জ্বলদর্চি

স্নায়ুজ আগুন নিয়ে লিখেছেন রাকিবুল হাসান বিশ্বাস

স্নায়ুজ আগুন নিয়ে লিখেছেন রাকিবুল হাসান বিশ্বাস

গ্রন্থ: স্নায়ুজ আগুন
কবি- সালেহা খাতুন
প্রকাশনা: কবিতিকা
প্রচ্ছদ অলংকরণ: কমলেশ নন্দ
উৎসর্গ: টুকু ও ওবাই
গ্রন্থস্বত্ব: পিয়াসা পারভিন
মূল্য: ১৫০ টাকা
ISBN: ৯৭৮৮১১৯৫৬৪১৪৯ 


গীতিকবিতা— মন্ময় কবিতা— লেখকের মন পড়ার কবিতা, লেখকের মন বোঝার কবিতা। লেখকের হৃদয়টুকুই সেখানে সর্বস্ব। কাহিনি-ছন্দ-লয়-অলংকারের চেয়ে লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ভাব-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি, ব্যক্তিক ব্যথা-বেদনা, আনন্দ ও সুখের কথাই সেখানে মুখ্য। জীবনকে দেখার— উপলব্ধি করার বিষয়টিই কেবল সেখানে প্লট হিসেবে বিবেচিত হয়। কবি সালেহা খাতুনের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'স্নায়ুজ আগুন'-ও তদ্রুপ একখানি আধুনিক মন্ময় কাব্যগ্রন্থ। 

গ্রন্থটির অন্তর্গত সকল কবিতা পাঠ করলে দেখা যাবে, সেখানে যেমন রয়েছে ফেলে আসা দিনগুলির জন্য কবির প্রবল আকুতি— রয়েছে ছোটবেলাকার শিশির ভেজা খেসারির ক্ষেত, তেমনি রয়েছে ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া কন্ঠ্যধ্বনি— "কাফনও কি হবে এমন প্রশস্ত?" রয়েছে কর্মময় জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে আশ্রয় খোঁজার ব্যাকুল চেষ্টা— 
"চারিদিকে যখন খরবায়ু
উদ্দাম বেগে বয়ে চলে
মলিন ধুলার মতো উড়ে চলি আমি
তখনও রবীন্দ্রনাথেই আশ্রয় খুঁজি।" 

পঁচাত্তরটি কবিতায় মোড়া 'স্নায়ুজ আগুনে'র প্রথম কবিতা 'মন্তাজ'। কবিতাটি অতীত এবং বর্তমানকে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। সেই জবা গাছ, পেয়ারা গাছ, বাড়ির পাশের ড্রেন— যেখানে উড়ন্ত ঘুড়ি ছিঁড়ে পড়েছিল, সে সব আজ আর নেই। ব্যাডমিন্টনের কর্ক, ঝাউ গাছ, কামিনী ফুলের চারা, তেজপাতা গাছ— এসবই কবি ফেলে এসেছেন। অতীতচারণায় কেবল হারিয়ে যাওয়া প্রকৃতি উঠে আসেনি, 'ওরা' কবিতায় উঠে এসেছে রাজিয়া, রহিমা, তাসিরা, ফরিদা, জোহরার কথা, যাদের হয়তো শৈশবে কবি সবসময় পাশে পেয়েছেন। এমনি করেই কবি যে কখন উনপঞ্চাশে পা দিলেন, তা ঠিকমতো টেরই পেলেন না; আবার সহসা 'পঞ্চাশে পা'— 
"কালো দরজায় যতোই কড়া নাড়ো
ভিতর দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছি আমি
নিজেই নিজের পাই না দিশা
সহসা এলে তুমি! সাবাস পঞ্চাশ সাবাস।" 

স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে 'লালপাখি'টির কথা, যে পাখিটি "সোনার প্রিয় দাদুভাই" এনেছিলেন মক্কা থেকে। কিন্তু আজ সেই পাখিও নেই, দাদুও নেই, নেই ছোট্ট সোনা কিংবা তার হাসিমুখখানি। সে সোনা আজ বড় ব্যস্ত। তার জগৎ চলেছে আপন ছন্দে সুচারু হয়ে, সুবিন্যস্ত হয়ে। 

কবির মনে পড়ে যায় ছাত্রজীবনের দিনগুলির কথা। সেই দিনগুলি হয়তো চাপা পড়ে গেছে আজকের মেদিনীপুর আর বীরশিবপুরের কর্মময় জীবনের ব্যস্ততায়। কিন্তু তিনি আজও সেইসব হারিয়ে যাওয়া পাতা খুঁজে খুঁজে ধুলো ঝেড়ে হৃদয়ের তাকে সাজিয়ে রাখতে চান। 'আরশিনগর' কবিতার প্রতিটি পংক্তিতে তারই আকুতি ধ্বনি ভেসে আসে। সেই বরানগর, রবীন্দ্রসদন, হাওড়া স্টেশন, একান্ত দুপুরের সেই গয়নার বাক্স, মায়ের টুল আর অ্যান্টিক পালঙ্ক আজও তাঁর মনে হানা দেয়। 'অতল' কবিতায় উঠে এসেছে সেদিনের শহীদ মিনারের পাশে সরু চাঁদের ফালি, সেন্টেনারি বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি, রাস্তার ধারের আঙুর বিক্রেতা, নন্দন চত্বরের আইসক্রিমওয়ালা, বোটানিক্যাল গার্ডেনের সেই ছোট্ট ছেলেটা, কলেজস্ট্রিটের সেই বাস ড্রাইভার, সাঁকরাইলের ওভারব্রিজ ইত্যাদি আরও কত কী। কবি আক্ষেপের সুরে বলেছেন, 
"আদ্ধেক জীবন গেল কেটে নদীর ধারে ধারে ... 
তবুও তল খুঁজে পেলাম না বন্ধু,
আটকে আছি ইছামতীর এপার ওপারে।" 

রবীন্দ্রসদনের কথা 'স্থানান্তর' কবিতাতেও রয়েছে। কবিতাটি পড়লেই বোঝা যাবে যে, রবীন্দ্রসদন, শ্যামনগর, বাগনান, যাদবপুর ইত্যাদি জায়গাগুলি কবির হৃদয়ের কত গভীরে আজও সজাগ হয়ে রয়েছে। বাগনানে কবির জন্ম। তিনি বলেছেন, "বার বার হাতছানি দিল বাগনান
জন্মদাগ লুকিয়ে আছে সেখানে।
তেঁতুলতলার কথায় মনে পড়ল
দাদু শুয়ে আছেন ওখানে।" 

কবির স্মৃতিকে জাগিয়ে তুলেছে তাঁর আত্মীয়েরা। এসেছে মায়ের কথা, বোনের কথা, দিদিমার কথা— সব থেকে বেশি বাবার কথা। বাবাকে ঘিরে তাঁর যে কয়টি কবিতা এ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, সেগুলিকে একত্রিত করলে একটি কাহিনি দাঁড় করানো যায়। যেমন 'বিষামৃত নভেম্বর' কবিতায় দেখা যাচ্ছে, নভেম্বরের তিরিশ তারিখ কবি তাঁর প্রিয় বাবাকে হারাচ্ছেন। কবি আরেক নভেম্বরে যাপন করছেন সেই দিনটিকে। 'দৃশ্য' কবিতায় কবি বেদনাতুর সেই দিনটিতে আরও একবার চোখ বুলোচ্ছেন। 'মিলনগীতি' কবিতায় কবি তাঁর বাবাকে ফিরে পেয়েছেন স্বপ্নে—
"কাল রাতে তুমি এসেছিলে স্বপ্নে 
হাসিমুখে শুয়েছিলে পাশ ফিরে 
তোমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছি আমি।" 

আবার 'ঠিক তাহারই মতো' কবিতায় কবি নিজের স্বামীতেই বাবার প্রতিচ্ছায়া অনুভব করছেন— "কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর তোমাকে কেমন বাবার মতো লাগছে।" কবি বুঝিয়েছেন বাবা তাঁর জীবনের ঠিক কতখানি ছিল। তিনি তাঁর জীবনে বাবাকে দেখেছেন গোলকিপারের ভূমিকায়, কখনও উইকেট কিপার কিংবা জাহাজের ক্যাপ্টেন। বলেছেন—
"হিট উইকেট হওয়া বা হাল ভেঙে দিশাহীন হওয়ার 
হাত থেকে বাঁচাতে অতন্দ্র প্রহরীর মতো বাবা 
আগলে রাখত আমাদের।" 

স্মৃতিকথায় উঠে এসেছে সহোদরা টুকুর কথা— এক ঘরে, এক বিছানায়, এক রঙের পোশাকে খুনশুটি-মারামারির কথা, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়া ইত্যাদি। কবি টুকুকে নিয়ে হাজার কবিতা লিখতে চান। তিনি টুকুকে আহ্বান করেছেন ডিসেম্বরের শীতে ওম দেওয়ার জন্য। কবি জানেন টুকু স্বাধীন নেই; নিজেও পরাধীন। তবুও পুরোনো দিনের মতোই ডিসেম্বরের শীতে কবি টুকুকে পাশে পেতে চান। 

🍂

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপক তথা ইসলামী চিন্তাবিদ ও লেখক ড. ওসমান গণী মহাশয়কে স্মরণ করে কবি লিখেছেন 'ওসমান গণী স্মরণে' কবিতাখানি। একজন শিক্ষার্থীর নিকট এমন একজন লেখক ও চিন্তাবিদের গুরুত্ব যে কতখানি সেটা এই কবিতাটি পড়লেই বোঝা যাবে। কোরআন শরীফের বঙ্গানুবাদ, ব্যাখ্যা-সহ কোরআন-হাদিস সম্পর্কিত তাঁর বিভিন্ন লেখা ইসলামী ধর্ম ও সমাজকে যে পরিমাণ সমৃদ্ধ করেছিল, ভাষাবিদ ড. সুকুমার সেনের এই উক্তিতেই তা বোঝা যায়— "ওসমান গণীর অসাধারণ লেখনী বিষয়বস্তুর যুক্তিতে ও চিন্তার যুক্তিতে এবং আপন মৌলিকত্বে ইসলামকে স্থান-কাল-পাত্রভেদে সংকীর্ণতার সীমান্ত পার করিয়ে গণ্ডিত্তীর্ণ করিতে সক্ষম হইয়াছে।" তাই তো কবি তাঁর কবিতায় বলেছেন—
"হে জ্ঞানী ভাষার বাধা দূর করে 
আমাদের চেনালেন কোরআনের বাণী 
তা নইলে আবৃত্তিতেই দিন কাটতো 
বোধের বাইরেই থেকে যেতো আল্লাহর বাণী।" 

যন্ত্রসভ্যতার বিস্ময়কর বিকাশ কেবল আমাদের দৈনন্দিন জীবনেই প্রভাব ফেলেনি, মানুষের মনোজগতেরও ব্যাপক রদবদল ঘটিয়েছে। একটা সময় ছিল যখন প্রেম-ভালবাসায় স্নাত হওয়া ছিল মানুষের সহজাত সত্য; কিন্তু সেসব আজ অতীত। এখন সত্য কেবল গ্লানি, যন্ত্রণা আর অবিশ্বাস। কবির বেশ কিছু কবিতা সেই গ্লানি-যন্ত্রণা-হতাশাব্যঞ্জক। 'আত্মনিয়ন্ত্রণে' কবি বলেছেন—
"মাঝে মাঝে যখন নিজেকে শবদেহ মনে হয়
নিথর নিঃষ্পন্দ নিস্তব্ধ নির্বাক থাকি। 
কখনো জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাই রাগে" 

কিংবা 'উইমেন অব পশ্চিমবঙ্গ'তে কবির হাহাকার ধ্বনি উঠে আসে—
"মাঝে মাঝে মন ছেড়ে মাথার মধ্যে 
অনুভবগুলো জমাট বেঁধে যায়, 
হাহাকার করতে থাকি কয়েকটা শব্দের জন্য ..." 

আবার আধুনিক মন ও মননের বিপন্নতা, সময়ের অসুস্থতাকেই শেষ সত্য বলে স্বীকার করতে চাইছেন না কবি। তাই কখনও কখনও তিনি প্রবল প্রতিবাদী হয়ে উঠছেন— স্নায়ুজ আগুনকে প্রজ্জ্বলিত রাখার চেষ্টা করছেন। 'বর্ণপরিচয়ে' বলছেন— "ভালোমানুষী ছেড়ে/ কেবল একবার ঘটাতে চাই ভয়ংকরের বর্ণপরিচয়।" তিনি জানেন আজকের এই ধস্ত বাস্তবতা স্নায়ুর এই আগুনকে প্রশমিত করার চেষ্টা করবে চারপাশ থেকে— মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে-খুঁড়ে নির্বাক বানাবে; ক্রীতদাস বানাবে। তখন আর স্নায়ুজ আগুন জ্বলবে না। তাই তো কবি 'আত্মজীবনী' কবিতায় বলছেন—
"যেথায় আছে যত রক্তচক্ষু হেলায় উপেক্ষা করি 
অজুহাত অভিযোগ সব কিছু সরিয়ে রেখে 
কী পেয়েছি কী পাইনি হিসেব কষি না আর 
আত্মজীবনীর কড়চাতে শব্দের মালা গেঁথে 
রেখে যাবো আমার অতীত ইতিহাস।" 

ফেলে আসা জীবনে স্নিগ্ধ মনোরম দিনগুলির পাশাপাশি 'স্নায়ুজ আগুনে'র অনেক কবিতায় কবির অন্তরের আগুনকে প্রজ্জ্বলিত হতে দেখি— কখনও কর্মজীবনকে ঘিরে, কখনও ধর্মের ধ্বজাধারীদের বিরুদ্ধে, কখনও আধুনিক যুগে এসে সমাজের প্রাগৈতিহাসিক চিন্তাধারার বিরুদ্ধে। 'দেখাশোনা', 'কাজ', 'নিখুঁত', 'কোলাজ', 'অনুরোধ', 'পর্দা', 'পর্দার রাজনীতি', 'পর্দানশীন', 'দশভুজা' প্রভৃতি কবিতা তারই সাক্ষ্য বহন করে। 'স্নায়ুজ আগুন' গ্রন্থটির হাত ধরে কবির এই অন্তরের প্রজ্বলিত আগুনে তপ্ত হওয়ার; সেই সঙ্গে নিজের মতো করে দগ্ধ হওয়ার সুযোগ পান পাঠক-সাধারণ। এখানেই তাদের মুক্তি— কবিরও, কবিতারও। এমন শাশ্বত মানবতার দহনে দগ্ধ করে কবি তাই আপোষহীন ভাবেই বলতে চান—
"স্নায়ুতে আরোগ্য আসুক 
মৌমাছি নাচুক ঘুরে ফিরে 
পৃথিবী ভরুক ফুলে ফলে।
শোষণের কাল যাক বহুদূরে 
কাঙ্ক্ষিত সাম্য আসুক ঘরে ঘরে।"

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments