জ্বলদর্চি

কুমড়া /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ১৩
কুমড়া
                              
ভাস্করব্রত পতি

'কুমড়ো ফুলে ফুলে 
নুয়ে পরেছে লতাটা, 
সজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা,
আর আমি ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।
খোকা তুই কবে আসবি?
কবে ছুটি?
চিঠিটা তার পকেটে ছিল ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।
মাগো, ওরা বলে সবার কথা কেড়ে নেবে।
তোমার কোলে শুয়ে গল্প শুনতে দেবে না।
বলো, মা, তাই কি হয়?
তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।
তোমার জনে কথার ঝুরি নিয়ে তবেই না বাড়ি ফিরবো।ল‍হ্মী মা, রাগ করো না, মাত্রতো আর কটা দিন'।
    (মাগো ওরা বলে, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ) 

বইতাল বা কুমড়াকে উদ্ভিদবিদ্যার পরিভাষায় বলা হয় BENINCASA CERIFERA। চালকুমড়া বা জালিকুমড়া হল Benincasa গণভুক্ত। এটি সবুজ রঙের হয়। তবে পরবর্তীতে সাদা ধবধবে রঙের হয়। বর্ষা আসার আগের মুহূর্ত তথা প্রাবৃট কালে কুমড়োর বীজ মাটিতে পোঁতা হয়। এদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে বাগানের মাচা বা বাড়ির চাল। ফলে চলতি নাম হয় ছাঁচি কুমড়া বা চালকুমড়া। আয়ুর্বেদিক ভাষায় বলা হয় 'ফলশাক'। যেহেতু এর পর্ব থেকেই ফল জন্মায় তাই বলা হয় পর্বফলা। হিন্দিভাষী এলাকায় বলে পেঠা বা ভতুয়া। বিজ্ঞানসম্মত নাম Benincasa hispida (Thunb)। 
কুমড়া ফুল

কুমড়াকে গুজরাটিতে ভুরুং, কোলুং, ওড়িয়াতে কখারু, পানিকখারু, মারাঠিতে ভোঁপলা, কোহঠঠা, সংস্কৃতে কুষ্মান্ড, হিন্দিতে কদু, কোঢ়ী, কুন্তরা এবং কোহড়া বলে। কুমড়া বর্গের (কিউকারবিটেসী) গাছ এই কুমড়া, বইতাল এবং লাউ। মিষ্টিকুমড়াকে ইংরেজিতে বলে gourd & squash, pumpkin এবং winter squash। এদের বিজ্ঞানসম্মত নাম --  Cucurbita pepo, Cucurbita moschata,  Cucurbita alba, Cucurbita mixta, Cucurbita maxima। 

সাধারনত তিন ধরনের কুমড়া পাই। সেগুলি হল --
১) দেশিকুমড়া। বিজ্ঞানসম্মত নাম Cucarbita maxima। হলুদ রঙের ফুল, সাদা রঙের গোলাকার লম্বা ফল। সংস্কৃতে শ্বেতকুষ্মাণ্ড এবং পুষ্পফল বলা হয়। এই চালকুমড়া, জালিকুমড়া বা ছাঁচি কুমড়াকে ইংরেজিতে বলে Chinese Preserving Melon, Winter gourd, Winter Melon, Ash Gourd, White Gourd, Wax Gourd, Tallow Gourd।  বিজ্ঞানসম্মত নাম Benincasa hispida।
২) ভুঁইকুমড়া। বিজ্ঞানসম্মত নাম Ipomoea paniculata। সংস্কৃতে ভূমিকুষ্মাণ্ড, বিদারী, ক্ষীরবিদারী, হিন্দিতে ভুঁইকখারু, বিলাইখন্দ বলে। 
৩) বিলাতি কুমড়া বা মিষ্টি কুমড়া বা গুড়কুমড়া। বিজ্ঞানসম্মত নাম Cucurbita maxima। সংস্কৃতে একে বলে পীতকুষ্মাণ্ড। কোচবিহারের লোকেরা বলে ঘিত্বকুষ্মাণ্ড। 
চালকুমড়া

অপরদিকে লাউ তথা অলাবুর বিজ্ঞানসম্মত নাম Lagenaria valgaris seringe।  জসীমউদ্দীনের 'সোজন বাদিয়ার ঘাট'এও পাই লাউ গাছের উপস্থিতি --
'লাউয়ের ডগায় লাউয়ের পাতা, রৌদ্রে উনে যায়, 
সেই লতারি সোহাগ যেন মাখা তারি গায়'। 
একে তামিলে সােরাক্কই, তেলুগুতে সােরাকয়া, হিন্দিতে কটুতুম্বি (স্বাদে তেতো বলে), কদু, সংস্কৃতে তুম্বী, ইক্ষাকু, অলাবু, মারাঠীতে গোরবতুম্বী এবং ইংরেজিতে Bottle gourd বলে। মিস্টি লাউ ও কটুলাউ এই দু ধরনের লাউ মেলে। একে দীর্ঘবৃত্তফলা, মহাফলা, ক্ষীরিণী, গোরক্ষীও বলে। প্রাচীন বনৌষধির গ্রন্থ 'রাজ নিঘন্টু'তে গোরক্ষতুম্বী, ক্ষীরতুম্বী নামকরণ করা হয়েছে। আর লাউতুম্বী দিয়ে তৈরি করা হয় একতারা। হলুদ হলুদ ফুল হয় কুমড়ার। পাতাগুলো খসখসে। লতানো গাছ। আকর্ষ দিয়ে জড়িয়ে কোনো অবলম্বন ধরে বেয়ে চলে। 

ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের জন্ম হয়েছিল কুষ্মাণ্ড রূপে। সেই কাহিনীকে সামনে রেখেই প্রবাদ 'অকাল কুষ্মাণ্ড'। আর আমরা অপদার্থ এবং অকর্মণ্য ব্যক্তিকে প্রায়শই বলে থাকি 'অকাল কুষ্মাণ্ড'। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখায় আছে, 'নাহি কি জ্ঞানকাণ্ড? অকালকুষ্মাণ্ড'। গিরিশচন্দ্রের 'বলিদান'তে আছে, 'সে পত্র ভেঙে এই অকালকুষ্মাণ্ডকে মেয়ে দেব?' তেমনি 'সধবার একাদশী'তেও রয়েছে এই প্রবাদের উপস্থিতি। এখানে আছে, 'বাবা, তুমি বোকারাম অকালকুষ্মাণ্ড, তুমি বেশ্যার সম্পত্তির অংশ পাবে? এই কুষ্মাণ্ড নিয়ে আরও একটি প্রবাদ রয়েছে বাংলা সাহিত্যে। সংস্কৃত শ্লোকের 'চালে ফলতি কুষ্মাণ্ডং হরিমাতুর্গলে ব্যাথা' থেকে বাংলায় হয়েছে 'চালে ফলে কুষ্মাণ্ড, হরির মার গলগণ্ড'। কুষ্মাণ্ড বা কুমড়া বা কুমড়ো যদি দা বা কাস্তেকে আক্রমণ করে, তবে সে নিজেই কাটা পড়ে! তা নিয়েই বাংলার প্রবাদে পাই 'দায়ে কাটা কুমড়ো যেমন'। দাশু রায়ের লেখায় পাই 'এ বেটী সামান্য নয়, মারতে গেলে মরতে হয়, দায়ে যেমন কুমড়ার বিনাশ'। আবার ভারতচন্দ্র রায় লিখেছেন, ' এ কি কথা বিপরীত, দুই মতে বিপরীত, দায়ে কাটা কুমড়া যেমন'। এরকমই আরেকটি প্রবাদ রয়েছে -- 'দা কুমড়া সম্পর্ক' এবং 'খাড়া কুমড়ায় বিবাদ'। গ্রামাঞ্চলে কুমড়ার অঙ্কুর অবস্থায় আঙুল দিয়ে দেখালে নাকি গাছ শুকিয়ে যায়। তা নিয়ে প্রবাদে পাই 'কুমড়োর জালি বা জাওয়ালি'। আরেকটি প্রবাদ বেশ জনপ্রিয়, তা হল 'কুমড়োকাটা বটঠাকুর'। অন্য আনাজের চেয়ে লাউ কোটা বেশি সহজ। তা নিয়ে প্রবাদে ব্যবহৃত হয় 'অকাজে বউড়ি দড়, লাউ কুটতে খরতর', 'অন্ধকারে লাউ কোটা', 'আর কাজে নয়কো দড়, লাউ কুটতে ফালা দেন', 'ঠাকরুন গো ঠাকরুন, তুমি কোটো চালতা, আমি কুটি লাউ, আর গতরখাকি বউকে বলে -- ধান কুটতে যাউ'। 

হেঁসেলে কুমড়ার ব্যবহার সর্বজনবিদিত। প্রাচীন সাহিত্যেও তখনকার দিনের খাদ্য বর্ণনায় কুমড়ার ঠাঁই ছিল রান্নাঘরে। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়ের 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে রয়েছে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের হেঁসেলে কুমড়ার উপস্থিতি -- 'কাঁটালের বীজ রান্ধে চিনি রসে বুড়া / তিল পিটালিতে লাউ বার্ত্তাকু কুমড়া'। দুধ লাউ এখনও অনেকের রসুই ঘরে উৎপাদিত হতে দেখা যায়। চৈতন্যদেবের জন্য শ্রীক্ষেত্রে সার্বভৌম ভট্টাচার্য যে রান্না করেছিলেন তাতে এই দুধ কুমড়ার পদও ছিল। 'চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থে কৃষ্ণদাস কবিরাজ তা উল্লেখ করেছেন -- 'দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড, বেশারী নাফরা / মোচা ঘন্ট, মোচা ভাজা, বিবিধ শাকেরা / ফুল বড়ি ফল মূলে বিবিধ প্রকার / বৃদ্ধ কুষ্মাণ্ড বড়ির ব্যঞ্জন অপার'। আবার দ্বিজ বংশীদাসের 'মনসামঙ্গল'তেও রয়েছে কুমড়ার রান্না -- 'বেত আগ পলিয়া চুঁচরা মৎস্য দিয়া / শক্ত ব্যঞ্জন রান্ধে আদা বাটিয়া / পাবদা মৎস্য দিয়া রান্ধে নালিতার ঝোল / পুরান কুমড়া দিয়া রোহিতের কোল'। 

বড় বড় খাওয়ান বাড়িতে কুমড়োর ছক্কা বা কুমড়োর ঘন্ট বা কুমড়োর ভস্ম সমধিক জনপ্রিয় খাদ্যরসিকদের কাছে। কুমড়ো ফুলের বড়া যে একবার খেয়েছে সে কখনো ভোলেনা। কুমড়োর বিচির খোসা ছাড়িয়ে অল্প তেলে ভেজে খাওয়ার মজাই আলাদা। আর কুমড়োয় বেসন মাখিয়ে বেগুনির মতো ভাজা কিংবা শুধু কুমড়োর ভাজার স্বাদ অতুলনীয় বললেও কম বলা হয়। পোস্ত বাটা কুমড়ার পাতায় মুড়ে অল্প আঁচে ভেজে খাওয়ার স্বাদ অনেকেই জানেনা এখনও। চালকুমড়া দিয়ে ঘরোয়া বিচাবড়ি বানান গ্রামাঞ্চলের মা ঝিয়েরা। চিনির রসে চালকুমড়ার ভেতরের অংশ ডুবিয়ে রেখে বানানো হয় সাদা মোরব্বা। মিস্টি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

অম্লরোগ, পিত্তশ্লেষ্মা বিকার, অর্শোবিকার, পায়োরিয়া, শ্বেতী, ছানি, মেচেতা, ছুলি, দেহের প্রদাহের নিরাময়ে লাউ খুব উপকারী। পেট ফাঁপ, রক্ত পিত্ত, যক্ষ্মা, কামজ উন্মাদনা, পেটের যন্ত্রনা, প্লুরিসি, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্রিমিনাশে কুমড়ার ব্যবহার করে থাকেন বৈদ্যকরা। 

কুমড়া দেখতে ঢাউস আকারের। তাই মোটা বা স্থূল দেহের অকর্মণ্য লোকের সাথে তুলনা টানা হয় এই কুমড়ার সঙ্গে। সুকুমার রায়ের লেখা 'কুমড়োপটাশ' নামটি আজকাল তেমন কারণেই খুব প্রচলিত এবং বহুল ব্যবহৃত হয়ে উঠেছে --
'(যদি) কুম্‌‌ড়োপটাশ ডাকে
সবাই যেন শাম্‌লা এঁটে গামলা চড়ে থাকে;
ছেঁচকি শাকের ঘণ্ট বেটে মাথায় মলম মাখে;
শক্ত ইঁটের তপ্ত ঝামা ঘষতে থাকে নাকে!      
তুচ্ছ ভেবে এসব কথা করছে যারা হেলা,      
কুম্‌‌ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা।   
দেখবে তখন কোন্‌ কথাটি কেমন করে ফলে,      
আমায় তখন দোষ দিওনা, আগেই রাখি বলে'।

🍂

Post a Comment

0 Comments