জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব-- ৫ /স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব-- ৫


স্বপন কুমার দে

বাড়ি থেকে সম্পূরকের অফিস খুব দূরে নয়। বাইকে  বারো মিনিট আর অন্য কোনো বাহনে গেলে একটু বেশি সময় লাগে। বেশিরভাগ সময়ই বাইকে যায়, কখনও কখনও অন্য কিছুতেও যায়। কারনটা ভিন্ন। ফেরার সময় রুপসা সঙ্গে থাকে, তখন সময়টাকে উপভোগ করতে চায়,রুপসার পাশে পাশে হাঁটতে চায়। ফুচকা স্টল, ফার্স্ট ফুড কিংবা কফি শপ প্রায়দিনই কিছুটা সময় কেটে যায়।

সম্পূরক অফিসে পৌঁছেই দেখল, রূপসা আজ আসেনি,তার টেবিলটা ফাঁকা। অ্যাটেনডেন্সের পর্ব চুকিয়ে ফোনটায় রিং করল।ওপার থেকে সুরেলা কণ্ঠ সম্পূরকের কানে মধু ঢেলে দিল,"  হ্যালো...ও..ও..। কী হলো?"
" আজ আসবে না?"
ওপার থেকে, " না,আজ আমার একটু কাজ আছে।"
" আগে বলনি তো?"
" কেন, তুমিও কি ছুটি নিতে?"
" না, তা হয়তো নিতাম না।তবে..."
" তবে?"
" আসলে, এখানে এসে আগে তো তোমার মুখটা দেখতে  পাই। আজ সেটা হয়নি বলেই খটকা লাগল।"
" আহা রে! কী মিষ্টি সোনা আমার! কজে মন দাও। আমি আজ,কাল - দু'দিন অফিস যাচ্ছি না।মায়ের সঙ্গে একবার মামার বাড়ি যেতে হবে। সেখানে বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান সেরে কাল সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরবো। ঠিক আছে। মন খারাপ করো না।টা টা।"
" এইরকম প্ল্যান হয়েছে, আমাকে আগে জানাওনি তো?"
" আরে বাবা,একেবারে শেষ মুহূর্তে আমার যাওয়া ঠিক হলো। অফিসে ছুটিও পেয়ে গেলাম। রাগ করো না প্লিজ। পরের বার আর এরকম হবে না।ফোনটা রাখি? আমাদের এবার বেরোতে হবে। টা টা ।"

ফোনটা কেটে  সম্পূরক দেখল তার টেবিলের সামনে দু'জন সাক্ষাতপ্রার্থী দাঁড়িয়ে আছে।এরপর তাকে কাজে ডুবে যেতে হবে। কথা বলবার ফুরসত নেই। দিনে দিনে কাজের চাপ প্রচুর বাড়ছে। কর্মীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। অথচ নতুন নতুন সরকারি প্রকল্প ঘোষণা হচ্ছে। সেগুলোকে বাস্তব রূপ দিচ্ছে যারা, তাদের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়।অনেক সময় অফিসের কাজ বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। শরীর ও মনে অবসাদ আসে।সম্পূরকের মধ্যে কাজে ফাঁকি দেওয়ার প্রবনতা নেই। রূপসাও তাই। প্রতিদিনের কাজ যথাসম্ভব সেদিনেই শেষ করার চেষ্টা করে কিন্তু সবসময় সেটা সম্ভব হয় না।কিংবা কোনো না কোনো বাধা, ওপরওয়ালার নির্দেশ অনেক কিছুকে থামিয়ে দেয়।সাধারণ মানুষ সবটা দেখতে পায় না।তাই তারা উপর উপর বিচার করে।
🍂

সম্পূরকদের অফিসে কর্মচারীর সংখ্যা চল্লিশের কাছাকছি। পুরুষ কর্মীর সংখ্যা বেশি, সাতজন মহিলা। রূপসা সম্পূরকের কলিগ।এখানেই পরিচয়,ঘনিষ্ঠতা এবং প্রেম। পূর্ব পরিচয় ছিল না।কখনও কখনও এমনই হয়।সবকিছু বলে কয়ে হয় না।মনের অজান্তে নীরবে ভালোবাসার অনুভূতিগুলো পুষ্ট হতে থাকে। অপরিকল্পিত ইন্ধন প্রদীপের সলতেয় হঠাৎ যেন আগুন ধরিয়ে দেয়।তখন সেই প্রজ্জ্বলিত আলোকশিখায় দীপ্ত হয়ে ওঠে প্রেমিক হৃদয়।তখন সে কারণ বোঝে না,গভীরতা বোঝে না,রং দেখে না,গোত্র দেখে না। অনাস্বাদিত পুলকে ভেসে যায়।ছাত্রজীবনে সম্পূরক পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু জানতে চায় নি। কিন্তু এখন জীবনের অনাবিস্কৃত দিকটির সন্ধান পায়। তাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো ক্ষমতাই ছিল না তার।

শুরুটাও হয়েছিল অদ্ভূত ভাবে। দুজনেরই চাকরির বয়স তখন কমবেশি এক বছর। সেই সময় বড়সাহেব খুব রসিক মানুষ ছিলেন। তাঁরই পরিকল্পনা মত এক উইক এন্ডে একটি পিকনিকের আয়োজন করা হয়।ঠিক হয়,শহর ছাড়িয়ে পাহাড়,বন আর ঝিলে ঘেরা একটি জায়গায় যাওয়া হবে, অফিস থেকে পঞ্চাশ ষাট কিমি দূরে। সকাল ছ'টায় বেরোনো হবে আর সন্ধ্যে সাতটা আটটার মধ্যেই ফেরা হবে।সেই মতো সমস্ত আয়োজনও করা হয়েছিল।

সকাল থেকে সবাই উৎসবের মেজাজে। চব্বিশ জন পুরুষ এবং সাতজন মহিলা কর্মী নিয়ে গাড়ি ছুটল পিকনিকে। গল্প, গান, হাসি,আড্ডা,ঘোরাঘুরির সাথে খেলাধূলা চলল। সময়ে সময়ে খাওয়া দাওয়া।

রান্না তখনও কমপ্লিট হয়নি। সবাই বসে গল্প গুজবে মত্ত। এমন সময় বড়সাহেব বললেন, " দেখুন, আমরা এখানে বেড়াতে এসেছি।এখানে কেউ কারো বস্ নই, প্রত্যেকেই সমান। তাই আমি ভাবছি,একটা মজার খেলা খেললে কেমন হয়? একটা বক্সে হাতে লেখা কয়েকটা কাগজের মোড়ক থাকবে।তাতে আলাদা টপিকস্ থাকবে। সবাইকে এক এক করে যে কোনো একটি কাগজ তুলতে হবে।তাতে যা লেখা থাকবে সেই অনুযায়ী অভিনয় করে দেখাতে হবে। মনে রাখবেন, এটা শুধুমাত্র মজার খেলা। কেউ সেন্টিমেন্ট দেখাবেন না,প্লিজ। কেউ কেউ মৃদু আপত্তি করল, কেউ উৎসাহিত হল।
" ব্যাপারটা খুব ইন্টারেস্টিং ", বলে আপাত নিরীহ অখিলবাবু নড়ে চড়ে বসলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যবস্থা হয়ে গেল। অয়ন আর কান্তি দু'জন মিলে কাগজে লিখে মোড়ক করে একটা  ছোট বক্সে রাখল।এক এক করে ডাক পড়ল সবার। খেলা শুরু হল বড়সাহেবকে দিয়ে। কাগজে লেখা বেরোল,'মেনি বেড়ালের মত পিছন ফিরে মিউ মিউ করে ডাকতে হবে।'
বড়সাহেবের এমন অসহায় মুখ কেউ কোনোদিন দেখেনি।দারুণভাবে তিনি সেটা করে দেখালেন। সবাই হাততালি দিল।
এরপর নীলিমাদির পালা।নীলিমাদির কাগজে লেখা ছিল, 'শিং গজানো গরুর মতো গুঁতোতে হবে'।নীলিমাদি তো তখন যাকে পারছে গুঁতোচ্ছে। সবাই তখন খেলা ছেড়ে পালাবার উপক্রম। বিভাসের অভিনয় ছিল,কতক্ষণ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
রিটায়ারমেন্টের আর দু'বছর বাকি আছে অখিলবাবুর। তাকে গানের তালে তালে লুঙ্গি ড্যান্স নাচতে হল।

এরকমভাবে চলতে চলতে সম্পূরকের পালা এল।তার কাগজে লেখা ছিল, যেকোনো একজনকে প্রেম নিবেদন করতে হবে। প্রথমে হাসির রোল উঠলেও,মেয়েরা না না করতে লাগল। কিন্তু খেলার নিয়ম তো পাল্টানো যাবে না। সম্পূরকের অবস্থা দেখে এবার মেয়েরা তাকে উৎসাহ দিতে লাগল। বড়সাহেব বলে চলেছেন, " সম্পূরক, ইটস্ এ গেম।ভয় পেলে চলবে না। চালিয়ে যাও।"
সম্পূরক বেছে নিল রূপসাকে। কাছেই ছিল বুনো ফুল, সেটাই তুলে নিল। এক হাঁটু গেড়ে বসল,রূপসার পায়ের তলায়।তারপর দক্ষ অভিনেতার ভঙ্গিতে ডান হাতের পুষ্পগুচ্ছ রূপসার দিকে এগিয়ে দিয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করল। একদৃষ্টে চেয়ে রইল রূপসার দিকে, পলক পড়ছিল না। সকলে বাহবা দিল।

এটা ছিল অভিনয়। কিন্তু অভিনয় কখনও কখনও সত্যি হয়ে যায়। বিশেষত, যারা এ বিষয়ে পেশাদার নয়, তাদের মনে সেই অভিনয়ের রেশ রয়ে যায়। সম্পূরক এবং রূপসার মনের ভেতরেও এই ঘটনার স্মৃতি বারবার জাগতে থাকে। ভালোলাগার একটা আবেশ তৈরি হয়। ভালোলাগার নিবিড় অনুভূতিগুলিই জমতে জমতে ভালোবাসার রূপ নেয়।

অফিসেও নিত্য নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ, অনুরাগ চলতে চলতে একদিন 'প্রেম ' নামক বস্তুটি উভয়ের মধ্যেই চলে আসে, সেটা অফিসের সবাই জানে, এমনকি,দুই পরিবারেও। অবশ্য বিয়ের ব্যাপারে কোনো পক্ষই এখনও পর্যন্ত কিছু বলেনি। কিন্তু সেটা অবশ্যাম্ভাবী। (ক্রমশ)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments