জ্বলদর্চি

শেক্সপিয়র চাঁদ ও শ্যুমেকার : এক অব্যক্ত প্রেম কাহিনী /পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা

বিজ্ঞানের অন্তরালে বিজ্ঞানী — ৯৬
শেক্সপিয়র চাঁদ ও শ্যুমেকার : এক অব্যক্ত প্রেম কাহিনী 

ইউজিন মার্লে শ্যুমেকার ও ক্যারোলিন এস শ্যুমেকার

পূর্ণচন্দ্র ভূঞ্যা 

( ১)
এই রাত শুধু দুজনের...

"এক পৃথিবী ভালোবাসি তোমায়, হে প্রিয়তমা। এক পৃথিবী ভালোবাসব বলে বাসা (পড়ুন পৃথিবী) ছেড়েছি আমি। এসেছি তোমার কাছে। বেঁধেছি প্রেমের ঘর। তোমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে থাকি আমি – অর্ধনারীশ্বর।

জন্মজন্মান্তের ভালোবাসার অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ হই দুজনে। জীবনে মরণও আলাদা করতে পারবে না কোনোদিনও। এ প্রেম শাশ্বত। এ ভালোবাসা অবিনশ্বর। এ টান চিরদিনের। তোমার অশরীরী ভালোবাসার লোহিততপ্ত আগুনে পুড়ে শুদ্ধ হয়েছি আমি। ঋদ্ধ হয়েছি বারংবার।

তোমার প্রাণশূন্য শরীরের অন্তর্নিহিত উপাদানের মধ্যে আমার সনাতন বাসস্থান স্বর্গের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। এই অভিসার বেলায় তোমার প্রতি আমার অনুরাগ আলোকবর্ষ দূরের নিহারিকার সংকেত মনে হয়। তারায় তারায় যে-তথ্য বিনিময় চলে গোপনে, নিঃশব্দে; আমাদের অপার্থিব প্রেম হবে আগামীর অনুপ্রেরণা। বিশুদ্ধতার উদাহরণ।

তুমি কথা বলবে না, জানি। সাড়া দেবে না আমার প্রশ্নের। শুধু তাকিয়ে থাকবে নির্বাক। হয়তো মুখে তোমার লেগে আছে অমলিন হাসি। সে-হাসিতে মুক্তো ঝরে ধুলোয়, সমাধিপ্রস্তরে। অবিরত। তবুও দৃপ্ত কণ্ঠে আমি ঘোষণা করি — আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভালোবাসব চিরদিন। এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার। অঙ্গীকার পৃথ্বীবাসী সমস্ত মানুষের হয়ে।

এসো হে প্রিয়ে। আলিঙ্গন করি। জড়িয়ে ধরে থাকি আরও কিছুক্ষণ। আরও কিছু সময়। প্রাণ জুড়ানো মুক্তির শ্বাস শরীরে শরীরে।

কলঙ্ক! সে যে তোমার অলংকার। গর্ব। তোমাকে ভালোবেসে কলঙ্কিত হই আমিও — এ আমার অহংকার।"
   কলঙ্কিত চাঁদ এবং ইউজিন শ্যুমেকার-এর অশরীরী প্রেম

এ এক পরা-বাস্তব প্রেমের পাললিক গল্পগাথা। আংশিক কাল্পনিক; কিন্তু চির সত্য। বাস্তবের ধার ঘেঁষে গোপন মনে যার সশব্দ অবস্থান।

ঘুটঘুটে অন্ধকার। সম্মুখে ঝলমল করছে নীল সবুজ পৃথিবী। আলোকবর্ষ দূরে আকাশ ভর্তি গ্রহ তারা নিহারিকার মেলা। পৃথিবী ফেরত ক্ষীণ আলোর মৃদু ছটায় চাঁদের বুকে গাঢ় রাত্রির মায়াবী পরিবেশ। সেই রোমান্টিক আলো-আঁধারের ভিতর গভীর এক খাদের কিনারে বসে কাল্পনিক গল্পে মত্ত প্রেমিক ইউজিন শ্যুমেকার। উঠোনে তার প্রেয়সী রূপবতী কোজাগরী চাঁদ। কালপুরুষ স্বাক্ষী রেখে এ এক অশরীরী প্রেম। অপার্থিব ভালোবাসার অকৃত্রিম দৃষ্টান্ত। এ এক চিরন্তন প্রেমের অমোঘ আকর্ষণ, যার অনুভূতি কোষ থেকে কোষে, অণু থেকে পরমাণুতে। ব্রহ্মাণ্ডের গভীরে মহাশূন্যতার শেকড় পর্যন্ত তারায় তারায় ব্যপ্ত যে-প্রেম, যে-টান; চাঁদের মাটিতে তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বয়ে বেড়ায় কোজাগরী চাঁদ ও শ্যুমেকার।

(২)
ছেলেবেলার অ আ ক খ

আমেরিকার একজন খ্যাতনামা নৃতত্ত্ববিদ ছিলেন ইউজিন মার্লে শ্যুমেকার। ডাক নাম জেন। জন্ম ক্যালিফোর্নিয়ার লস এঞ্জেলেসে, ২৮শে এপ্রিল ১৯২৮। মা মারিয়েল মে একজন শিক্ষিকা। বাবা জর্জ এস্টেল শ্যুমেকার কৃষিকাজ আর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। এ ব্যতীত শিক্ষকতা ও চলচ্চিত্রের কাজে বিশেষ পারদর্শী। তাঁদের আদি নিবাস আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের একটি অঙ্গরাজ্য নেব্রাস্কায়। ইউজিন যখন খুবই ছোট, বাবা-মা লস এঞ্জেলেসে পাড়ি জমান। যদিও বড় শহরে থাকা জেন-এর বাবার একেবারে না-পসন্দ। তাঁর ভালো লাগে মফস্বল এলাকা। শহরতলী। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন মফস্বল টাউন ওয়াইমিঙ-এ থাকতে। এখানকার সিভিলিয়ান সংরক্ষণ কর্পোরেশনে তিনি ডিরেক্টর অব এডুকেশন। এদিকে, জেন-এর মায়ের ইচ্ছে বড় শহরে থাকা। মুখফুটে সে-কথা বলতে সাহস হয় না কখনও। আপস করে জেন-এর সঙ্গে ওয়াইমিঙ-এ কেটে যায় মারিয়েলের জীবন। আকস্মিক তাঁর জীবনের পট পরিবর্তন হল। ঘুরে গেল ভাগ্যের চাকা। বাফেলোতে মিলে গেল শিক্ষকতার চাকরি। বাফেলো তুলনামূলক বড় শহর। সেখানকার হাইস্কুলে পড়ানোর জন্য ছেলে জেন-কে সঙ্গে নিয়ে মা মারিয়েল পৌঁছে গেলেন বড় শহরে। বাফেলো স্কুলে ভর্তি করা হল ছোট্ট জেন-কে। গ্রীষ্মকালীন ছুটিছাটায় তাদের ওয়াইমিঙ-এ আসা। ঘুরে বেড়ানো। ছোট্ট জেন-এর প্যাশন শিলা খণ্ড এবং তার অনুসন্ধান। বাফেলোতে প্রস্তর খণ্ড নিয়ে পড়াশুনায় তাঁর জেদ বাড়ে। বাফেলো মিউজিয়ামের সায়েন্স এডুকেশন বিভাগের ফোর্থ গ্রেডে সরাসরি ভর্তি হয় সে। খনিজ পদার্থের নমুনা সংগ্রহের ভুত চেপে বসেছিল তার মাথায়। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হাইস্কুলের সান্ধ্যক্লাসে অ্যাডমিট হয়ে যায়। ১৯৪২ সালে, যখন তাঁর বয়স মাত্র তেরো বছর, পুরো পরিবার লস এঞ্জেলেস রওনা দেয়। পাকাপোক্ত সেখানে বসবাস শুরু করে। নতুন করে কিশোর জেন ভর্তি হয় লস এঞ্জেলেসের ফেয়ারফক্স হাইস্কুলে। এখানে এসে তাঁর সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটে। স্কুলের অর্কেস্ট্রা দলে দারুণ ভায়োলিন বাজায় জেন। সুন্দর জিমন্যাস্টিক প্রদর্শন করে। এমনকি, প্রস্তর খোদাই দোকানে শিক্ষানবিশের গ্রীষ্মকালীন কাজ জুটে যায় অনায়াসে।
অ্যারিজোনায় বিশালাকার উল্কাগর্তের কিনারে এক প্রস্তরখণ্ডের উপর উপবিষ্ট ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী ড. ইউজিন মার্লে শ্যুমেকার (১৯২৮–১৯৯৭)

১৯৪৪ সাল। বছর ষোলো বয়স তাঁর। অল্প বয়সে ক্যালটেক কলেজে ভর্তি হয় সে। গোটা ক্লাসের মধ্যে সে সর্ব কনিষ্ঠ। বাকিরা তাঁর চেয়ে বয়সে বড়, বেশ পাকা এবং স্নাতক শেষে দ্রুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ভীষণ উদগ্রীব। ইউজিন-এর এত তাড়া নেই। যদিও এখানে এসে দ্রুত উন্নতি করে সে। ১৯৪৮ সালে যখন স্নাতক ডিগ্রি হাসিল করে, তখন সবে ঊনিশ বছর পেরিয়েছে তাঁর বয়স। স্নাতক উত্তীর্ণ হয়ে তাঁর পাখির চোখ এমএসসি। ১৯৪৯-এ নর্দার্ন নিউ মেক্সিকোর প্রিক্যামব্রিয়ান মেটামরফিক শিলা খণ্ডের উপর পড়াশুনা চালিয়ে তাঁর স্নাতকোত্তর পাস।

(৩)
ও চাঁদ, সামলে রেখো জোছনাকে...

ক্যালটেক-এ অধ্যয়নের সময় থেকে দুজনের সখ্যতা। পরস্পর অভিন্ন হৃদয় রুমমেট তাঁরা। রিচার্ড স্পেলম্যান এবং ইউজিন শ্যুমেকার। রিচার্ড-এর বাড়ি চিকো, ক্যালিফোর্নিয়া। স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণ হবার পর দুজনের হৃদ্যতায় সাময়িক বিরতি নেমে আসে। দুই বন্ধুর জীবন দুদিকে ভিন্ন খাতে বয়ে চলে। ইউজিন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি চলে যায় রিসার্চ করতে। বন্ধু রিচার্ড-এর কোনো খবর নেই। বছর খানেক যোগাযোগ প্রায় বিছিন্ন। তারপর একদিন হঠাৎ একখান চিঠি এসে পৌঁছয় জেন-এর ঠিকানায়। চিঠিখানি এসেছে ক্যালিফোর্নিয়া, চিকো থেকে। প্রিয় বন্ধুর বিয়ে! আনন্দে আকাশ থেকে পড়ল জেন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাঁর। ধাক্কা সামলে চিঠিখানা খুলে পড়তে শুরু করল সে। অনেক করে লিখেছে বিয়েতে আসতে। আরও লিখেছে– বিয়ে বাড়িতে হবু বরের প্রিয় পাত্র বন্ধুটি তাঁর খুব স্পেশাল এবং অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। দুজনে যেন একে অপরের হরিহর আত্মা। এ হেন পরম মিত্রের বিয়েতে হাজির না থেকে উপায় আছে!

সময়টা ছিল ১৯৫০। খুশির সানাই বাজছে একটানা। রঙিন আলোয় ঝলমল করছে পুরো বাড়ি। সবাই দারুণ খুশি। আনন্দের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ঠিকরে পড়ছে সকলের মুখ চোখ থেকে। এদিকে, জেন-এর হয়েছে মহা জ্বালা। সবাই তাঁর খাতির করছে ঠিকই। তাঁর যত্ন আত্মির কমতি নেই একফোঁটা। কিন্তু বর ছাড়া তেমন পরিচিত কেউ নেই যার সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলে খানিক হালকা হওয়া যায়। আড্ডা মারা যায়। অপরিচিত কারও মুখোমুখি হলে হাসিমুখে সামান্য ঘাড় নেড়ে পাশ ফিরে চলে যায় আপন কাজে। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। হরেক মানুষের আনাগোনা। আত্মীয় স্বজন কুটুম্ব বন্ধু বান্ধবে ঘর ভর্তি। এমন সময় সদ্য কৈশোর পেরোনো জেন-এর চোখ গেল আটকে। হঠাৎ এক ঝলক তাঁর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল রূপসী এক মেয়ের উপর। প্রাণচাঞ্চল্য খুশিতে ডগমগ সুন্দরী সে-মেয়ে। টানাটানা হরিণ চোখ। বুদ্ধিদীপ্ত চাহুনি। শিশির ভেজা মোহময়ী ঠোঁট। তাঁর হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে। বেশ স্মার্ট। আন্দাজ করি সেও বোধহয় কৈশোর পেরোনো। চটপটে মেয়েটিকে এক ঝলক দেখে ভালো লেগে যায় জেন-এর।
 স্বামী ইউজিন মার্লে শ্যুমেকার (১৯২৮–১৯৯৭) এবং পত্নী ক্যারোলিন স্পেলম্যান শ্যুমেকার (১৯২৯–২০২১)

মেয়েটির নাম ক্যারোলিন। বন্ধু রিচার্ড-এর ছোট বোন। জন্ম নিউ মেক্সিকোর গ্যালোপ-এ, ২৪শে জুন ১৯২৯ সাল। মেয়ের জন্মের অব্যবহিত পরে তাঁদের গোটা পরিবার ক্যালিফোর্নিয়ার চিকো-তে এসে ওঠে। চিকো স্টেট কলেজ থেকে ইতিহাস ও পলিটিক্যাল সায়েন্সে স্নাতক সে। পড়াশুনার ক্ষেত্রে তাঁর দুচোখের বিষ বিজ্ঞানের বিষয়গুলি। বিশেষ করে ভূতত্ত্ব বিজ্ঞান অধ্যয়নে তাঁর তীব্র এলার্জি। একবার কলেজে ভুলক্রমে ভূতত্ত্ব বিজ্ঞান কোর্সে পড়া শুরু করে সে। তখন তাঁর মনে সাবজেক্টটি সম্পর্কে ভীষণ বিরক্তির উদ্রেক হয়েছিল। সেই শেষ। তারপর ঘুণাক্ষরেও সায়েন্সের সাবজেক্ট পড়াশুনার প্রশ্ন তাঁর মনে উদয় হয়নি দ্বিতীয় বার। বরাবর সে আর্টসের ছাত্রী। ভালো লাগে ইতিহাস পড়তে। পলিটিক্যাল সায়েন্সে বেশ দক্ষ।

দুজনের মধ্যে প্রথমে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বিয়ে বাড়িতে। হৃদ্যতা বাড়ে। ভালোলাগা কখন যে ভালোবাসা বনে গেল, কে জানে! ক্যারোলিনের প্রেমে পড়ে জেন। নিউ জার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলেও তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্যারোলিনের সুন্দর মুখ। যখন তখন এক পশলা বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিয়ে যায় তাঁর কোমল হৃদয়-মন। ওদিকে, মেঘবালিকার অবস্থাও তথৈবচ। নিয়মিত চিঠি লিখে চলল অব্যক্ত প্রেমের গোপন কথাগুলি। ইতিমধ্যে নৃতত্ত্ববিদ্যা মনের গোপন কোণে কখন যে ভালোবাসার জল সিঞ্চন করে চলে গেল! জেন-এর সংস্পর্শে একঘেয়েমির রাস্তা থেকে তাঁর ভালোবাসার বিষয়ে পরিণত হয়েছে নৃতত্ত্ব বিজ্ঞান। প্রেম জয় করতে পারে না এমন জিনিস এ পৃথিবীতে সম্ভবত নেই। 

🍂

তারপর এল সেই সময়। সোনায় মোড়া দিনগুলি। দুটি অশান্ত হৃদয়ের আরও কাছাকাছি আসা। মন দেওয়া নেওয়ার পালা। অনুচ্চারিত সম্পর্কের ভীত শক্ত করে আগামীর জয়-নিশান ঘোষণার এই তো সুবর্ণ সময়। দুই সপ্তাহের অভাবিত ট্রিপ এক অযাচিত সুযোগ নিয়ে হাজির হল দুজনের জীবনে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপালাচিয়ান পর্বতমালার অ্যাপালাচিয়ান মালভূমির দক্ষিণের একটি অংশ ক্যাম্বারল্যান্ড মালভূমি। সেখানেই ক্যাম্পিং ট্রিপের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হবে। সেই ট্রিপে অংশ নেয় জেন ও ক্যারোলিন। সেবার নির্জন মালভূমির নিস্তরঙ্গ বুকে প্রেমের ছাপ ফেলে গেল তাঁরা। ভালোবাসার অনন্য নিদর্শন তুলে ধরে কখন যে দুই সপ্তাহ সময় হুস করে ফুরিয়ে গেল, দুজনের কেউই টের পেল না একদম! ক্যাম্প শেষে যে যার বাসায় ফিরে গেল ঠিকই। একা একা কাটানো ক্ষণিকের মূহুর্তগুলো যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত বিরহ বেদনার সমান মনে হয়। এভাবে বেঁচে থাকা ভীষণ কষ্টের। আর সহ্য হয় না এ বিচ্ছেদ ব্যথা।
১৯৯৪-তে স্বামী-স্ত্রী
        
সেদিন ছিল শুক্রবার। ১৭ই আগস্ট ১৯৫১। প্রথম দর্শনের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই জেন-ক্যারোলিনের চার হাত এক হল চার্চে। স্বীকৃতি মিলল তাঁদের চিরন্তন প্রেমের। ভালোবাসা পরিণতি পেল। ঘর আলো করে এল তিন সন্তান। দুই মেয়ে, এক ছেলে।  এ হেন ক্যারোলিনের সময় কাটে ঘরকন্না করে। বাড়ির যাবতীয় কাজ সামলে আর ছেলেমেয়ে মানুষ করেই তাঁর দিন গুজরান। ছেলেমেয়ে বড় করার গুরু দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। সেটা ১৯৬০ দশকের কথা। তখন তাঁরা ফ্ল্যাগস্টাফের পার্মানেন্ট বাসিন্দা।  বিয়ের আগে কিছুদিন স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন ক্যারোলিন। অথচ স্কুলে ছেলে পড়ানোর বিন্দুমাত্র উৎসাহ-উদ্দিপনা তাঁর মধ্যে ছিল না। এদিকে, বিয়ের পর ঘরসংসার সামলাতে সামলাতে হাঁপিয়ে ওঠেন তিনি। আত্মীয় স্বজনের কাছে সন্তানদের বাড়িতে রেখে মাঝে মধ্যে স্বামীর সঙ্গে বাইরে বেড়াতে যেতেন তিনি। এতে ফল হল মারাত্মক। ছেলে-মেয়েদের উপর বাবা-মা না-থাকার ফল হল সুদূরপ্রসারী। কুপ্রভাব ছায়া ফেলছে ওদের শৈশবে। অগত্যা, সন্তানদের একলা রেখে বাইরে বেড়িয়ে আসার চিন্তা ঘুণাক্ষরেও দ্বিতীয়বার তাঁর স্মরণে আসেনি। সন্তান বড় হলে'পর তাঁর দীর্ঘদিনের লালায়িত সুপ্ত বাসনা প্রকাশ পেল মনে। জেগে উঠল অন্তর্নিহিত শক্তি। স্বামীর পরামর্শ এবং পূর্ণ সহযোগিতায়‌ নিজ উদ্যমে ক্যারোলিনের জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা শুরু এবং অনায়াসে ইউজিনের দলে ভীড়ে যায় সে। জেন-এর দল তখন পৃথিবী অভিমুখে ধাবমান গ্রহাণুদের নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে। অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে তাঁর পড়াশুনা ও নিয়মিত চর্চা চলে সমান তালে। জেন-এর দলে গ্রহাণু অনুসন্ধানে হাত লাগায় সে। লোয়েল অবজারভেটরির এক স্টুডেন্ট তাঁর অ্যাস্ট্রোনমি শিক্ষক। অসীম ধৈর্য্য ও অপরিসীম অধ্যবসায়ের জেরে প্লেনেটরি অ্যাস্ট্রোনমার হিসাবে ক্যারোলিনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ৫১ বছর বয়সে। আমৃত্যু গ্রহাণু ধূমকেতু গবেষণায় কখনও ছেদ পড়েনি আর।

(৪)
কসমিক লাভ 

পূর্ণিমার চাঁদ কি মোহময়ী? অমাবশ্যার চাঁদ নাকি মেঘে ঢাকা চাঁদ – কে বেশি সুন্দরী? রাত-মেঘের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা চাঁদ! ঈদের চাঁদ! নাকি, ঘুমপাড়ানি চাঁদ! কার সৌন্দর্য বেশি উপভোগ্য? কে বেশি আকৃষ্ট করে মানুষকে? ভাবুক কবি কিংবা রোমান্টিক প্রেমিক মাত্রেই কলঙ্কিত চাঁদের প্রেমে মজেনি, এ কথা বিশ্বাস প্রতিপন্ন হয় না। পূর্ণিমার রাতে কোজাগরী চাঁদের রূপোলী আলোয় মাঠ-ঘাট-নদী-তট নির্জন প্রান্তর অথবা দিগন্ত বিস্তৃত ধূ ধূ চরাচর যে মায়াবী পরিবেশ ফুটিয়ে তোলে, তার সমতুল্য রহস্যময়তা কোথায় খুঁজে পাওয়া যায়? বেজায় দুষ্কর খুঁজে পাওয়া। সুন্দরী যুবতীর বক্ষখাদের যে গভীরতা, যে আকর্ষণ, যে ইশারা; সে-টান এড়ানো যেমন বড্ড কঠিন, তেমনি নজর এড়ানো বেজায় কঠিন কোজাগরী চাঁদের গর্তগুলির গোপন ইশারা, তীক্ষ্ম চাহুনি। ভগ্নহৃদয় চাঁদের বুকে এত যে ক্ষত, এত যে বেদনা; তার অনুসন্ধানে পূর্ণ চন্দ্রের প্রেমে মজলেন ইউজিন শ্যুমেকার। সেটা ১৯৬০ দশকের কথা। ক্যালিফোর্নিয়ার মেনলো পার্ক অঞ্চলে অবস্থিত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভে (USGS) সেন্টারের আমরণ সদস্য ইউজিন। ১৯৬০-এ শ্যুমেকার এবং তাঁর দলবল চন্দ্রপৃষ্ঠের প্রথম জিওলজিক ম্যাপ তৈরিতে ব্যস্ত। ফ্রান্সিস জি. পেজ-এর তোলা কিছু ফটোগ্রাফির উপর নির্ভর করে তাঁদের যাবতীয় কেরামতি। এসময় লুনার রেঞ্জার মিশন নাম দিয়ে মনুষ্যবিহীন স্পেস মিশনে উদগ্রীব হয়ে ওঠে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। লক্ষ্য শূন্যে মহাকাশযান পাঠিয়ে যতদূর সম্ভব নিকট থেকে চাঁদের পৃষ্ঠদেশের ছবি তোলা। চাঁদের বুকে যে গুচ্ছ গুচ্ছ গর্ত, খাদ; তার সঠিক দিশা খুঁজে বের করা। সেই লক্ষ্যে প্রথম ছ'খানা মিশনের সলিল সমাধি ঘটল অচিরে। প্রতিটি অকৃতকার্য মিশন থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে শুরু হয়েছিল পরের মিশন। শেষমেশ নাসার মুখ্য দপ্তর এবং জেট প্রপালসন ল্যাবরেটরি সাফল্যের মুখ দেখল রেঞ্জার-৭ স্পেসশিপ পাঠিয়ে। চাঁদের পূর্ণাঙ্গ ফটো তুলে পৃথিবীতে ফেরত পাঠানোর কাজে একশো শতাংশ সফল রেঞ্জার-৭। সেটা ১৯৬৪ সালের ঘটনা।
    অ্যাপোলো-১১ মিশনের জন্য অ্যাস্ট্রোনট প্রশিক্ষণরত ইউজিন শ্যুমেকার

তারপর এল মিশন অ্যাপোলো-১১। চাঁদের বুকে প্রথম কোনো মানুষ পাঠাতে উঠে পড়ে বসল নাসা। যার প্রথম ধাপ অ্যাস্ট্রোনট বাছাই পর্ব। শর্ত একটাই। আমেরিকান নভশ্চর। এ হেন প্রোগ্রামে ভীড়ে গেলেন শ্যুমেকার। তাঁর চন্দ্র-প্রেম সর্বজনবিদিত। সুতরাং এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করার প্রশ্নই ওঠে না। চাঁদের বুকে হাঁটা প্রথম ভূতত্ত্ববিদ হিসাবে তাঁর নির্বাচন প্রায় পাকা। কারণ তাঁর সমকক্ষ ভূতত্ত্ব বিজ্ঞানী তখন আমেরিকায় অমিল। সুতরাং শুরু হল ট্রেনিং। কঠিন থেকে আরও কঠিন ফিজিক্যাল এবং মেন্টাল ট্রেনিং। সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। এমন সময় একদিন তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। থমকে দাঁড়ায় সময়। বড় কঠিন এ সময়! ধরা পড়ল রোগ। অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির অসামঞ্জস্য নিঃসরণ ঘটিত সমস্যা অ্যাডিসন'স ব্যাধি। বন্ধ হয়ে গেল ট্রেনিং। ভেঙে চুরমার হল সোনালী স্বপ্নের রঙিন ফানুস। গভীর খাদে তলিয়ে গেল তাঁর যাবতীয় বাসনা। উদ্যম। উল্কাগর্তের গাঢ় অন্ধকারে চাপা পড়ে গেল তাঁর অব্যক্ত চন্দ্রপ্রেমের গোপন কথাগুলি।

তবে শেষ হয়েও হল না শেষ। অ্যাপোলো-১১ মিশনের সঙ্গে সরু সুতোয় জুড়ে রইল তাঁর ভাগ্য। অদৃশ্য বাসনা। দুধের স্বাদ মিটল ঘোলে। নিজের নভেশ্চর হওয়ার সম্ভাবনা বিশ বাঁও জলে ডুবে গেলেও অ্যাপোলো-১১ মিশনের অ্যাস্ট্রোনট তৈরির ট্রেনিং এক্সপার্ট হিসাবে শুরু হল তাঁর জার্নি। বাড়ির কাছে ফ্ল্যাগস্টাফের নিকটে যে উল্কাগর্ত এবং সানসেট খাদগুলি রয়েছে, সেখানে চলল তাঁর নভেশ্চর তৈরির প্রকৌশল। দৈহিক ও মানসিক সমস্ত বাধার ধাপগুলি ভালোয় ভালোয় উতরে গেলেন নভেশ্চরগণ। তারপর এল সেই ঐতিহাসিক ক্ষণ। গর্বের মূহুর্ত। ঘড়িতে রাত আটটা বেজে সতেরো মিনিট। ২০শে জুলাই ১৯৬৯। চাঁদের মাটিতে সর্বপ্রথম পা রাখল অ্যাপোলো লুনার মডিউল ঈগল। এর ঠিক ছয় ঘণ্টা ঊনচল্লিশ মিনিট পরের ঘটনা। দিনটা ছিল সোমবার। ২১শে জুলাই ১৯৬৯। ঘড়িতে তখন ২ টা ৫৬ মিনিট। গভীর রাত্রি। পরিষ্কার মেঘশূন্য আকাশ। ঈগলের পেট চিরে সর্বপ্রথম চাঁদের মাটি স্পর্শ করলেন আমেরিকান নভেশ্চর নীল আর্মস্ট্রং। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হল তাঁর নাম ও কৃতিত্ব। ঠিক ঊনিশ মিনিট পর ঘটল আরেক অত্যাশ্চর্য ঘটনা। দ্বিতীয় মানুষ হিসেবে বাজ অলড্রিন পা রাখলেন চাঁদ মামার বাড়ি। চন্দ্রপৃষ্ঠে সর্বমোট ২১ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট সময় অবস্থান করেছিল কলম্বিয়া মহাকাশ যান। তারপর পৃথিবীর উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিল স্পেসশিপটি। 
       চন্দ্রযান মিশনে নভেশ্চর তৈরির প্রশিক্ষণে বিজ্ঞানী ইউজিন শ্যুমেকার, ব্রুকস ক্যাম্প, কাটমেই ন্যাশনাল পার্ক

টেলিভিশনের পর্দায় লাইভ অনুষ্ঠানে চন্দ্রপৃষ্ঠে প্রথম মানুষের অবতরণ চাক্ষুষ করে নষ্টালজিক শ্যুমেকার। একইসঙ্গে আফশোষ এবং উত্তেজনার দ্বৈত সত্তা তাঁর মনে। গৌরব ও বেদনার জল মিলেমিশে একাকার। তাঁর দুচোখে তখন ভরা শ্রাবণ। টপটপ ঝরে পড়ছে আনন্দাশ্রু। টেলিভিশনে তাঁর লাইভ কমেন্ট্রির পাশাপাশি চলছে এতদিন চাঁদের বাড়ি না-পৌছনোর শাপমোচনের নানান কৌশল। অ্যাপোলো-১১ চন্দ্রযানের টেকঅফ থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারাভাষ্য দিয়ে চোখের জলে তাঁর আবেগ, ভালোবাসা ও অব্যক্ত প্রেমের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ চাক্ষুষ করেছিল বিশ্ববাসী। যদিও জীবন এগিয়ে চলে শর্তহীন স্বার্থহীন নিঃশঙ্ক পথে। গ্রহাণু ধূমকেতু উল্কাপাত এবং উল্কাপিণ্ডের আঘাতে সৃষ্ট খাদগুলি আবিষ্কার ও অনুসন্ধান করে তাঁর অনন্ত পথ চলা। সেই পথের প্রতিটি কাঁকরে, প্রতি পদক্ষেপের আড়ালে চাঁদের প্রতি তাঁর প্রেমানুরাগ কখনও মুছে যায়নি। নিঃশ্বাসের প্রতি বিন্দুতে জেন-এর অপার্থিব অপূর্ণ প্রেমের দীর্ঘশ্বাস টের পায় মানসী মিসেস ক্যারোলিন শ্যুমেকার। নিজের গোটা জীবদ্দশায় সেই পূরণ না-হওয়া লাভ স্টোরির এক ট্র্যাজিক হিরো বনে গেলেন তাঁর স্বামী ইউজিন শ্যুমেকার।

(৫)
স্বপ্ন পূরণের রূপকথা 

সেদিন ছিল শুক্রবার। ১৮ জুলাই ১৯৯৭। অস্ট্রেলিয়ার অ্যালিস স্প্রিংয়ের ট্রেকিং রাস্তা ধরে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে একখানা চারচাকা। গাড়ির ভেতরে স্বামী-স্ত্রী ইউজিন শ্যুমেকার আর শ্রীমতী ক্যারোলিন শ্যুমেকার। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে উল্কাপিণ্ড যে-জায়গায় আঘাত হানে, সেখানে উল্কাখণ্ড সৃষ্ট খাদ তথা গর্তগুলির ভূতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য বিশ্বময় ছুটে বেড়ানো তাঁদের নেশা। এমনই এক গভীর খাদ পরিদর্শনে তাঁদের অস্ট্রেলিয়া আসা। খাদ পরিদর্শনে গিয়েই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে তাঁদের গাড়ি। উল্টোদিক থেকে দ্রুত গতিতে আসা একটি গাড়ি মুখোমুখি ধাক্কা মারে বিজ্ঞানী দম্পতির গাড়িটিকে। সরাসরি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই মারা যান বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী ইউজিন শ্যুমেকার। গুরুতর আহত তাঁর স্ত্রী ক্যারোলিন শ্যুমেকার। চটজলদি তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের বেডে স্বামীর মৃত্যু সংবাদ শুনে হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। অশ্রুমোচন করা ব্যতীত তাঁর বিকল্প গত্যন্তর নেই।  দুকুল ছাপিয়ে কান্না আর পরিতাপ বিনা স্বামীর অস্থি-ভষ্ম টুকুই তাঁর অন্তিম সম্বল। শেষ বেলার সাথী। 
     বৃহস্পতির বুকে শ্যুমেকার-লেভি ৯ ধূমকেতু (কালো বিন্দু)

সেবছর একটি লুনার প্রসপেক্টর চাঁদে পাঠানোর তোড়জোড় করে নাসা। এ হেন সংবাদ ক্যারোলিনের কানে পৌঁছায়। শোনা মাত্রই তিনি ছুটে যান নাসার সদর দপ্তরে। স্বামীর অস্থি-ভষ্ম সমেত। নাসার কাছে তাঁর একান্ত আর্জি – যদি লুনার প্রসপেক্টার বাহনে তাঁর স্বামীর অস্থি-ভষ্ম বয়ে নিয়ে গিয়ে চাঁদের মাটিতে গ্রথিত করা যায়! সমাধিস্থ করা হলে তাঁর স্বামীর বিদেহী আত্মা খানিক শান্ত হবে বলে তাঁর একান্ত বিশ্বাস! নাসার বিজ্ঞানীরা মেনে নিলেন মিসেস শ্যুমেকারের প্রার্থণা। প্রয়াত ইউজিন শ্যুমেকারের অস্থি চলল চাঁদের দেশে। তাঁর চির প্রেমের কাছে। আজন্ম ভালোবাসার বাড়ি। অস্থি-ভষ্ম একখানা ক্যাপসুলে ভরে তাঁর প্রেয়সী চাঁদের বাড়ি বয়ে নিয়ে গেল লুনার প্রসপেক্টর। সেদিনটা ছিল মঙ্গলবার। ৬ই জানুয়ারি ১৯৯৮ সাল। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি একখানা বায়ুশূন্য পরীক্ষিত আস্তিনের মধ্যে থাকা ক্যাপসুলটি আসলে পলি-কার্বনেট পদার্থের তৈরি। লম্বায় পৌণে দুই ইঞ্চি। আড়াআড়ি ব্যাস এক ইঞ্চির সত্তর ভাগ অংশ। 

অস্থি-ভষ্মের সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল একগুচ্ছ জিনিস। বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক পর্যবেক্ষণকৃত হেল-বপ ধূমকেতুর ছবি সংবলিত একখান পিতলের পাত। উত্তর অ্যারিজোনায় সন্ধান পাওয়া একটি উল্কাপিণ্ডের প্রতিচ্ছবি। ইত্যাদি। ইত্যাদি।

অস্থি-ভষ্মের সঙ্গে ক্যাপসুলে পাঠানো হয়েছিল আরও একটি জিনিস। ক্যারোলিনের সযত্নে বাছাই করা একছত্র সমাধি-বার্তা। 'পৃথিবীতে সর্বোত্তম আবেগের বহিঃপ্রকাশই হল ভালোবাসা' শীর্ষক বিবৃতি লেখা মেসেজের ছত্রে ছত্রে যে আবেগ, যে ভালোবাসা, তা স্রেফ নজিরবিহীন। অনন্য সুন্দর এক অপার্থিব চন্দ্রপ্রেমের আবেগঘন দৃষ্টান্তের জ্বলন্ত উদাহরণ মেসেজটি। ক্যাপসুলে খোদাই করা আছে বিশ্বখ্যাত ইংলিশ কবি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের অমর সৃষ্টি 'রোমিও এবং জুলিয়েট' কাব্য গ্রন্থ থেকে নেওয়া একটুকরো সোনালী বার্তা। এ হেন মেসেজের পরতে পরতে, প্রতিটি শব্দে, ভাষায় অপার্থিব ভালোবাসার অনুচ্চারিত অমোঘ কথাগুলি মৃত্যুর পরে অশরীরী চন্দ্রালোকে সদর্ভে ভেসে বেড়ায়। চির রোম্যান্টিক জেন-এর একটুখানি ভালোবাসার করুণ কাহিনী স্মৃতি তর্পণ হয়ে উড়িয়ে দিলেম হাওয়ায়—

"যখন সে মরে যাবে,
তাকে ধরো এবং খণ্ডিত করে ছোট ছোট তারায় নিয়ে চলো তাকে,
সে হবে স্বর্গের মুখ; এত সুন্দর মুখ —
যে ঘন আঁধারেও ভালোবেসে রয় গোটা বিশ্ব
এবং ঝলমলে সূর্যের উপাসনা করে নাকো।"

সালটা ১৯৯৮। এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্যারোলিন শ্যুমেকারের শোক সন্তপ্ত বার্তা —
"আমি জানি না, জেন কখনও স্বপ্ন দেখত কিনা যে তার অস্থি-ভষ্ম একদিন চাঁদের বুকে রওনা হবে। বেঁচে থাকলে সে অবশ্যই রোমাঞ্চ অনুভব করত। আমাদের অনুভূতিগুলোর তরফে ছোট্ট একখানা দৃষ্টান্ত বয়ে আনলো এ ঘটনা। আমরা যখনই চাঁদের দিকে তাকাই, আমরা সর্বদা জানি যে জেন ওইখানে রয়েছে।"

নিজের মিশন পূরণ করে যখন লুনার প্রসপেক্টর চাঁদের বুকে ধ্বংস হয়ে গেল। তাঁর স্বপ্ন সফল করল ইউজিনের অস্থি। সে-ই একমাত্র পুরুষ মানুষ, যে কিনা চন্দ্র-প্রেমে বিভোর হয়ে নিজেকে চাঁদের মাটিতে গ্রথিত করেছে। চাঁদের বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেয় তাঁরা দুজন — প্রেয়সী কোজাগরী চাঁদ আর পার্থিব প্রেমিক ইউজিন শ্যুমেকার। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে শাশ্বত প্রেমের টানে পৃথিবী ছেড়ে সে পাড়ি দিয়েছে চাঁদে। শেষমেশ চাঁদের রুক্ষ মাটিতে চিরশান্তির আশ্রয়ে বেঁচে রয়েছে তাঁর চন্দ্রপ্রেম। গোপনে নয়; সশব্দে, সগর্বে। এ যেন ঘোর বাস্তব। কারণ প্রতিটি রাত্রির মায়াবী আঁধারে তাঁদের অভিসার নিষিক্ত সংসার-নামার প্রাত্যহিকী স্পষ্ট হয় প্রত্যেক চন্দ্রখোচিত রাত্রির অন্ধকারে। প্রিয়তমা চন্দ্রের প্রতি প্রেমিক জেন-এর কাল্পনিক ডায়লগগুলি, যা প্রচ্ছদের প্রথমে উল্লেখিত, যেন পরা-বাস্তবতার সেরা উদাহরণ। 

তথ্যসূত্র :
উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন অনলাইন আর্টিকেল


Post a Comment

0 Comments