শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৪ / সালেহা খাতুন
ঐ ১৯৯৫- য়েই অধ্যাপক হিমবন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন। তরুণ অধ্যাপক। তাঁর ক্লাসে শিখলাম পার্টিশিপেটরি লার্নিং। “হাঁসুলী বাঁকের উপকথা” পড়াতেন তিনি। আমাদেরই তেত্রিশজনকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উপন্যাসটিকে বিচার করতে হতো। তেত্রিশজন বলছি একারণে যে এম.এ. তে আমাদের ব্যাচে তেত্রিশজন ‘উপন্যাস ও ছোটোগল্প’ স্পেশাল পেপার নিয়েছিলাম। এম.এ. তে আমাদের ব্যাচে গোল্ড মেডেল পেয়েছিল অয়ন্তিকা। অয়ন্তিকাও এই স্পেশাল পেপার নেয়। অয়ন্তিকা বেশিরভাগ দিন পাঞ্জাবী পরতো। কী ভালো যে লাগতো। নাটক অভিনয় সবকিছুতে পারদর্শী। দূরদর্শন, আকাশবাণী, এফ.এম.-এ ওকে দেখতে শুনতে পাই। এখন নব বালিগঞ্জ মহাবিদ্যালয়ের প্রিন্সিপাল পদে আসীন। অভিনয় লেখালেখি পড়াশোনা সমানতালে চলে ওর। ওর লেখা শ্রুতিনাটকের বই ওর হাত থেকেই উপহার হিসেবে পেয়েছি। কৃতি বন্ধুরা সত্যিই অহংকার বাড়িয়ে দেয়। সেদিন একটা চ্যানেলে ওকে আত্মজীবনী লেখার কথা বলতে ও সুন্দর বলেছিল, ‘না লিখবো না। সব কথা সবাইকে বলবো না। কিছু কথা থাক না আমার নিজস্ব কথা হয়ে।’ আর আমি কী জালে যে নিজেকে জড়িয়ে ফেললাম!!
হা হতোস্মি!!
যাক গে, হিমবন্তবাবু জীবনানন্দের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতা আমাদের পড়াতে গিয়ে আত্মহত্যার এমন মাহাত্ম্য আলোচনা করেছিলেন যে আমরা সবাই জীবন থেকে পালাতে চেয়েছিলাম। সে এক মজার ঘটনা। তিনি বলেছিলেন যারা সূক্ষ্মবুদ্ধির অধিকারী তারাই একমাত্র এটা করতে পারে। স্থূলবুদ্ধির মানুষের কম্ম এটি নয়। আমাদের অপমান করা! আমরা মোটাবুদ্ধির অধিকারী! কিন্তু আমাদের তো কোনো দুঃখ নেই, না পাওয়া নেই, প্রেমে ব্যর্থ হই নি, তাহলে মরবো কেন? সূক্ষ্মবুদ্ধির প্রমাণ দিতে?
🍂
চলো দুঃখ খুঁজি। ঐ যে রোজ দে’জ-এ যেতাম। আর সব বই কেনার সামর্থ্য থাকতো না। তার উপর এক জীবনে সব বই পড়তে পারব না। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমস্ত রচনাবলী তখনও পড়া হয় নি। একটি জোরদার কারণ রূপে এটিকে দাঁড় করানো গেল। পালাবার উপায় ঠিক করা হলো হাওড়া ব্রিজ থেকে নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়া। সময় বাঁচানোর জন্য কলেজ স্ট্রিট থেকে হেঁটেই হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে আসতাম আমরা। একদিন ব্রিজের ধারে উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত দাঁড়িয়ে পড়া। ব্রিজে থাকা ট্রাফিক পুলিশকে দেখে সরে আসা আর বেঁচে থাকা। আর পরবর্তী তিরিশ বছরে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু নন মিত্র ঘোষ নন্দী রায় চক্রবর্তী মুখোপাধ্যায় চট্টোপাধ্যায় গাঙ্গুলি সিংহ ত্রিপাঠি সেনগুপ্ত বসু দেব দেবী কত কিছু যে পড়ে ফেললাম! মধুর তোমার শেষ যে না পাই।
বই নিয়ে কত আজগুবি বায়না যে ধরেছি! একবার হাওড়া স্টেশনে টিকিট চেকারের হাতে পড়লাম। তখন কোয়ার্টারলি টিকিট কাটতাম। ইউনিভার্সিটি থেকে কনসেশন নিয়ে। তাড়াহুড়োয় খেয়াল নেই যে দুদিন আগে টিকিট শেষ হয়ে গেছে। চেকার ফাইন চাইতে উল্টে আমি তাঁকে বললাম তিন হাজার টাকা দিন আমি রবীন্দ্র রচনাবলী কিনবো। গোঁফে গোঁফে হাসলেও তিনি কিন্তু ছাড়েন নি।
বই ও বন্ধু
একবার শখ হলো ট্রাফিক পুলিশকে চিমটি কাটার। বাঁদরামো আর কাকে বলে?কলেজ স্ট্রিট থেকে এম জি রোড বরাবর সমস্ত ক্রসিংয়ে সে চেষ্টা চললো। সেন্ট্রাল অ্যাভেনু, মেছুয়া,চিৎপুর, বড়োবাজার সব পেরিয়ে এসে হাওড়া ব্রিজের একটি থামের পাশে একজনকে পেলাম। চিমটি নয় শুধুমাত্র তাঁর হস্ত স্পর্শ করে খেয়াল পূরণ হলো।
মাঝে মাঝেই কলেজ স্ট্রিট মোড় থেকে ট্রামে চড়ে হাওড়া ব্রিজের কাছাকাছি বড়োবাজারে এসে আমরা নামতাম। খ্যাপামির নেশা তখন তুঙ্গে। কন্ডাক্টর টিকিট কাটতে বলতেই দুহাত জড়ো করে মাফ চাইলাম আমি তনুজা আমরা আরো অনেকে। তিনি হাসি গোপন করতে পাদানিতে চলে গেলেন। ভিক্ষে চাইলে অনেকে দিতে না পারলে ঠিক যেমনটি করে তেমনটিই আমরা করেছিলাম। না বন্ধু এখানেও রেহাই পাই নি। ভবি ভোলবার নয় কথাটি কি আর এমনি সৃষ্টি হয়েছে? কিছুক্ষণ পরে ভাড়া তিনি নিলেনই।
আমাদের আর এক রুমা বন্ধু থাকতো দাশনগরে। ঠেলাগাড়িতে যখন ভাঙা বিস্কুটের পাহাড় নিয়ে যেতো বড়োবাজারের উপর দিয়ে ওর ভীষণ ইচ্ছে করতো একমুঠো বিস্কুট তুলে খেয়ে নেবে। সে ইচ্ছেও আমরা পূরণ করেছি। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলি ছিল নানান ইচ্ছেপূরণের এক অনন্য অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ।
(ক্রমশ)
সংগ্রহ করতে পারেন 👇
0 Comments