বাগদি চরিত ( একপঞ্চাশত পর্ব)
শ্রীজিৎ জানা
ঘরে ঢোকার সময় ঊমানাথের কানে যায় লোখার কথা। খাটের উপর বসেই লোখার দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করেন,
– চাঁপা ফুল পুজোয় লাগে? শিমূল? কিন্তু টগর লাগে। নয়নতারাও। বর্ণে নয়,মর্মে চেনেন ঈশ্বর। তিনি তো অন্তর্যামী। অন্তঃকরণ নিয়ে তাঁর কারবার। অলক্ষ্যে বসে তিনি আমাদের ওই ভিতরের ঘরটুকুইতেই উঁকিঝুঁকি মারেন। দেখেন ভিতরটা কার কত পরিচ্ছন্ন। তা দেখেই হিসাবনিকাশ করেন। খগেন্দ্র! তোমার কি মত? আমি ভুলভাল বলছি না তো বাপু? দেখো,বুড়ো মানুষ আমি! বেতাল কিছু বললে থামিয়ে দিও।
বলেই লাউফুল রঙের মতো শুচিশুভ্র হাসি ছড়িয়ে দেন। খগেন মাস্টারের মুখেও ফুটে ওঠে স্মিত হাসি। লোখা হাবাগোবা গোছের একটা মুখ করে দুজনের দিকে তাকায়। চায়ে একটা চুিমুক দিয়ে মাস্টার বলে,
– আপনি যে কি বলেন স্যার! আপনার ভুল ধরার ধৃষ্টতা আমার নেই। একজন মনযোগী শ্রোতার আসনে নিজেকে বসাতে পছন্দ করি। এই সমাজকে, ধর্মকে আপনার চোখ দিয়ে দেখতে এবং বুঝতে চাই সবসময়।
—আসলে কি জানো, সৃষ্টিকর্তা যেখানে প্রভেদ করেননি,সেখানে কয়েকজন স্বঘোষিত সমাজপতি কিম্বা পন্ডিত ভেদাভেদের ফতোয়া জারি করবেন,তা আমি মানতে পারব না। বর্ণাশ্রম প্রথা বিভাজন হয়েছে কর্মের ভিত্তিতে। তুমি ওই বর্ণভূক্ত একজন কর্মী। কর্মীর প্রমোশান -ডিমোশান দুই-ই হতে পারে। বাগদি ব্রাহ্মণ হতে পারে। ব্রাহ্মণ বাগদি হতে পারে। আমার কাছে কর্মাচরণ হবে মাপদন্ড।
থেমে থাকতে পারে না। লোখা। যত শুনে তত ছটপট করে। স্থির হয়ে চেয়ারে বসতে পারে না। মাস্টার লক্ষ্য করে লোখা বসে বসেই তিড়বিড় করছে। গ্রামের মিটিংয়ে ওকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে না কেউ। কথার মাঝে ফুট কাটবেই কাটবে। এখানে সে কি করে যে চুপ আছে খগেন মাস্টারের কাছে সেটাই বিস্ময়ের। কিন্তু সেই বিস্ময় হঠাৎই কেটে যায়। লোখা প্রশ্ন করে বসে,
– থাইলেও স্যার,অই পৈতাটার একটা ব্যাপার আছে। উটা ত ধারণ করা সজা নয়।
–কেন? কেন ধারণ করা সোজা নয়? যোগ্য হলে নিশ্চই ধারণ করা যায়। তোমরাও ত ধারণ কর। তোমাদের যারা ধর্মঠাকুরের পূজা করে। তাদের তো পৈতা হয়। তবে পরে পৈতে খুলে তামাদি ধারণ করতে হয় ডান হাতে। পৈতা একটা উপলক্ষণ,মানে চিহ্ণ। যেই চিহ্ণ দিয়ে তাকে চেনা যায়। আর্যরা বর্ণাশ্রম চালু করেছে। আর্যদের পূর্বে তো ভারত ভূখন্ডের অস্তিত্ব ছিল। তখন কি ঈশ্বরের আরাধনা হত না। অনার্য সভ্যতায় ঈশ্বর অথবা শক্তির আরাধনা হত ব্যপকভাবে। সেই অনার্যদের কাছ থেকে কায়দা করে পূজার্চনার অধিকার যে কেড়ে নেওয়া হয়নি একথা জোর দিয়ে বলা কি যায়! আর ওই যে গায়ের রঙ নিয়ে কথা বলছিলে আমার কাছে সেটাও বেশ গোলমেলে,জানো খগেন্দ্র!
– লোখার কথাটা মিথ্যা নয় স্যার। এরকম কথা আমাকে বহুবার শুনতে হয়েছে। এখনও হয়। বলে, উ গায়ের রঙ দেখলেই বুঝা যায় দুলা নাকি বাগদি। তাবাদে প্রত্যেক জাতের নিজেদের তো কিছু বৈশিষ্ট্য থাকবেই। তাকে নিয়েও টিটকারি শুনতে হয়। কেউ একটা পচলাপচলি কোরলো তো বলবে, কিরে বাগদিদের মত তোর মুখের ভাষা কেন? কেউ হয়তো উদ্ভট সেজেছে, অম্নি বোলবে– কিরে বাগদিদের মতো সেজেচু কেনে? বাচ্চা ছেলেমেয়ের ধূলোকাদা মাখা গা। অম্নি তার মা বলবে, বেগদা- ছ্যানা কুথাকার! তারপর ত নামজাদা লেখকরা পর্যন্ত তাঁদের লেখায় বাগদিদের স্বভাবচরিত্রকে একপ্রকার নীচ করেই দেখিয়েছেন। এই মনকষ্ট শুধু লোখার একার নয়, আমারও। আমাদের সবার।
–তা দেখিয়েছেন বটে। ভারতীয় সভ্যতায় এই ফর্সা রঙ নিয়ে এত মাতামাতি কেন জানি না বাপু। কালো মানুষদের হীন চোখে দেখা হয়। শুধু এদেশে নয়,বিদেশেও। কিন্তু অনার্যরা তো ফর্সা নয়। এই ভারত অনার্যদের ভারত। আর্যরা তাদের হটিয়েছে,দাসত্ব করিয়েছে। অনার্যীয রীতিনীতিকে নস্যাৎ করেছে বুদ্ধির জোরে। গায়ের জোেরে। সমস্ত আচার বিচারকে নিজেদের মতো করে গড়েছে। তারপর চাপিয়ে দিয়েছে দুর্বলদের উপর। আবারো বলে রাখি খগেন্দ্র, গায়ের রঙ দিয়ে যদি জাতের উঁচু নীচু ভেদাভেদ করা হয় তাহলে শাস্ত্রবেত্তারা বড্ড ফাঁপরে পড়ে যাবে। অবতার শ্রীকৃষ্ণ তো কালো। বলা হয় নবদূর্বাদল শ্যাম। সত্যবতী, দ্রৌপদীরা তো কৃষ্ণা। তোমাদের ফলহারিণীর রূপ তো ঘোর অমানিশা। অষ্টাদশ পূরাণের রচয়িতা ব্যাসদেবের গাত্রবর্ণ তো নিকষ কালো। তাহলে তাদের কোন চোখে দেখবে? কথায় আছে না কালো জগতের আলো। গায়ের রঙ নিয়ে হীনমন্য হোয়ো না।
লোখা এতক্ষণে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মাস্টার তার চোখমুখ দেখে বুঝতে পারে,এবার লোখা হয়ে উঠছে সেই ঢোলের লোখা। মুখ দিয়ে যার বুড়াই হানার জলের মতো কথার রেস ছুটবে।
—মন ছোট করিনি স্যার কুন্তু মেস্টারের কথাটাই ঠিক, খুব কষ্ট হয়। বাগদিকে বাগদি বল্লে দোষ নাই। কুন্তু এমন কোরে বলে যেন মোদের জাতটা খুবই নীচু জাত। মোর বেশি লিখাপড়া জানা নাই। তবু সাহস করে বলি একটা কথা। মেস্টার বোল্ল যখন। সেই ছোট বেলায় একটা কবিতা পড়েছিলম রবীন্দ্রনাথের। সেও লিখেছে বাগদি বুড়ি চুবড়ি ভরে লিয়ে শাক তুলচে পুখুর পাড়ে এসে। যখনই ইটা পোড়ত মাহিষ্য পাড়ার ছেনারা,তখনই তাদের চোখে আমি কুন্তু অন্য ধরণের পিটপিটানি হাসি দেখেচি। যদিও বোলতে আমি ছাড়িনি। যতই তরা হাস, খারাপ ভাব,তোদের কথা ত লিখেনি। লিখেচে মোদের জাতের কথা। থাইলে বুজ!
– এটা তে মনখারাপের কি আছে। কবিগুরু এখানে সহজ মনেই গাঁয়ের চালচিত্র এঁকেছেন। এতে ছোট কোরে কাউকে দেখান নি।
কিন্তু লোখাকে তো এখন ভর করেছে ঢোলের লোখা। ঊমানাথ ঠাকুর তার টেরই পাবে না। লোখার আনাড়িপনা একমাত্র জানে শুধু খগেন মাস্টার। তবে এই মুহুর্তে লোখাকে থামায় না। পরিস্থিতিটাকে রসিয়ে উপভোগ করতে চায় সে। দেখতে চায় লোখা ঊমানাথ স্যারের সঙ্গে কিভাবে তর্ক করে। মাস্টার জানে লোখা এখুনি দমবার পাত্র নয়।
—না স্যার, মোর কথাটা হচ্চে। আর কুনু জাতের বুগি কি শাক তুলেনি। না খাইনি। আমরা গরীব জাত। শাকপাতা খেয়ে পেট চালাই। সেইটাকেই লিখতে হবে। হয়তো ভালর জন্য লিখেচে কুন্তু বাগদি কথাটা না দিতে পাত্ত।
খগেন মাস্টার মুখ টিপে হাসে। লোখা তার দিকে একটা গৌরবের চাউনি দেয়। বোঝাতে চায়, দেখ ক্যামন মোক্ষম যুক্তি সে খাড়া করেছে। কিন্তু বাড়ি ফিরতে হবে তাদের। বেশি রাত করা যাবে না। প্রসঙ্গটা এবার তুলতে চায় মাস্টার। লোখাকে সরাসরি থামানো মানে বিবাদ ডেকে আনা। তাই কৌশলে লোখার কথার জের টেনেই কথা শুরু করে খগেন মাস্টার।
–কিছু মনে করবেন স্যার। এখানে লোখার কথাটাকে একবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে কি? বঙ্কিমচন্দ্র শরৎচন্দ্র, মাণিক ওবং তারাশঙ্কর তাঁদের বেশিরভাগ লেখায় বাগদি জাতটাকে অনেকটাি উপেক্ষার চোখেই দেখাতে চেয়েছেন। ডাকাত মানেই বাগদি। লেঠেল মানেই বাগদি। তাদের সেই কাজ গুলোকেি বেশি দেখারেন সমাজের চোখে যা চরম নিন্দার। তাদের শক্তি ও সাহস জমিদারদের নীপীড়নের বিরুদ্ধে একসময তরবারির মতো ঝলসে উঠেছিল। তাদের দস্যু বৃত্তি তো লেগেছে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে। কিন্তু তেমন করে কেই তো লিখল না তাদের সেই গৌরবগাথা। গোবর্ধন দিগপতি নিয়ে কেউ কি দুটো বাক্য খরচ করেছে তাঁদের লেখায়। আর এখানেই আসে শোভা সিংহের কথা। যার জন্যি আপনার কাছে ছুটে আসা।
—তোমার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব কিনা জানিব না খগেন্দ্র। আসরে তুমি কি জানতে চাইবে তা মোটামুটি আন্দাজ করতে পারছি। শোভা সিংহকে নিয়ে আমার মনের ভিতরে দ্বন্দ্বের শেষ নেই। সে কথা থাক। আগে তুমি বলো আমি যা ভাবছি, সেটাই কি তোমার জিজ্ঞাসা?
🍂
–জানি না স্যার আপনি কি ভাবছেন! তবে আমার যত আগ্রহ ওই রাজার জাত পরিচয় নিযে। হয়তো অনেকেই এতে আমাকে দুকথা শুনাবে। বলবে আজকের দিনে জাত নিয়ে এই দড়ি টানাটানি আদৌ কাম্য নয়। কিন্তু এখানে লুকিয়ে আছে স্বাভিমানের প্রশ্ন। ইতিহাস চিরকাল সত্যিই বলেছে একথা কেউ হলপ করে বলতে পারে না। ঐতিহাসিকরা অনুমান শব্দ ব্যবহার করে নানা যুক্তিজালে অনেক ধোঁয়াশাই সৃষ্টি করেছেন। তার মধ্যে যুক্তি-বুদ্ধির চমৎকারিত্ব থাকলেও,অনেকসময় প্রকৃত ইতিবহাস অবহেলিত হয়েছে। তাঁদের অনুমানেই কি শেষ হয়ে যায় অতীতের ঘটনাক্রম! নাকি উচ্চবংশজাতরা নিম্নজাতের অধীনস্থ থাকার লজ্জা ঢাকতে তালিতাপ্পি মেরে তাকে রাজপুত দেখানোর মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছেন। শোভা সিংহ সত্যিই কি বাগদি নয়?
—বড্ড জটিল এই প্রশ্ন খগেন্দ্র! এযাবৎ যত বইপত্র শোভা সিংহকে নিয়ে লেখা হয়েছে,তাতে কেউ জোরের সঙ্গে নিজের যুক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। সবটাই অনুমান এবং কিছু তখ্যের যোগসূত্রতা। কেউ বলেন তিনি বাগদিরাজ। কারো মতো তিনি বাগদিদের রাজা।
–আসলে আমার কিছু জায়গায় বড্ড খটকা লাগে স্যার। একদিকে বগড়ি পরগনা,যাকে বগডিহি বা বাগদিদের গড় বলা হয়। অন্যদিকে মল্ল রাজাদের রাজত্ব। তার মাঝে চন্দ্রকেতু রাজবংশ। শোভা সিংহ যে অঞ্চলে তাঁর রাজত্ব কায়েম করেন, সেই অঞ্চলে আগে থেকেই বাগদিদের ব্যাপক বসতি ছিল। তারা যে যথেষ্ট শক্তিশালী জাতি তার প্রমাণ অনেক রয়েছে। সেইরকম একটি দুর্ধর্ষ জাতির রাজ হলেন ভিন্ন জাতির কেউ এবং তারা তাকে মেনে নিল বিষয়টা এত সহজ নয় বোধহয়। আর তাই যদি হয় তবে পরের যে ঘটনাটি প্রচলিত আছে তাহলে তাকেই মান্যতা দিতে হয়।
–তার মানে তুমি বলতে চাইছ বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার চক্রান্তের কথা?
—হ্যাঁ স্যার। শোভা সিংহের পূর্বে এই অঞ্চলে যে রাজা ছিলেন তা সত্য। সেই রাজাকে চক্রান্ত করে শোভা সিংহ হত্যা করেন তাও তো সত্য।
— আর প্রজা অসন্তোষ যাতে না বাড়ে সেইজন্য আরাধ্যা বিশালাক্ষী দেবীকে সামনে রেখে তাদের ধর্মীয় আবেগে প্রলেপ দেন। বিড়ালাক্ষী দেবীর পূজাতে বাগদিদেরই প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়টি কী তুমি বলতে চাইছ?
— সেটাই তো প্রমাণ করে রামেশ্বর ঠাকুরের বিশালাক্ষী দেবীর পূজা অস্বীকার করার মধ্যে একটা বড় প্রশ্ন চিহ্ন থেকে যায়। একজন সামান্য পুরোহিতের এতবড় সাহস কিভাবে হয় যে, রাজবংশের কুলদেবীর পূজা করতে চায় না!
লোখা ফ্যালফ্যাল করে তাকায় দুজনের মুখের দিকে। ভাবে, মাস্টার এসব কী কথা আউড়ে যাচ্ছে। শোভা সিংহের নামটুকু সে জানে মাত্র। এর বাইরে দুজনের কথাবার্তার মাথামুন্ডু সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। শুনতে ভালো লাগছে তার একটাই কারণে, আলোচনায় বারবার উঠে আসছে তার জাতের নাম। কিন্তু কখন থামবে এই গুরু-শিষ্যের আলোচনা! কখন সে খগেন মাস্টারকে বলবে মাধুর কথা। মানুষটা ডুবে আছে ওই একটা রাজা আর তার জাতের পরিচয় নিয়ে। এদিকে যে নিজের ভালবাসার মানুষের রাজত্বে ঘোর দুর্যোগ ঘনিয়েছে তার খবর কখন নেবে! লোখা খবরটা দেবেই বা কখন! কিন্তু সেদিকে খগেন মাস্টার কথা থামায় না,
– এখানে আরও একটা বিষয় বলবার আছে স্যার। বেশির ভাগ ইতিহাস রচয়িতারা জানাচ্ছেন শোভাসিংহ বহিরাগত এবং রাজপুত। রাজার রমণী লিপ্সা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু শোভা সিংহের চরিত্র বলছে নারীর প্রতি তীব্র কামাতুর ছিলেন তিনি। কবি রামশ্বরের স্ত্রী সুমিত্রা এবং বর্ধমান রাজ চন্দ্রাবতীর প্রতি কাম পিপাসা রাজপুত চরিত্রের সঙ্গে সহজে মেলে না। ফলে খটকা একটা থেকেই যায়,স্যার।
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments