জ্বলদর্চি

জোড়াসাঁকোর ক্যাবিনেট অর্গান / গৌতম বাড়ই

জোড়াসাঁকোর ক্যাবিনেট অর্গান 
গৌতম বাড়ই 


দ্বিজঠাকুর আজ ক'দিন হল অস্থিরমতি। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসে তার মন আনচান করেই যাচ্ছে । তাই গভীর রাতের অন্ধকারেও  বাড়ির প্রশস্ত বারান্দায়  মনের  অস্থিরতায় পায়চারি করে চলেছেন। এ সময়টায়, বিশেষত ফাল্গুনের শেষে, পশ্চিমের গঙ্গার পাড় থেকে বেশ মনোরম হাওয়ায় সারা শরীর জুড়িয়ে যায় কী এক পরম তৃপ্তিতে। প্রকৃতির হাওয়ায় যেন পরমব্রহ্মের স্পর্শের সুখানুভূতি। দ্বিজঠাকুরের সুপ্তিতে চোখের পাতা দুটো বুজে আসে। অনেকক্ষণ এধার ওধার করবার পর সবে একটা আরামকেদারায় আসীন হয়েছেন, ঠিক তখনই ঘুমহীন সারারাতের চোখ দুটো লেগে এসেছে এই গঙ্গার মনোরম বাতাসে। পিতৃদেব খুব ভোরে উঠে এই আরাম কেদারায় বসে দূরের পুকুর পাড়, গাছ- গাছালি, বিশেষত পুকুর পাড়ের কাছে প্রাচীন প্রকান্ড বটগাছটির ভোরের টাটকা নরম আলোয় মাখা রূপটি দেখতে বড্ডো ভালোবাসেন। কত পাখি কিচিরমিচির করে তখন। কাক, চড়ুই, শালিক তো আছেই, তার সাথে ভোরের দোয়েল, কোয়েল আর কত নাম না জানা বাহারি রঙের পাখি। তাই দ্বিজঠাকুর ধড়মড়িয়ে মুহূর্তের ঘুম ভেঙে আরামকেদারা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন। এইবারে তাকে ঘরের ভেতরে যেতে হবে ঘুমানোর জন্য। সবে দু-এক পা এগিয়েছেন, এমন সময় পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ডাকে থামলেন- " পুত্র! আমি জানি তোমার মনের উদগ্রীবতা। তোমার মেধা, তোমার অন্বেষণ, তোমার অনিসন্ধিৎসু মন, আমাকে বারেবারে মুগ্ধ করে। তুমি তোমার বাদ্যযন্ত্রটির জন্য ভীষণ ভাবে তার পথ চেয়ে বসে আছ জানি। এও জানি এই বাদ্যযন্ত্রটির সঙ্গে চিরদিনের জন্য আমাদের ঠাকুরবাড়ির নামও রয়ে যাবে। " দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর পিতৃদেবের কথা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে শুনলেন আর তাঁর আজ্ঞা নিয়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন। 


কলকাতার বন্দর বলতে তখনও খিদিরপুর ডক গড়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ব্রিটিশ সরকার ভারতবর্ষের একচেটিয়া অধিকার করায়ত্ত করলেন। সালটি ১৮৫৮, তার আগের বছর ঘটে গিয়েছে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে দি গ্রেট মিউটনি বা সিপাহী বিদ্রোহ। বলতে গেলে পলাশীর যুদ্ধের ঠিক একশো বছর পর এই প্রথম উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে অখন্ড ভারতবর্ষের মানুষের প্রথম এরকম বড়সড় গর্জে ওঠা, ভিতটুকুকেই নাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশদের। কলকাতার গোবিন্দপুর সন্নিহিত অঞ্চল থেকে এখনকার গার্ডেনরিচ অঞ্চলটির জলের গভীরতার জন্য বড় বড় মালবাহী জাহাজ ভিড়বার জন্য উপযুক্ত ছিল। দ্বিজঠাকুর এক বিদেশী কোম্পানির কাছে ইওরোপ থেকে এই সদ্য আবিষ্কৃত এবং অল্প কিছু বছরে জনপ্রিয়তার জন্য বাদ্যযন্ত্রটির ভারতবর্ষে আনানোর জন্য অর্ডার দিয়েছিলেন। কলকাতার সেই বিদেশী অর্ডার সাপ্লাই কোম্পানিকে চুক্তিমতন টাকাও দিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আজ প্রায় দু- মাস হতে চলল এখনও বাদ্যযন্ত্রটি এসে পৌঁছায়নি। দ্বিজঠাকুরের উদগ্রীবতা ওই জন্যেই। সঠিকভাবে জানেনও না বন্দরের কোথায় এই বাদ্যযন্ত্রটিকে নিয়ে কোন জাহাজ এসে ভিড়বে! তাহলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির এই কলকাতা শহরে যে পরিচিতি আর যোগাযোগ আছে, তাতে যন্ত্রটির পৌঁছানো সংবাদ বন্দর থেকেই এখানে এই ঠাকুরবাড়িতে চলে আসত। অফিস বলছে আর দু- একদিন বাদেই এসে যাবে, আর ওই দু- একদিন এখন প্রায় মাসদুয়েক হতে চলল। 

দ্বিজেন্দ্রনাথের মাথায় সারাক্ষণ হিজিবিজি নানান চিন্তা আর বিভিন্ন উদ্ভাবনী ভাবনা ঘুরতেই থাকে। ইদানীং তার সখের থিয়েটার আর বিভিন্ন সংগীতকলার প্রতি ঝোঁক ও বেড়েছে। অবশ্য এতে তার পিতৃদেব দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরাট অবদান রয়েছে। বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গীত গুরুদের এই ঠাকুরবাড়ির অন্দরে নিয়মিত যাতায়াত, আর সঙ্গীত চর্চা নিয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি বাংলাদেশে ক্রমশ এক উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিচ্ছে। তিনি খবরটি  পেয়েছিলেন আগেই পশ্চিমের এই হাওয়াযন্ত্রটির, মানে বাদ্যযন্ত্রটির। তার জন্মের পরপরই ফরাসীদেশে প্যারিসে  ১৮৪২ সালে এই বাদ্যযন্ত্রটি আবিষ্কার করেছেন আলেকজান্ডার ডোরিয়ান। ডোরিয়ান সাহেবের এই যন্ত্রটির নাম ক্যাবিনেট অর্গান । দ্বিজঠাকুর এই বাদ্যযন্ত্রটির প্রেমে পড়ে গিয়েছেন। চিরকাল তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন , এই যন্ত্রটি নিয়েও তবে তাই হোক। তবে তাঁর বিশ্বাস অচিরে এই বাদ্যযন্ত্রটি ভারতবর্ষে জনপ্রিয়তা পাবে ঢোল, মৃদঙ্গ, একতারা, শ্রীখোলের মতন সাধারণের মধ্যে। 

🍂

জোড়াসাঁকো পাড়া শোনে গভীর রাতে ঠাকুর বাড়ির ভেতর থেকে নতুন এক বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ। খারাপ লাগছে না। তবে এত এত রাতে কে সেই সাধক ? কেই বা বাজনা বাজাচ্ছে। পশ্চিমাদের অনেকের মনে ভয়ও ধরে গেল। মুলুক থেকে ক্ষেতি বাড়ি পরিবার ফেলে রোজগারের ধান্দায় এই কলকাতা শহরে দিন গুজরান করে তারা। রাতে দেহাতিরা মিলে রাস্তার পাশে বস্তিঘরে থাকে। তাদের কানেই অত রাতে এই যন্ত্রের আওয়াজ গিয়ে পৌঁছায়। 

১৮৬০ সালের দিকে যন্ত্রটি এনেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওই ষাটের দশকের শেষেই সখের থিয়েটারে মেতে উঠেছিলেন তিনি। একদম ছোটোভাই রবি, চুপটি করে ওই শৈশবে তাঁর বাজনা শোনে। বড়দাদা বলে তাকে ডাকে। তবে রবির গান- বাজনার প্রতি আগ্রহ তাকে ভীষণ আনন্দ দেয়। অবশ্য এই ঠাকুরবাড়ির প্রতিটি ইমারতের  দেয়ালে  শিল্প, সাহিত্যকলা , সংগীতের ধ্বনি শোনা যাবে। 

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে শখের থিয়েটারের এই ক্যাবিনেট অরগানের ব্যবহারে হল, আর এই থিয়েটারের মহরতের সঙ্গে সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীতের শেষের দিকে ভারতবর্ষে হারমোনিয়ামের জয়যাত্রা শুরু হয়ে গেল। আশ্চর্য লাগছে না হারমোনিয়াম বাদ্যযন্ত্রটি কলকাতার সেই বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির হাত ধরেই এসেছিল!

Post a Comment

0 Comments