক্স ক্যামেরা সানগ্লাস ইত্যাদি প্রয়োজনীয় দ্রব্য গুলো ব্যাগে গুছিয়ে অদ্রিজার  নির্দেশ মত বাসরুট ফলো করে ঠিক সকাল দশটা নাগাদ বেরিয়ে মিনিট কুড়ি বাদে সোজা টিয়া র গারটে ন পার্কের গেট। পশু পাখি প্রাণী জগৎ সম্পর্কে ঋষভের উৎসাহ আগ্রহ জ্ঞান অনেক বেশী। ওর টিভির Discovary channel এ animal planet সম্পূর্ণ কণ্ঠস্থই বলা যায়। বলে ,জাগতিক জগতের সর্বময় স্রষ্টা ঈশ্বরের এক অনুপম সৃষ্টির  বিচিত্র কারখানা এই প্রাণী জগৎ।বিশাল বিশ্বপ্রকৃতির এক অপরিহার্য্য অঙ্গ । তাদের বেশীর ভাগ অংশকে একেবারে একসাথে চোখের সামনে দেখা যাবে। অবলা পশুপাখি দের দেখে তাদের মাঝে সময় কাটানো , অবসর যাপন ,এক হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির সুখ কর অনুভূতি। ধীরে ধীরে  চিড়িয়াখানার প্রবেশের পথ ধরে পশু উদ্যানের মধ্য দিয়েই সুন্দর বাঁধানো রাস্তায় ওরা এগিয়ে চলেছে ।

দর্শনার্থী দের জন্য পথ নির্দেশিকার ম্যাপ রয়েছে পাথরে বাঁধানো পায়ে চলার নিরিবিলি পথ টি চলে গেছে পার্কের অভ্যন্তরের বিভিন্ন পশুর আস্থানার কেন্দ্রে।পরিষ্কার গাছে গাছে সাজানো বন তলের পথ টি পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আনমনা আলো এসে পড়েছিল গায়ের ওপর। গাছে গাছে সাজানো বন তলের পথ টি ইউক্যালিপটাসের সুগন্ধ মাতানো । শুকনো ঝরাপাতা পায়ে মাড়িয়ে মর্মর ধ্বনি তুলে ওরা এগিয়ে চলেছিল। পাখির কল কাকলিতে মুখরিত বন । সারা চিড়িয়া খানার স্থান টি জুড়ে অসংখ্য রকমের গাছের সারি। ''বন্যেরা বনে সুন্দর'' এর মাঝে যেন  নিশ্চিন্তে আরামে থাকতে পারে সেজন্য সবুজ গাছগাছালি তে ভরা কৃত্রিম উপায়ে  নিখুঁত এক গহন বনভূমি  গড়ে তোলা হয়েছে সারা পার্কটি জুড়ে । তেমনি পাহাড়, হ্রদ ঝর্ণা ছোট বড় টলটলে জলাশয় ব্রিজ। কাঠের ট্রেইল কৃত্রিম পাহাড় গুহা কি নেই ?   

 চলার পথে খানিক টা এগিয়ে নজরে এসেছিলো পার্কের সীমানার ধার ঘেঁষে গুচ্ছ গুচ্ছ ছয়-সাত ফুট উঁচু সাদা কাশের ঝার। লম্বা লাইন ধরে ঘন কাশের ঝোপ  ঢেউ তুলে মাথা দুলিয়ে চলেছে ।  উম্মুক্ত  নীল আকাশ জুড়ে  সাদা মেঘেদের ভেলা ভাসছে। মাটির পৃথিবীতে কাশের গুচ্ছ সঙ্ঘ বদ্ধ নাচের ভঙ্গিমায় মাথা দুলিয়ে চলেছে।যেন  এখানে ও বয়ে নিয়ে এলো শরৎ ঋতুতে স্বদেশের পূজার গন্ধময় আগমনীর বার্তা । শ্রী ঋষভ বিস্ময়ে অভিভূত , কাশ ফুল যে একেবারে বাংলার নিজস্ব সম্পদ , অসময়ে তাকে এই সাত সাগরের পারের পশু উদ্যানে এমন শীতল তম পরিবেশে আলো করে ফুটে থাকতে দেখবে  তা  ওরা একটু ও আশা করে নি।  

 আকাশের দিকে মুখ  তুলে চেয়ে থাকা ওক, ফ্রেঞ্চাই গাছের ডালে হলদে ওরিয়েলোর পাখা নাচানোর সাথে সাথে টিটি পাখির সুরেলা ডাকে মন মুগ্ধ হয়ে বেশ কিছুটা পথ আনমনে ঋষভ  এগিয়ে গিয়েছিল। মাথার ওপর বাহারি পাখা ঝাপ্টিয়ে বিচিত্র সুরে শিস দিয়ে দুই স্কারলেট দম্পতি গাছের ডাল বদলালে ও ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখে  আকাশে স্পর্শী  গাছ গুলোর ওপর সরু নাইলন  সূতোর জাল বিছানো ,পাখিরা যত খুশি উড়তে পারবে কিন্তু পালাতে পারবে না। শ্রী বলে ,জানিনা জার্মান ভাষায় আমাদের দেশের এই ওরিয়েল, ফিঙে ,মাছরাঙা, কাঠঠোকড়া,  টিটি ,টিয়া ময়না দের কি নাম। সংগ্রহশালায়  নিজের দেশের  পরিচিত পাখি গুলো দেখে ওরা  চমৎকৃত হয়ে গিয়েছিল । খাঁচার গায়ে গাছের কোটরে পাখিদের সাদা কালোয় ট্যাগ করা  নাম  গুলো শ্রীময়ীর আজ আর স্মরণে আসে না। 
বনের পথে

পার্কের সীমানার উত্তর  দিকে অনেকটা এগিয়ে দেখে  কালচে খয়েরীতে মেশানো বিশাল এক প্রস্তর খন্ডের মত  এক একশৃঙ্গ গন্ডার সকালের ভোজন পর্ব সেরে  আপন মনের খেয়ালে খোশ মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে হয়তো ওর বিশালাকার চেহারার  ওজন হবে দুই ,বা তিন টন। আর ও একটু এগিয়ে নিজের দেশের খুব পরিচিত বাবলা কাঁটার জঙ্গলে বিরাজ মান উটের দল মনের সুখে কাঁটা চিবোচ্ছে।  চার পাঁচটি উট দল বেঁধে কাঁটা গাছ গুলোর পাশেই ঘোরে ,তাদের সঙ্গে সদ্য জন্মানো  নবাগত বাচ্চা উট টি মুখ তুলে উর্দ্ধ পানে গাছের দিকে চেয়ে আছে। সে তো এখনো কাঁটা গাছের নাগাল পায়না।  ঋষভ বলে বাবলা কাঁটার গাছ উটেদের খুবই পছন্দের প্রিয়খাদ্য বলে এই পার্কে কাঁটা গাছ লাগিয়ে কৃত্রিম কাঁটা বন তৈরী হয়েছে।আর দেখ কী সুন্দর মা উট টি বাবলা কাঁটার কচি ডাল ভেঙে ওর মুখের কাছে এগিয়ে দিচ্ছে। শ্রীহেসে বলে  বলে পৃথিবীতে সব মায়েদের যে একই ধর্ম।         ক্রমশঃ

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments