পর্ব- ৩৭
গৌতম বাড়ই
সেনাপতি অনুরের এই ছোটো প্রাসাদের মতন মহল, রাঢ় প্রদেশের একদম উত্তরভাগে। পেছন দিয়ে বয়ে গিয়েছে এক নদী। নাম তার জনজাতিদের মুখে মুখে ঘোরে দামোদর। বিস্তীর্ণ নয়। তবে বিস্তার বেশি না হলেও জলের ধারা স্পষ্ট। জলের ধারে, নদীর তীরে তখন মানুষের বসতি সকল গড়ে উঠেছে, এখনও বলতে গেলে সেই চিরন্তন ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছে। বড় বড় নগর আর শহর তো কোনও নদীর পাড়েই বা বড় হ্রদ বা জলাশয়ের ধারে । দামোদর আবার কেউ বা বলেন দামুদা। সংস্কৃতে দাম মানে আগুন, আর উদর অর্থ পেট। যে নদীর উদরে আগুন তিনি তো দামোদর। আবার দামোদর তো শ্রীকৃষ্ণের অন্য একটি নাম। আর রাঢ় অঞ্চলের জনজাতিদের দামু শব্দের অর্থ পবিত্র এবং দা শব্দে জল। পবিত্র জলের নদী। বঙ্গেশ্বরের প্রাসাদ পবিত্র তোয়া গঙ্গা নদীর পারে। মহাভারতের পিতামহ ভীষ্ম ছিলেন গঙ্গা পুত্র। আর তার প্রদেশের বাইরে তার শ্বশুরপিতা মহাশয় কলিঙ্গ রাজের রাঢ়াঞ্চলে তার অনুমতিক্রমে গড়ে উঠেছে এই ছোটোমহল। কলিঙ্গরাজের বার্ধক্যকাল চলে এসেছিল , তিনিও চাইছিলেন এই বিশাল ভূ-ভাগের রাঢ়াঞ্চলের কিছুটা বঙ্গেশ্বর দেখাশোনা, দেখভাল করুক। আজ বেশ কিছুদিন হল সুসীমা পুত্রকন্যাকে নিয়ে এখানে আছেন। বঙ্গেশ্বরের রাজ্যের প্রান্তসীমার ধারে। বঙ্গপ্রদেশ এই ভূভাগের শেষেই পূর্ব দক্ষিণ ভাগে। জঙ্গলাকীর্ণ চারধার। শুধু মহলের চারপাশটা গাছপালা কেটে পরিষ্কার করা হয়েছে। সৈন্যাধ্যক্ষের জন্য এ ছোটো রাজমহল তৈরি হয়েছে। অনুরের মতন বিশ্বাসী এই প্রবল প্রতাপশালী সেনাপতিকে পাওয়া যে কোনও রাজনের সৌভাগ্যের ব্যাপার বটে।
🍂
মহাভারতের পান্ডবেরা এই রাঢ়ের জঙ্গল পথ দিয়ে হেঁটে ফিরেছিল হস্তিনাপুরের দিকে, জনশ্রুতি বলে। যতই লোকমুখে পরিচিতি পাক পাণ্ডববর্জিত স্থান বলে। নিষণ্ন এক বিকেলের শেষ আলোতে সুসীমা নিশ্চল হয়ে বসে রয়েছিল ছোটো রাজমহলের অলিন্দে। পড়ন্ত সূর্যালোকে সিংহবাহু প্রাসাদের খোলা প্রাঙ্গণে এক ঘোড়ার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে তাকে নিরীক্ষণ করছিল। সিংহসিবলি লতাপাতা যোগাড় করে কী সব খেলছিল। আনমনা সুসীমা, হঠাৎ পুরুষকন্ঠে চমকিত হল, " সুসীমা বঙ্গেশ্বরের কাছে দূত মারফত খবর চলে গিয়েছে, রাজকন্যা সুসীমাকে ঘন জঙ্গল থেকে এক দুঃসহ অসহায় অবস্থায় সেনাপতি অনুর উদ্ধার করেছে তার পুত্রকন্যা সহ। পশুরাজ সিংহ তাকে বিবাহ করে নিজের অরণ্যআবাসের গুহায় এতকাল বন্দী করে রেখেছিল। তার অত্যাচারে তাদের প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠতেই , তারা পলায়ন করে ওই ভয়ংকর জঙ্গলের মধ্যে। সেনাপতি অনুর তাদের কিছুদিন আগে গভীর রাতে উদ্ধার করে এখন ছোটো রাজমহলে রেখেছে। "
সুসীমা কৌতূহলী হয়ে ওঠে, " তারপর সেনাপতি?"
বঙ্গেশ্বর দূতকে একটি মাত্র প্রশ্ন করেন-" রাজকন্যা পুত্রকন্যা নিয়ে সুস্থ আছেন তো?"
সুসীমার মুখ ম্লান হয়ে এলো-" শুধু এই একটিমাত্র প্রশ্নবাক্য?"
-" হ্যাঁ। আমি তো ভেবেছিলাম, যে কন্যাকে তিনি এতকাল মৃত বলেই জেনে এসেছেন, হয়ত কিছুই জিজ্ঞাসা করবেন না! বঙ্গরাণী কিন্তু কন্যাশোক বৎসর বৎসর ধরে নিতে পারেন নি। "
-" তবে তিনি কি মৃত?"
অনুর গলা নামিয়ে বলল- " দুঃখিত সুসীমা, তোমাকে সেই শোক সংবাদ জানাতেই হচ্ছে। "
এমন সময় দূর হতে ঘোড়সওয়ার দলের ছুটে আসার ধ্বনি পাওয়া গেল। অতিদ্রুত তারা এই মহলের দিকেই আসছে। সেনাপতি অনুরের সজাগ ইন্দ্রিয় এই শব্দের দিকে কান পেতেই বলে দিয়েছে তার কানে-কানে, এরা কোনও জরুরি মন্দ সংবাদ নিয়েই আসছে। এই ঘোড়সওয়ার দল খুব বড় নয়, জনা পনের হবে। তাদের যে প্রধান , কোনোরকমে ছোটো মহলের প্রাঙ্গণে ঘোড়া দাঁড় করিয়ে সেনাপতিকে মাথা ঝুঁকিয়ে কূর্ণিশ করলেন প্রথমে। তারপরে বললেন,
- " সেনাপতিরাজ তাতুলিপাহাড়ের আশপাশের লোকালয়ে এক পশুরাজ মানুষজনকে প্রচণ্ড উৎপাত আর অত্যাচার করে মারছে। তার আঘাতে এর মধ্যেই অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন বা গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হয়েছেন। হেতু, শুনলাম তার স্ত্রীকে তাতুলি পাহাড়ের জনজাতিরা তার আক্রমণ থেকে উদ্ধার করে গোপন কোনও জায়গায় রেখে দিয়েছে। সেই পশুরাজের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতেই হবে, রাঢ়ের এই দীন দরিদ্র মানুষজনের জন্য।না হলে একদিন আমাদেরও এই সিংহ রাজের আক্রমণে পরতে হবে!"
সুসীমা অলিন্দের ভিতরে দাঁড়িয়ে সবকথা শুনছিলেন। সিংহরাজের কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন, নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। ছোটোমহলের ভেতর থেকে ঘোড়সওয়ারদের উদ্দেশ করে ভেসে এলো তার নারীকন্ঠ--" খবরদার আপনারা কেউ ওই সিংহের প্রতি প্রতিআক্রমণে যাবেন না। ঐ পশুকে দূরত্ব বজায় রেখে নজরে রাখুন। ওকে ওর শেষ পরিণতির জন্য আমার হাতে ছেড়ে দিতে হবে। আমি একমাত্র নিজের হাতে ওর শেষ পরিণতিতে সহযোগিতা করব আর সাক্ষ্য থাকব। সেনাপতি অনুর ওদের বুঝিয়ে বলতে হবে আপনাকে। "
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হচ্ছে, সেই অন্ধকারের সৃষ্টিকালে সুসীমা দাঁতে দাঁত চেপে এক মহা প্রতিজ্ঞা করলেন। ঘোড়সওয়ার সৈন্যদল চমকে উঠলেন আঁধারের ঐ নারীকন্ঠে। তারা শুনেছেন তাদের সাথীদের কাছে এই নারীর কথা, সেনাপতি অনুরের আশ্রিতা তিনি, তিনিও প্রাণভয়ে তাতুলিপাহাড়ের জঙ্গলদেশ থেকে পালিয়ে চলে আসছিলেন ওই সিংহের ভয়ে অত্যাচারে। সেনাপতি অনুর তাকে পুত্রকন্যা সহ উদ্ধার করে প্রাণরক্ষা করেছেন তাদের। তিনি অতীব সুন্দরী এক নারী। তার রূপের ছটা যার চোখে একবার পরেছে , চিরজীবন মনে রাখবে সে। এই অকুতোভয়, সাহসিনী নারীকে তাদের একবার চোখে দেখবার ইচ্ছে থাকলেও, এখন এই মুহূর্তে অসম্ভব প্রায়। সৈন্যদল সেনাপতিকে সংবাদ প্রেরণ করে আবার যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকে ফিরে গেলেন তারা। সেনাপতি অনুর সুসীমার উদ্দেশ্যে বললেন," আগামীকাল প্রভাতে আমি নতুন করে বাক্যালাপে বসব সুসীমা। তখন সবিস্তারে না হয় আলোচনা হবে। "
ঐ অন্ধকার অলিন্দে থামের আড়ালে সুসীমার পুত্রকন্যা দুজন তার দু-পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সুসীমা সেনাপতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন , " ঠিক আছে তাই হবে সেনাপতিরাজ। " এরপর মহলের ঘরে তারা প্রবেশ করলেন।
ছোটোমহলের বাইরে দিকে কিছু ঘর বাড়ি নজরে আসল, ওখানে দাস- দাসীরা বাস করেন। সংখ্যায় যদিও তারা খুব বেশি নয়, দাস- দাসীরা বেশিরভাগ স্বামী আর স্ত্রী এবং তাদের পরিবার নিয়ে থাকেন। দিনের বেলায় মহলের মাঠের ঘাস ঝোপঝাড় ছাটা আর আশপাশের সৈন্য শিবিরের রান্নাবান্না সব মহলের এককোণে বড় পাকঘরে তৈরি হয়। সেখানেই পাত পেতে সবাই ভোজন করেন। সন্ধের মুখে রাতের খাওয়ার পর্ব সারা হয়। মহলের প্রশস্ত বারান্দায় দুটো আরাম কেদারা আজ কয়েকদিন হল বসানো আছে। রাত একটু হতেই, পুত্রকন্যা ঘুমিয়ে পড়তেই সুসীমা ঘরের দরজার আগল খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে। বাইরে থেকে দুয়ার ভেজিয়ে দেয়। অনুর যদি মহলে বাস করে সেদিন, তাহলে সে আগেই এসে বসে থাকে অন্য এক কেদারায়। ছোট মহলের আশপাশে কিছু গাছপালা কাটা হয়েছে, রাতের অন্ধকার আকাশে নক্ষত্রেরা আজকে যেন আরও স্পষ্ট। সেনাপতি অনুরের মন উতলা হয়ে উঠেছে বারেবারে। এমন সময় দুয়ার ভেজানোর শব্দে পেছনে তাকালেন, আলোআঁধারিতে এক ছায়ামূর্তি তার পাশটিতে এলো। সেনাপতি বললেন, " সুসীমা বসো। আজ কত কথা মনে পড়ছে পুরাতন স্মৃতি থেকে। একদিন বঙ্গেশ্বরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলাম তোমার পলায়নে সহায়তা করে। আবার তার কাছে আমার সেই বিশ্বাস ফিরিয়েও দিয়েছি, তোমায় ভয়ানক পশুরাজের কাছ থেকে উদ্ধার করে, বঙ্গেশ্বরের কাছে এই সংবাদও চলে গিয়েছে তার কন্যা সুসীমা আবার ফিরে এসেছে। "
--" তুমি একে বিশ্বাসঘাতকতা বলছ কেন? তোমার বিশ্বাস তো ছিল তোমার প্রেমে। তুমি কী তাহলে আমাকে ভালবাসো নাই?" সুসীমা আলো অন্ধকারে অনুরের দিকে চেয়ে বলে।
-- " তা তো নিশ্চয়! আর এই ভালোবাসার প্রতি আমি দায়বদ্ধ ছিলাম। আমি তোমার প্রেমে বিশ্বাসী ছিলাম পূর্ণমাত্রায়। জানতাম একদিন পুনরায় আমাদের দেখা হবে, মিলন হবে। প্রথম যৌবনের উচ্ছ্বাসে শরীর থাকে শুধু, আর যৌবন থেকে বয়সে স্থিতু হলে শরীরের সাথে যৌবনের নিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাস জড়িয়ে যায়। তুমি সেদিন সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলে আর আমি পেছনে রওনা দেব। দূরত্ব বাড়বেই ক্রমে, কিন্তু তোমার এই ভুবনমোহিনী সৌন্দর্যে আমি পাগলপারা। তবুও আমি তোমার প্রেমে চিরবিশ্বাসী হয়ে বিদায় জানিয়েছিলাম কিন্তু চিরবিদায় নয়। তোমার প্রথম জীবন আর যৌবনের উচ্ছ্বাস আমি চিরদিন ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখি। আমি তোমায় এখনও ততটাই ভালবাসি রাজকন্যা সুসীমা। " অনুরের কন্ঠে শাশ্বত এক প্রেমিকের বাণী যেন ঐ নক্ষত্রের আলোয় ভরা আকাশের দিকে ছুটে গেল সেই রাত্রিতে।
অনুরের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিল সুসীমা। হয়ত সুপ্তিতে দুচোখ আটকে এসেছিল। সেনাপতি অনুর ধীরকন্ঠে ডাকল-" রাজকন্যা অনেক রাত হয়েছে। তুমি তোমার গৃহের অন্দরে প্রবেশ করো। আমায় আগামীকাল সকালে আবার তাতুলিপাহাড়ের দিকে যেতে হবে। তাতুলিরবাণী ধ্বনিত হতো ঐ পাহাড়চূড়ো থেকে। এখন সবার মুখে মুখে ফেরে তাতুলি পাহাড়ের কথা। আর এছাড়াও বঙ্গেশ্বরের কিছু নির্দেশও আমায় পালন করতে হবে। "
আরও একবার সুসীমার হাত নিজের হাতে শক্ত মুঠো করে ধরে শিথিল করল সেনাপতি। সুসীমা ফিরে গেল ঐ রাতের আঁধার শরীরে মেখে ঘরের ভেতরে। এই শরীরে কখনও আনন্দের ধ্বনি হয়ে বেজে ওঠে, কখনও বিষাদের জীর্ণ কাঁসর।
সুসীমার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন জেগে উঠলো
----- বঙ্গেশ্বর, অর্থাৎ তার পিতার কী এক মুহূর্তের জন্য রাজকন্যার জন্য, তাকে দেখবার জন্য, কোনও কৌতূহল বা মন উদগ্রীব হয়ে উঠলো না? তিনি কী জানতেও চাইলেন না তার পুত্রকন্যার কথা?
ক্রমশ
0 Comments