জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোক গল্প-- ইন্দোনেশিয়া (দ.-পূ. এশিয়া)এক দুঃখিনী মেয়ের গল্প /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস

দূরদেশের লোক গল্প-- ইন্দোনেশিয়া (দ.-পূ. এশিয়া)
এক দুঃখিনী মেয়ের গল্প
চিন্ময় দাশ

ইন্দোনেশিয়া। আশ্চর্য সুন্দর এক দেশ। মহাসাগর, সাগর আর উপসাগরে মোড়া একটা দেশ। যেদিকে যাও, শুধু জল আর জল। মনে হবে, পুরো দেশটা জল থইথই। 
তো, সেখানে দক্ষিণ কালিমান্তানের একেবারে শেষ মাথায়, ছোট্ট একটা গ্রাম। জাভা সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আছড়ে পড়ে তার মাটিতে। মিষ্টি বাতাস বয়ে যায় বারো মাস। 
সেই গ্রামে বাস করত এক বাবা, আর বাওয়াঙ পুতিন নামে তার মেয়ে। দেখতে ভারি সুন্দর মেয়েটি। স্বভাবটিও তার তেমনি সুন্দর। বাবার ভারি আদরের মেয়ে। মা নেই, সেটা বুঝতেই দেয় না তার বাবা। ভারি আনন্দে দিন কেটে যায় দুজনের।
কিন্তু সুখের দিন কি আর সকলের দীর্ঘ হয়! পুতিনেরও হোল না। বাবার একটা কাজ জুটে গেল। নাবিকদের সাথে সহকারির কাজ। দূর দূর দ্বীপে দ্বীপে ভেসে বেড়াতে হবে। একবার বেরুলে, কতো কতো দিন পরে ফিরবে, তার নাই ঠিক।
কিন্তু বাবা যদি জলে ভেসে বেড়ায়, একা মেয়ে থাকবে কী করে ঘরে। অনেক ভেবে-চিন্তে, আবার একটি বিয়ে করে বসল তার বাবা। সেই নতুন বউয়ের আবার একটি মেয়েও আছে। নাম বাওয়াঙ মেরাহ। বয়সে পুতিনের চেয়ে একটু বড়ই সে। 
বয়সে যেমন বড়, স্বভাবেও একেবারে উলটো সেই মেয়ে। স্বভাবে ভারি রুষ্ট। কথায় কথায় রেগে ওঠে পুতিনের উপর। সব সময় পুতিনকে ছোট নজরে দেখে সে। তার মাটিও তেমনি। মা-হারা পুতিনের চেয়ে, নিজের মেয়ে মেরাহর ওপরেই তার বেশি আদর যত্ন।
পুতিন মেয়েটি তো স্বভাবে মিষ্টি। সব বুঝতে পারে। তবুও সব সহ্য করে সে। সৎমা আর দিদিকে সে উপযুক্ত সম্মান করে। সব হুকুম, ফরমায়েসও হাসি মুখে পালন করে যায়।
এখন সংসারের প্রায় সব কাজই পুতিনকেই করতে হয়। সে অবশ্য হাসিমুখেই করে যায় সব কাজ। একদিন ভারি সমস্যায় পড়ে গেল মেয়েটি। সৎমা আর দিদির কাপড়-জামা কাচতে নদীতে গিয়েছে পুতিন। তার ভিতর থেকে মায়ের একটি কাপড় কখন নদীর জলে ভেসে গিয়েছে, খেয়াল করতে পারেনি। কাপড়-জামা গুছিয়ে বাড়ি ফিরতে যাবে, তখন আকাশ যেন মাথায় এসে ভেঙে পড়ল। মায়ের কাপড়টা নাই। কখন নদীর জলে ভেসে গিয়েছে, কত দূর ভেসে গিয়েছে—কিছুই জানা নাই।
কাপড় না নিয়ে ঘরে ফিরলে, অনেক নির্যাতন যে আজ কপালে আছে, পুতিন সেটা খুব ভালোই জানে। তাই নদীর স্রোত ধরে কাপড় খুঁজতে খুঁজতে চলতে লাগল মেয়েটি।
কিন্তু খোঁজাই সার। কাপড়ের দেখা নাই কোথাও। চলতে চলতে কত দূর গিয়েছে। এমন সময় এক বুড়ির সাথে তার দেখা। একেবার থুত্থুরে বুড়ি। বুড়ি বলল—কী গো মেয়ে, কাপড় খুঁজতে বেরিয়েছো। তাই না? 
পুতিন খুব অবাক হয়ে বলল—হ্যাঁ, মা। কিন্তু তুমি জানলে কী করে?
--জানি নয় রে, মেয়ে। কাপড়টা ভেসে যাচ্ছিল দেখে, আমি সেটা তুলেও রেখেছি। বুড়ো মানুষ, চোখেও ভালো দেখি না। কে কখন কাপড় খুঁজতে এসে, পেরিয়ে যাবে। নিজের কাজকর্ম ফেলে, তখন থেকে তোর জন্য এই নদীর পাড়ে বসে আছি।
পুতিন তাড়াতাড়ি বলল—তুমি বসো, আমি তোমার গেরস্থালির সব কাজ করে দিচ্ছি। 
বলেই, চটপটে হাতে বুড়ির কাজ সেরে দিয়ে, বলল—এবার আমি যাই। অনেক দেরী হয়ে গেছে। মা বকাবকি করবে। তুমি আমার সৎ মায়ের কাপড়টি তুলে রেখে, আমাকে নির্যাতন থেকে বাঁচিয়েছ। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। 
--তুইও আমার অনেক উপকার করলি, বাছা। বুড়ো শরীরে সব কাজ আর ভালো করে করে উঠতে পারি না এখন। যাই হোক, একটু দাঁড়া মা। একটা উপহার দেব তোকে।
ঘর থেকে দুটো কুমড়ো নিয়ে এলো বুড়ি। বলল—একটা বড়, আর একটা ছোট। পছন্দ মতো নিজেই বেছে নে তুই। 
🍂

সাদা সরল মেয়ে পুতিন। বড়টা নিলে যে লাভ বেশি, অতশত তার মাথায় নেই। সে বলল—আমাকে ছোটটাই দাও তুমি। 
ছোট কুমড়োটাই তাকে দিল বুড়ি। দেওয়ার সময় বুড়ির মুখে যে এক্টুখানি মুচকি হাসি ফুটে উঠল, পুতিনের নজরে এলো না সেটা।
বাড়ি পৌঁছুতে দেরি হয়েছে। এক চোট বকাবকি খেতে হোল মা আর দিদির কাছে। তবে এখন এসব তার গা সওয়া হয়ে গিয়েছে পুতিনের। বাবা না ফেরা পর্যন্ত, এসব নির্যাতন তাকে সয়ে যেতে হবে—এটাই ধরে নিয়েছে মেয়েটা।
সৎ মা বলল—তোর হাতে ওটা কী? পেলি কোথায় জিনিষটা? 
সংক্ষেপে বুড়ির কাহিনীটা শুনিয়ে, পুতিন কুমড়োটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। যেই না কেটে ফেলেছে কুমড়োটা, সে এক অবাক কাণ্ড! মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড় তিনজনেরই। মুঠো মুঠো সোনা-দানা, হীরে-মুক্তো গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। গোটা ঘরটাই যেন আলোয় ঝলমল করে উঠল। 
মা-মেয়ের মাথায় তখন একটাই চিন্তা।  কী করে তারাও এমন একটা কুমড়ো পেতে পারে। দুজনে মিলে ছেঁকে ধরল পুতিনকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব কথা জেনে নিল ভালো করে। 
পরের দিন ভালো করে ভোর হয়নি তখনও। মেরাহ বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। উত্তেজনায়, লোভে সারা রাত দু’চোখের পাতা এক করেনি মেয়েটা। সেও যাবে আজ কুমড়ো জোগাড় করতে। 
কতকগুলো কাপড় নিয়ে চলল নদীর ঘাটে। ইচ্ছে করে একটা কাপড় ফেলে দিল নদীর জলে। তার পর খানিক বাদে, কাপড় খোঁজার ছলে বুড়ির বাড়িতে এসে হাজির হয়ে গেল।
সেদিনও বুড়ি কাপড়খানি জল থেকে তুলে, পাহারায় বসে আছে। মেয়েটি তাকে ধব্যবাদ দিল খানিক। বুড়ির বকেইয়া কাজ সেরে দিল তাড়াতাড়ি। মায়ের কাপড়টা নিয়ে ফিরে আসতে যাবে, বুড়ি বলল—দাঁড়াও গো, মেয়ে। আমার কাজ সেরে দিলে কতো যত্ন করে। সামান্য দুটো কুমড়ো আছে আমার। পছন্দ মতো, একটা তুমি নিয়ে যাও উপহার হিসাবে।
মেরাহ তো এটারই অপেক্ষায় ছিল। এটার লোভেই তো কাপড় খোঁজার নাটক করে যাচ্ছে সে। বুড়ি দুটো কুমড়ো নিয়ে এলে, বড়টাই নিয়ে নিল মেরাহ। ছোট কুমড়োটায় যদি এতো ধন-রত্ন থাকে, বড়টায় নিশ্চয়ই তার থেকে অনেক বেশি জিনিষ পাওয়া যাবে।
মেয়েটা বড় কুমড়োটা নিতে, বুড়ির মুখের হাসি আজ বেশ চওড়া। মেরাহর সেদিকে লক্ষ্য নাই। সে বাড়িমুখো হয়ে চলেছে। চলেছে নয়, বলা ভালো দৌড় লাগিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। কখন কুমড়োটা কাটা হবে। কখন মুঠো মুঠো সোনা-দানা বেরিয়ে আসবে ভেতর থেকে। দেরি সইছে না আর তার।
মেয়ে কখন কুমড়ো নিয়ে ফিরে আসবে, তার মা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল রাস্তার দিকে। মেয়েকে ফিরতে দেখে, তার তো আনন্দ ধরে না। পুতিন যে কুমড়ো এনেছিল, তার চেয়ে অনেকই বড়ো কুমড়ো এনেছে তার মেয়ে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠল সে। 
মেরাহ দাওয়ায় উঠতেই, মা-মেয়ে হামলে পড়ল কুমড়োটা কাটতে। কিন্তু আজ একেবারে উলটো ব্যাপার! কুমড়ো কাটতেই, মা-মেয়ের চোখ-মুখ বিস্ফারিত। ভয়ে থরথর করে কাঁপছে দুজনেই। কিলবিল করতে করতে কতকগুলো বিষাক্ত সাপ বেরিয়ে পড়েছে কুমড়োটার ভেতর থেকে। 
সাপগুলোর হিস হিস শব্দে, ভয়ে পাথর হয়ে গেছে যেন মা-মেয়ে। এক ছোবলেই জীবন শেষ হয়ে যাবে এখনই। 
পুতিন ভেতর থেকে বেরিয়েই দেখতে পেয়ে গেছে দৃশ্যটা। কিন্তু সাপগুলোকে মারতে দৌড়ে গেল না পুতিন। একটা ঝাড়ু পেয়ে গেল হাতের কাছেই। সেটা দিয়েই সরিয়ে দিতে লাগল সাপগুলোকে। যেন উঠোন সাফ করছে মেয়েটা। সাপগুলোও কোন ঝামেলা পাকালো না। সরসর করে দাওয়া থেকে উঠোনে নেমে, সরে গেল সেখান থেকে।
এবার মা-মেয়ের অবাক হওয়ার পালা। তারা দুজনে কত নির্যাতনই না করে এই মেয়েকে। অথচ সেই মেয়েই সাক্ষাৎ মরণের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল তাদের। ভাবতেই পারছে না তারা। 
পুতিন মা আর দিদিকে বলল—ছোট কুমড়োটা থেকে সোনাদানা যা পাওয়া গেছে, সেটাই আমাদের তিন জনের জন্য যথেষ্ট। বেশি লোভ করলে, তার ফল কখনও ভালো হয় না। কুমড়োটা আমি এনেছী তো কী হয়েছে? এটা আমাদের তিন জনেরই। 
সেদিন থেকে তিনজনে তারা বেশ মিলেমিশেই থাকে। বাবা ফিরে এলে, তাকে আর সমুদ্রে যেতে দিল না তারা। খেত-খামার করে বেশ সুখেই দিন কেটে যার চারজনের।
অনেক দিন পর, নিজের মায়ের মতো স্নেহ আর দিদির ভালোবাসা জুটেছে পুতিনের কপালে। আনন্দের সীমা নাই দুঃখিনী মেয়েটার।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

2 Comments