জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৭ / সালেহা খাতুন

ক্যাম্পাসের বইমেলায় যাঁর পাশে দাঁড়িয়ে বই দেখে এক অনন্য অনুভূতি হয়।

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৭ / সালেহা খাতুন 

সময় সমাজ বয়স সম্পর্কের ইক্যুয়েশন অনেক কিছু বদলেছে ঠিকই কিন্তু বইকেন্দ্রিক আমিটা দেখি এখনও ভেতরে ভেতরে দুবাহু তুলে নৃত্য করছে তার সব গল্প উজাড় করে দেওয়ার জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত বইগুলিকে নিয়ে কলেজস্ট্রিট ক্যাম্পাসে আমাদের সময়ে একটি বইমেলার আয়োজন করা হয়। ক্লাস থেকে ছুটলাম। অনেক বই দেখলাম। কিনলাম। সবথেকে বড়ো কথা বিহারীলাল চক্রবর্তীর রচনাসমগ্র কিনলাম মাত্র দু’টাকায়। জীর্ণ হয়ে গেলেও সে বই আমার কাছে এখনও আছে। প্রো-ভাইস চ্যান্সেলারের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে একসঙ্গে বই দেখছি। সে অনুভূতি প্রকাশের ভাষা পাচ্ছি না। 

তখন প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলার ছিলেন ভারতী রায়। তিনিই প্রথম মহিলা যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (১৯৮৮-১৯৯৫) হয়েছিলেন। রাজ্যসভার সদস্যও(১৯৯৬-২০০২) ছিলেন। নারীর ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত যৌথ সংসদীয় কমিটির সদস্যও ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন স্টাডিজ রিসার্চ সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকও বটে। অপূর্ব সুষমামণ্ডিত তাঁর দেহাবয়ব। বিদ্যার এক পরাকাষ্ঠা। কত পড়াশোনা করেছেন। লিখেছেনও প্রচুর। মূলত ইতিহাসের অধ্যাপিকা। তাঁর বিভিন্ন বইয়ের মধ্যে তাঁর আত্মজীবনী “কন্যা:পাঁচ প্রজন্মের কাহিনি” অনন্য। এছাড়া তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বইগুলি হলো  - “মহাকাব্যে অনন্যা(দ্বাদশ উপাখ্যান)”, “নারী ও পরিবার : বামাবোধিনী”, “ ইতিহাসের সীমানা থেকে : ঔপনিবেশিক ভারতে নারীর প্রবন্ধ”, “ ঔপনিবেশিক বাংলার প্রাথমিক নারীবাদী : সরলা দেবী চৌধুরানী এবং বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন” প্রভৃতি।

জগদীশদার চিপ স্টোরও ছিল আমাদের বই সংগ্রহের অন্যতম জায়গা। আর ছিলেন মধুদা ও সুশান্তদা। আমাদের সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ম্যানস্ক্রিপ্ট লাইব্রেরি ছিল। এঁরা বই দেওয়া নেওয়া করতেন। মধুদা আবার মাঝে মাঝে আমার বিয়ের জন্য পাত্রের সন্ধান দিতেন। এ ব্যাপারে মমতাজকে দিয়ে একটি ইনল্যান্ড লেটারও পাঠান। কোনো এক কলেজের অধ্যাপককে পাত্র রূপে নির্বাচন করেন। কিন্তু আমার লক্ষ তো বই, বিয়ে নয়। অতএব সে যোগাযোগ বিফলে গেল। ফেসবুকের দৌলতে বর্তমানে অবশ্য সেই না দেখা পাত্রকে দেখেছি।

উনিশশো চুরাশিতে তো বাবা ইসলামিক ইতিহাসে এম.এ. করেন। আর চুরানব্বই-ছিয়ানব্বইয়ে আমি এম.এ. পড়তে এসে বাবার সার্টিফিকেট তুলি। অফিসার যাঁরা ছিলেন তাঁরা ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করেন। এরকম বিভিন্ন কাজ করতে করতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক দপ্তরগুলো সব ঘোরা হয়ে যায়। আমাদের মমতাজের বহু চেনা লোকজন ঐ সব দপ্তরে কাজ করতেন। ওর সঙ্গেও মাঝে মাঝে সেইসব জায়গায় হানা দিতাম।

🍂

একবার রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে ‘রক্তকরবী’ নাটক সেন্টিনারি হলে মঞ্চস্থ করে আমাদের বন্ধুরা। টুনু হয়েছিল নন্দিনী, দেবাশিস, আশুতোষ পার্থ আরো অনেকে অভিনয় করে। আমরা ছিলাম দর্শক। বর্তমানে এরা প্রত্যেকেই স্বমহিমায় মহিমান্বিত। প্রথম নাটক দেখা মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়েই হয় । মেঘনাদ ভট্টাচার্য্যের “দায়বদ্ধ”,“বাসভূমি” দেখি সেন্টিনারি হলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পরিষদ এর আয়োজন করে। ‘দায়বদ্ধ’-এ লরির ড্রাইভারের চরিত্রে মেঘনাদ ভট্টাচার্য্যের অসামান্য অভিনয় মুগ্ধতার পরশ আজো দিয়ে যায়। অভিনয় করতেই করতেই দর্শকদের সঙ্গে তাঁর ইন্টারেকশানে আমরা বুঝতেই পারি নি এটা নাটকের বাইরের সংলাপ। সায়ক নাট্যগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। তাঁর অভিনীত বহু নাটক এবং চলচ্চিত্রের কথা ওয়াকিবহাল মাত্রেই জানেন। আমরা তাঁকে সেই প্রথম চিনি।
যাঁর অসামান্য অভিনয় দেখেছিলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী হলে।

ঐ শতবার্ষিকী হলে আরো কত গুণী মানুষকে যে দেখেছি! একবার ইন্দ্রাণী সেন গান শোনাতে এলেন। হলে সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম সেই অনুষ্ঠান। অমৃত সিং অরোরা এলেন। রূপসী দোঁহাই তোমারে ভেসে গেলাম আমরা।

আর হাড়ে হাড়ে চিনি বর্ষা অথবা বৃষ্টির দিনের কলকাতার হাল হকিকত। বাস গুলো নৌকার মতো ভাসতে ভাসতে কলেজ স্ট্রিট মোড়ে আমাদের নামিয়ে দিলে কোমর সমান জমা জল অতিক্রম করে ক্যাম্পাসে পৌঁছে ক্লাসে যেতাম। একবার বিমলবাবু অর্থাৎ অধ্যাপক বিমল কুমার মুখোপাধ্যায়কেও দেখেছিলাম এই কোমর সমান জল পেরিয়ে আমাদের আগে আগে যেতে। শিক্ষক শিক্ষার্থী দু’পক্ষই আমরা ক্লাসের ব্যাপারে সিরিয়াস ছিলাম। বিমলবাবুর রবীন্দ্র নন্দনতত্ত্ব এবং সাহিত্য বিবেক বই দুটি আমরা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে পড়তাম। তিনি আমাদের অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স পড়াতেন। তিনটে সেকশনেই সে ক্লাস আমরা করতাম। পোয়েটিক্স পড়ে বুঝে নিজে লিখে স্যারকে দেখতে দিলে অত্যন্ত যত্ন নিয়ে তিনি দেখে দিতেন। 

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments