জ্বলদর্চি

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৭৩

ছোটোবেলা বিশেষ সংখ্যা ১৭৩
চিত্রগ্রাহক - কল্যাণ সাহা
সম্পাদক -মৌসুমী ঘোষ 
সম্পাদকীয়,
আজ রবিবার। আজ ছোটোবেলা প্রকাশের দিন। আজ বাংলা নববর্ষও। তাই এসো আজ নব আনন্দে জেগে উঠি আমরা। সৃজনের আনন্দে। এদিকে নববর্ষের অপেক্ষা লাচুঙে সংঘর্ষের অপেক্ষা। শ্রীকান্ত আঙ্কেলের উপন্যাস সুন্দর ভাবে তড়তড় করে এগিয়ে চলেছে বিয়াল্লিশ পর্ব ধরে। উৎসব এসে মানুষে মানুষে সংঘর্ষ হানাহানি  ভুলিয়ে দেয়। আমেরিকায় উৎসবের মরসুমে বেড়াতে গিয়ে বাসবদত্তা আন্টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মৃত সৈনিকদের জন্য তৈরি মেমোরিয়াল দেখে এসেছে জানিয়েছে। এবারের সংখ্যায় প্রকাশিত অমিত জেঠুর ছড়া পড়ে জানিও কেমন লাগলো। এসো নববর্ষের লাড্ডুর সঙ্গে বড়োদের প্রণাম জানিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে নিই। আর নববর্ষে আমাদের বন্ধু জন্তু জানোয়াররা কীভাবে মায়ের আদর খায় জেনে নিই। কোথা থেকে কেন সুমনা পিসির বুকাইএর গল্প থেকে। সবশেষে আবার নববর্ষের পদ্ম ফুলের শুভেচ্ছা জানাই।.... মৌসুমী ঘোষ।

জীব্জন্তুদের নানা মজার কথা
সুমনা সাহা 

পর্ব- ৫
অবোলাদের সন্তানস্নেহ

আজ গল্পের টানে বুকাই স্কুল থেকে ফিরেই চটপট খেয়ে নিয়েছে, ঝটপট হোমওয়র্ক সেরেছে, এবার ও যাবে রাজিদের বাড়িতে। ওখানে সেই মামাদাদু আছেন, আজ আবার নতুন গল্প শোনা যাবে। আর গান হবে, নাটক হবে। বুকাই খুব এক্সাইটেড। কিন্তু যত ছটফট করে সে গেল, পৌঁছে হতাশ হল। মামাদাদু ব্যাগ গুছিয়ে রেডি, আন্টি দাদুর টিফিন ব্যাগে ভরে দিচ্ছেন, রাত্রে ট্রেনে উঠে খাবেন। বুকাইয়ের মনখারাপ হয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “দাদু, আরও কত গল্প বাকি থেকে গেল যে! তিমি মাছের খাওয়ার কথা বললে না। তুমি আজকেই চলে যাচ্ছ কেন?”
দাদু হাসলেন। বুকাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “বাড়িতে একটু অসুবিধা হয়েছে, যেতে হবে আজই। তোমাদের রিহার্সাল দেখতে আমারও খুব ভাল লাগছিল। কিন্তু কি করব বলো? সংসার যখন টানে, না গিয়ে তো উপায় নেই! আর গল্পের কথা বলছ? সে তো চিরকাল বাকিই থেকে যায়। সব গল্পই কি আর বলা হয়ে ওঠে? গল্প শুনে তোমার এই যে আগ্রহ তৈরি হল, এরপর তুমি নিজেই খুঁজবে, কোথায় পাই তিমির কথা? কোথায় পাই সজারুর কথা? কোথায় পাই ওরাংওটাং-এর কথা? খুঁজতে খুঁজতে তুমি এ বই, সে বই পড়বে। তারপর তোমার কাছে জড়ো হবে অনেক গল্প। আর সেগুলো শুনতে তখন অনেকে আসবে তোমার কাছে।” 
রিহার্সালের দাদা দিদিরা আর বন্ধুরা সবাই এখনও আসেনি। বুকাই একটু আগেভাগেই চলে এসেছে। রাজি বলল, “আমাদের মিনির কিউট কিউট বেবি হয়েছে, দেখবি?”
“কোথায়?”
“সিঁড়ির নিচে, চল আমরা দেখে আসি!” 
সিঁড়ির নিচেটা একটু অন্ধকার মত। কাছাকাছি যেতেই মৃদু মিউ মিউ শব্দ শুনতে পেল ওরা। রাজি বুকাইকে বেড়ালছানা দেখানোর জন্য লাইট জ্বেলে দিতেই বুকাই দেখল মিনি কাঁত হয়ে শুয়ে আছে আর চারটে ক্ষুদে মিনি মায়ের বুকের কাছে গুরগুর করছে। ঠিক যেন ছোট ছোট সাদা তুলোর বল। বুকাই ভাবল ওদের কোলে নিয়ে আদর করবে। একটু কাছে এগোতেই মিনি খুব রাগী চোখে তাকিয়ে ডাকলো, “ম্যা অ্যাঁ ও!” মালতী মাসি সিঁড়ি বেয়ে নামছিল উপর থেকে। ওর রাতের রান্না হয়ে গেছে, আরেক বাড়িতে যাচ্ছে। ওদের দেখেই বলল, “অ্যাই তোমরা এখানে কি করছ? ওদিকে যেওনি। বাচ্চা বিইয়েছে মিনি, এখন কিন্তু ও হিংস্র। কাছে গেলে পরে আঁচড়ে কামড়ে দেবে।”
বুকাই বলল, “কেন মাসি? মিনি কেন কামড়াবে?”
মালতী চোখ গোল গোল করে বলল, “ওমা! ওর ভয় আছে না? পাছে তোমরা ওর বাছাদের কোন ক্ষতি করো? ছানাদের যতদিন না চোখ ফোটে, মা বিড়াল খুব সাবধানে পাহাড়া দেয়। হুলো এসে থাবা না মারে!”
“হুলো মানে ছেলে বিড়াল?”
“হ্যাঁ গো। যা বদমাশ না হুলোগুলো!”
“কিন্তু হুলো তো বাচ্চাদের বাবা। ও কেন বাচ্চাদের মারবে?”
“অ্যাই দ্যাখো। অতশত জানি না বাপু। আমি কি তোমাদের মত ইঞ্জিরি ইস্কুলে যাই? তবে এই তোমার বিড়াল বলো, কুকুর বলো, বাঘ বলো, সিংহ বলো—বাবারা বাচ্চাদের মোট্টে দেখে নাকো। মা-ই খাওয়ানো দাওয়ানো সব করে।”
“আর হাতী?”
“হাতী তো মাংসাশী প্রাণী না। তাই শান্ত। ওদের আমাদের মত ফ্যামিলি থাকে। ফ্যামিলিতে সবাই নতুন বাচ্চাটার খেয়াল রাখে।” 
“আর পাখী?”
“ও বাবা! লোকে কথায় বলে, পক্ষীমাতা! অমন করে আগলাতে পাখিরাই পারে। ডানা ছড়িয়ে ডিমের ওপরে বসে পেটের ওম দিয়ে দিয়ে পেত্থমে ডিম ফোটাবে, ডিম ফুটে কচি ছানা বের হলে উড়ে উড়ে খাবার খুঁজে নিয়ে আসবে, আবার ঠোঁট দিয়ে সেই খাবার খাইয়েও দেবে। পাখির বাসা ঝড়ে পড়ে গিয়ে যখন ডিম ভেঙে যায়, শালিখ পাখি কত চিৎকার করে কাঁদে, দেখোনি? সব পাখিরা তাদের বাচ্চাদের জন্য বাসা বানায়। ঐ ছোট্ট ঠোঁটে করে কাঠি কুটো নিয়ে আসে, সেইসব জোড়া দিয়ে বাসা বানায় গাছের ডালে, লতাপাতার ফাঁকে।” 
“ও হ্যাঁ, দেখেছি তো! স্কুলের গেটের বাইরে নিম গাছটায় কাপের মত একটা পাখির বাসা।”
“হ্যাঁ, কাপের মত, বাটির মত, ঠোঙ্গার মত—কতরকমের বাসা! বাবা পাখিও কিন্তু বাসা বানাতে জোগাড় দেয়। মা পাখি যখন ডিমের কাছে থাকে, বাবা গিয়ে খাবার নিয়ে আসে। তারপর ছানারা যেই বড় হয়, উড়তে শিখে যায়, তখন আর কেউ কারোরে চেনে না। হুশ করে উড়ে যায় আকাশে। অ্যাই দ্যাখো। তোমাদের সাথে বকবক করতে লেগেছি। আমার লেট হয়ে গ্যালো গো। আজ বৌদিমণির কাছে বকা খাবো। তোমরা ঘরে যাও। মিনির কাছে যেওনি।” 
মালতী মাসি চপ্পলের চটরপটর শব্দ তুলে তাড়াতাড়ি চলে গেল। ওরা উপরে চলে এল। দাদু চলে গেলেন। এক এক করে রিহার্সালের জন্য সবাই এসে পড়ল। 
“আন্টি বললেন, তোদের কথা শুনতে পেলাম। তুই হাতীর কথা জিজ্ঞেস করছিলিস না অর্ক? হাতীরা দল বেঁধে থাকে। মা হাতী প্রায় ২২ মাস ধরে সন্তানকে গর্ভে রাখে। বাচ্চা হওয়ার আগে, মা হাতী দল থেকে একটু দূরে চলে যায়। বাচ্চা হলে তাকে সঙ্গে নিয়ে দলে ফিরে আসে। তখন পরিবারের সবাই মিলে বাচ্চাটাকে দেখাশুনো করে। মা হাতী সারাজীবনে সাত/আটবার বাচ্চার জন্ম দেয়, একবারে একটা করেই বাচ্চা হয় সাধারণত। সদ্যোজাত হাতীর ওজন প্রায় ২০০-৩০০ পাউন্ড। মায়ের গর্ভ থেকে ছিটকে মাটিতে গিয়ে পড়লে মা হাতী শুঁড়ে করে বাচ্চার গায়ে ধুলো ছিটিয়ে দেয়। তারপর শুঁড় দিয়েই নিজের কাছে টেনে এনে দুধ খাওয়ায়। জন্মানোর এক ঘণ্টার মধ্যেই বাচ্চাটা দাঁড়াতে পারে। তবে বাচ্চা হাতীর স্বাবলম্বী হতে প্রায় ছয় থেকে আট বছর সময় লাগে। একটা হাতীর পালে সবকটা মেয়ে হাতীই থাকে। পুরুষ হাতীরা দল ছেড়ে চলে যায় বা মেয়েরা তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়। কোন বাইরের শত্রুর ভয় থাকলে হাতীর পালের মেয়েরা পরিবারের সব ক্ষুদে সদস্যদের গোল করে ঘিরে শত্রুর থেকে আড়াল করে রাখে। পরিবারের সবার মধ্যে একটা ভালবাসার বন্ধন থাকে। একজন অসুস্থ বা আহত হয়ে পড়লে, অন্যেরা তাকে ফেলে চলে যায় না, ওর কাছে থেকে সেবা যত্ন করে। দলের মধ্যে যে অসুস্থ বা বুড়ো হাতী, তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে না, তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সবাই আস্তে আস্তে হাঁটবে। এমনকি দলের একটা হাতী মরে গেলে সবাই ওর দুঃখে কাঁদবে। ঠিক মানুষের মত। কিন্তু হাতী তো এসব মানুষের কাছ থেকে শেখেনি? মানুষের অনেক আগে থেকেই ওরা পৃথিবীতে বাস করছে।  

ডলফিনরাও একদম মানুষের মত বাচ্চার জন্ম দেয়। বাচ্চাকে মা প্রায় দেড় বছর পর্যন্ত লালন পালন করে মা ডলফিন, তারপরেও তিন বছর পর্যন্ত ডলফিন তার মায়ের সঙ্গেই থাকে। এই পুরো সময়টা একটা ন্যানি বা আন্টি ডলফিন, সেটা ছেলেও হতে পারে, মেয়েও হতে পারে—মা আর বাচ্চার কাছে কাছে সর্বক্ষণ থাকে। মা ডলফিন ন্যানি ছাড়া আর কাউকে বাচ্চার কাছে যেতে দেয় না। 
জিরাফের মায়েরাও বাচ্চাদের খুব সাবধানে রাখে। কোন শত্রু তার বাছার কাছেপিঠে এলে ও বড় বড় চোখ করে তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে, যেন বলে, “খবরদার! আমার বাছার কাছে আসবি না!” 
হনুমানের বাচ্চারা মায়ের পিঠে চেপে গাছের এক ডাল থেকে আরেক ডালে পৌঁছে যায়। যতদিন না তারা চলাফেরার সব কৌশল ভাল ভাবে রপ্ত করে, ততদিন মায়ের সঙ্গে সেঁটে থাকে। চার-পাঁচ বছর বয়স হলে স্বাবলম্বী হয়।
এইসব জীবজন্তুরা মানুষের মত কথা বলতে পারে না কেবল, মুখে বোল বা বুলি নেই, তাই আমরা বলি অবোলা। কিন্তু অবলা নয়! গায়ে ওদের বল আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। খাওয়াদাওয়া, ঘুম, ঝগড়াঝাঁটি, খেলা, রাগ, দুঃখ, বদমায়েশি, মায়া-মমতা সব কিছুই আছে। শুধু স্কুলে যাওয়া নেই, রান্নাবান্না নেই আর ফাংশন নেই।” 
সবাই রাজির মা-র কাছ থেকে আরও গল্প শুনতে চায়। কিন্তু আন্টি বলল, “এবার রিহার্সাল করতে হবে। বেশি রাত হলে বাড়িতে বকবে যে! চল তোরা, আর বেশিদিন বাকি নেই ফাংশনের। প্র্যাকটিস করতে হবে ভাল করে।”
ঝমঝম করে হারমোনিয়ামে সুর ওঠে, “ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল, জলে স্থলে বনতলে লাগলো যে দোল, দ্বার খোল দ্বার খোল!” একদল নবীন প্রাণ উচ্ছ্বল আনন্দে ছন্দে ছন্দে নাচে, ধমধম তবলায় বোল ওঠে, সারা পাড়া সুরে গমগম করে। যেন সবকটা বন্ধ দরজা খুলে গিয়ে সব মনে সুর-ছন্দ-রং-এর দোল খেলা হবে। হাওয়ায় ভেসে আসে বেলি আর কামিনী ফুলের গন্ধ। বাইরে গাছের পাতায় শনশন শব্দ উঠছে। ঝড় উঠল বুঝি? বৈশাখ এখনও তো আসেনি? এখনই কি কালবৈশাখীর আগমন ধ্বনি বেজে উঠল? ছোটদের এত হৈ হট্টগোলের মাঝেও মিনি কিন্তু তার বাচ্চাদের বুকে আগলে ঘুমিয়ে কাদা। দুটো টিকটিকিতে ভয়ানক লড়াই হয়ে গেল এখনই টিউব-লাইটের নিচে, দেওয়ালে।
(ক্রমশ)

ঢিল 
অমিত কুমার রায়

ঢিল ছুঁড়ে কুল পাড়ে গোকুল আর তেরিকুল
কুলে কুলে ভরে যায় কুলতলা বিলকুল!
নকুলের পিসি মণি খোলা তার এলোচুল,
শোনালো সে দশকথা উড়ে গেলো চিল কুল।
ঝুড়ি ভরে তুড়ি মেরে নকুলের পিসিমা 
দুটো করে পাকা কুল হাতে দিয়ে বলে খা!
পাড়বে কে কাঁচা পাকা কুল 
কুল যতো মিষ্টি 
পিসিমার ভাবনাতে ছিলো 
চিন্তার বৃষ্টি!
জুটে গেল দুই জনে গোকুল আর তেরিকুল
ঢিল গুণে পড়েছিলো বড়ো বড়ো টোপাকুল।
পাকা পাকা কুল বেছে বেচে দেয় কাঁচা কাঁচা 
পাকা গুলো পাক করে জারে ভরে গুড়ের খাঁচা !
দুটো কুলে মুখে পুরে নকুল আর তেরিকুল
বাড়ি ফেরে দুই জনে গল্পে হয়ে মশগুল।
         .......

🍂



ঢিল ছোঁড়ার কুফল
অমিত কুমার রায়

করমচাফুল ফুটলো বনে
মধুপ বাঁধে বাসা 
ধনুক শাখায় চাকের বাঁধন 
কুটরি দারুণ খাসা!

মধু খেয়ে মোম্ বানিয়ে 
চাকের নৌকা গড়ে 
পরাগ মধু ওপর দিকে 
হিসেব কষে ভরে।

নেড়া গাছে কচি পাতা 
ঝিকির মিকির করে 
ছুটছে মাছি ভোর না হতেই 
ফুলের মধুর তরে।

করমচা ফুল অশোক বকুল 
যখন শোভা গাছে 
তিলের ফুলে  ঝাঁকে ঝাঁকে 
অলির পরাণ নাচে!

ছোট্ট ছোট্ট ডিম শিশুর 
যত্ন করে খুঁজে 
রাণী খোঁজে ফাঁকা কুটির 
ডিম পাড়ে ঠিক বুঝে।

শ্রমিকরা কেউ পাহারা দেয়
কেউ বা গড়ে চাক
কেউ বা এসে খবর করে 
কোথায় ফুলের থাক্!

নেচে নেচে চাকের পাশে 
করে কতো ভঙ্গি 
কোথায় বিপদ কোথায় যাবে 
সবাই হবে সঙ্গী !

মিছে কথা একটুকু না 
শুঁড় দুটি এন্টেনা
বুঝতে পারে আগাম খবর 
গুপ্ত বাতাস চেনা !

পুঞ্জ আঁখি যায় না দেখা 
ডানার বাতাস দিয়ে 
এয়ার কুলার তৈরী করে 
শান্ত করে হিয়ে!

গণেশ অজয় বিজয় তরুণ 
দেখতে পেয়ে চাকে
দেখে যারে দেখে যারে 
বন্ধু যতো ডাকে।

ডাকু ভজা করে মজা 
মারল ঢিল টা ছুঁড়ে
মৌমাছিরা আসলো তেড়ে 
হুল ফোটালো ঘুরে!

ফোটালো হুল মুখে হাতে 
মাথায় চোখের পাশে 
ছুট লাগালো বন্ধু যতো 
হুল ফোটানোর ত্রাসে!

কেন জানো হুল ফোটালো
ভাবতে পারো তোমরা?
চাক হলো তো ওদের বাড়ি 
ভাঙলে রাগে ভোমরা।

হুল ফোটালে  মৃত্যু মাছির 
শ্রমিক সৈন্য সে যে 
চাকের জন্য মৃত্যু বরণ
ধর্ম কর্ম তেজে!

হাজার হাজার দল যে বেঁধে
একটা পরিবার 
একটি রাণী পুরুষ কিছু 
শ্রমিক বাকি তার।

সঞ্চয়ী যে হতে শেখায় 
মধু রাখে এেঁটে
অসময়ে কোথায় খাবার 
তখন খায় যে বেঁটে!

ঢিল ছুঁড়োনা মধুর চাকে
ওদের ভাঁড়ার ঘরে 
খেয়ে কামড় ভুগছে ভজা
ভুগল বিষয় জ্বরে।

উৎসব মরশুমে আমেরিকাতে বাসবদত্তা কদম

পর্ব ১৯ আমরা চললাম আমাদের এবারের গন্তব্য ওয়ার্লড ওয়ার মেমোরিয়াল(২) এর দিকে।
ওয়ার্ল্ড ওয়ার (২) মেমোরিয়াল নাম থেকেই বোঝা যায় এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে সমস্ত আমেরিকান সৈনিক মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের শ্রদ্ধা জানাতে তৈরী করা হয়েছিল। চার লক্ষের ওপর আমেরিকান সৈনিক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা যান। এখানে  অর্ধ চন্দ্রাকারে দাঁড়িয়ে আছে ছাপ্পান্ন টি গ্রানাইটের স্তম্ভ । এর ঠিক সামনেই একটি অর্ধ চন্দ্রাকৃতি চাতাল। এই অর্ধ চন্দ্রাকৃতি চাতাল আর স্তম্ভগুলির মাঝখানে একটি ফোয়ারা। প্রতিটি স্তম্ভের ওপর ব্রোঞ্জের তৈরী ফুলের মালা রাখা। 
এই ছাপান্নটি স্তম্ভ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিতি রাজ্য এবং তার সীমাকে বোঝাতে তৈরী করা হয়েছে। এখানেও দেখলাম অনেক মানুষজন আসছেন পুস্পস্তবক হাতে শ্রদ্ধা জানাতে; আবার আমাদের মতো সাধারণ দর্শকের সংখ্যাও কম নয়। 
চিত্রগ্রাহক - বাসবদত্তা

ওয়ার্ল্ড ওয়ার মেমোরিয়াল থেকে বেরিয়ে একটি লেকের পাশ দিয়ে এগিয়ে চললাম ওয়াশিংটন মনুমেন্ট এবং লিংকন মেমোরিয়ালের দিকে। 
এখান থেকেই স্পষ্ট দেখা যায় ওয়াশিংটন মনুমেন্ট। আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান আমেরিকার জনক জর্জ ওয়াশিংটনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এখানে এই মনুমেন্টটি তৈরী করা হয়েছে। এটি পাঁচশো পঞ্চান্ন ফুট লম্বা মার্বেল পাথরের একটি স্তম্ভ। সম্ভবত পৃথিবীর সব থেকে উঁচু মনুমেন্ট বা স্মৃতিসৌধ। এই স্তম্ভটি বানাতে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এসেছে মার্বেল পাথর। ভিত্তিপ্রস্তরটি তৈরী হয়েছে গ্রানাইট পাথরে। গ্রানাইট ছাড়া ব্লু-স্টোন এবং মার্বেল ব্যবহৃত হয়েছে এর স্থাপত্যে।
বিভিন্ন সময় কয়েকবার এই স্তম্ভটি বানাবার কাজ শুরু হয়েছে এবং আভ্যন্তরীণ গোলোযোগের কারণে বন্ধ হয়েছে। এরপর বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ড, টেক্সাস, শেফিল্ড, ম্যাসাচুসেটস, এভাবে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য থেকে আনা মার্বেল পাথরে এটি তৈরী হয়েছে। 
এই স্তম্ভটির ভেতরে আগে ঢকা যেত এবং এর স্থাপত্যের বিভিন্ন মার্বেলকে খুব কাছ থেকেই দেখা যেত। দুঃখজনক ভাবে  আমরা যাওয়ার কিছুদিন আগে হওয়া একটি ভুমিকম্পে এই স্তম্ভটির কিছু জায়গা ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ভেতরে প্রবেশ করার ব্যাপারটি বেশ কিছুদিন বন্ধ রাখা হয়। এর কিছুদিন পরে আবার সেটি চালু হয়। 
আমরা যখন এই ওয়াশিংটন মনুমেন্টটিকে দেখছি, একটি সময় দেখলাম ওয়ার্লড ওয়ার(২) মেমোরিয়াল এবং মনুমেন্ট একটি ফ্রেমে বন্দী হতে পারে খুব সহজেই। এ সুযোগ ছাড়ার কোনো মানে হয়না। ক্যামেরা তার কাজ করলো। অমূল্য দুটি স্থাপত্য আটকে থাকলো একটি ফ্রেমে।

ধারাবাহিক উপন্যাস
লাচুঙের নেকড়ে
শ্রীকান্ত অধিকারী

পর্ব ৪২

পাহাড়ের এমন একটা জায়গায়, এমন একটা উচ্চতায় জুং ও তার অনুগামীরা অবস্থান করছে যা সহজে বাইরে থেকে দেখা যায় না। আবার খুব যে বড় বড় গাছ সেই পাইন দেওদার ওক বা ওয়ালনাট জাতীয় গাছগুলো এতক্ষণ পাশ কাটিয়ে এসেছিল এখানে অতটা নেই। আশপাশ অনেকটা ফাঁকা। সে ভাবে বরফও নেই। তাই এত লোক একসঙ্গে সংকুলান হয়েছে। আকাশে মেঘ কেটে গেলে এখানে মাঝে মাঝে চনমনে সূর্যরশ্মি পাথরের গায়ে ঠিকরে পড়ছে। আর সেই আলোয় রামসি লক্ষ্য করে রঙিন পুরু ভাঙা কাঁচের টুকরোগুলো থেকে পারদরঙা আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে বেরিয়ে পড়ছে সারা পাহাড়ের অমসৃণ পিঠ জুড়ে। 
বরফে ঢাকা পাহাড়ে বেরাতে এলে রোদ চশমা জরুরি। না হলে চোখের ক্ষতি করবেই। সেই ভেবেই রামসি প্রত্যেকের জন্য রোদচশমা এনেছিল কিন্তু এখানে না থাকাতে মাঝে মাঝেই চোখ বন্ধ করতে হচ্ছে। প্রখর রশ্মি ছিটকে যাচ্ছে আবার মেঘ ধেয়ে এলে নিস্প্রভ হয়ে অসংখ্য মানুষের হল্লায় কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় আকাশে এই হেলিকপ্টার উড়তে দেখে ওরা মামা ভাগ্নে এমন কি বাকী সাতজন সমতলের মানুষও যার মধ্যে বাংলাদেশীরাও আছে তারা ছটফটিয়ে উঠে। কিন্তু আবার ফিরে যেতেই নেতিয়ে পড়া লতার মত মাথা নুইয়ে পড়ে সবার। 
  এখনো বেলা দ্বিপ্রহর শেষ হয়েছে বলা যাবে না। তবে ঝুপ করে আলোহীন হয়ে চারদিকের দৃশ্যমানতা হারিয়ে ফেলেছে। পাশের জনকে ভাল করে দেখতে পাওয়া যায় না। 
 ওদিকে ওই মানুষগুলো নিজেদের মধ্যে উল্লাসে আত্মহারা। জুং সমানে ওদের তাতাচ্ছে। 
এমতাবস্থায় রামসির কী করণীয় এখনো বুঝতে পারে না। একবার শুধু সময় পেয়েছিল ওখানে যারা ওদের মত মানুষগুলোকে ধরে রেখেছে তাদের মুখগুলো দেখে নিতে। হয়তো ভাল করে দেখতে পায়নি, তার মাঝেই রামসিকে আরো হতভম্ব করে ওদের যেখানে বেঁধে রেখেছে তার পূর্ব দিক বাদ দিয়ে বাকি তিন দিক অর্থাৎ পশ্চিম, উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব দিক থেকে বুনো জন্তুর মত অদ্ভুতভাবে চার পায়ে কারা ঢুকে পড়ে। এবং চোখের নিমেষে জুং এবং জুঙের মা সহ সঙ্গী সাথীদেরকে পেছন থেকে ঘিরে ধরে। কিছু চারপেয়ে জীব বাকী লেপচাদের আটকে প্রাচীর করে দাঁড়ায়। কালচে সবজে রঙের জামাপ্যান্টে ঢাকা ওদের সারা গায়ে অস্ত্র উঁকি দিচ্ছে। 
চকিতে রামসির খেয়াল হল এদের কোথাও দেখেছে। মনে পড়ল লাচুং ঢোকার মুখে এবং লাচুং-জিরো পয়েন্টের রুটের খসখসে ধ্বসালো দাঁত নখ বের করা বড় বড় পাথরের সঙ্গে নুড়ি পাথরময় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যখন সামনের দিকে একটু খানি এগিয়ে গিয়েছিল, তখনই দেখেছিল ওদের।-মিলিটারি ক্যাম্প। হঠাৎ হঠাৎ গোপনে বহিঃশত্রুর প্রবেশ কিংবা অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ আটকাতে ভীম পরাক্রমে যারা সদা সর্বদা সজাগ এবং অস্ত্রধারী। এই ক্যাম্প কিন্তু তাঁবুর নয়, পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে বানানো সব ঘর। ঘর নয় ছোট ছোট খোপ। গিয়ে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল, ওদের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেও ছিল রামসির, কিন্তু গ্যাটসো নিষেধ করাতে আর যাওয়া হয়নি। আজ এত কাছে এমন ভয়াল রুপ নিয়ে ওদের দেখবে কল্পনাও করতে পারেনি রামসি। এই মুহুর্তে শুধু ওদের শ্বাপদ-চোখগুলো ওকে ভীষণ আতঙ্কে ফেলে দিল। আবার কোত্থেকে খুশি এসে বুকের মাঝে সব সংকটগুলোকে চাপা দেওয়ার সাহস জোগালো। এই ক’দিনের আন্ধকার জগৎ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ হয়তো অবশেষে এসে যেতে পারে! 
ততক্ষণে উপস্থিত মুখোশপরা লোকগুলোর হাতের ঘণ্টাগুলো বাজানো থেমে গিয়েছে। ওরাও এই গোপন ডেরায় অদ্ভুত সজ্জায় সজ্জিত অস্ত্রধারী ভারতীয় সেনাদের আচমকা আবির্ভাবে বিমূঢ় এবং কিছুটা হলেও ভড়কে গেছে। 
রামসি লক্ষ্য করে আগন্তুকদের প্রত্যেকের হাতে সঙ্গিন লাগানো বন্দুক। এখনো পর্যন্ত মিনিট খানেক হয়ে গেল ওদের এখানে এন্ট্রি নেওয়া, তবু একটাও গুলির আওয়াজ বেরোলে না। অথচ প্রায় প্রত্যেকেই বন্দুক উঁচিয়ে রয়েছে। ভাল করে ধাতস্থ হতে রামসি ছোটমামাকে খুঁজল। কিন্তু কাছে পিঠে কোথাও দেখতে পেল না। অবশ্য দৃষ্টি যে খুব বেশি দূর যাচ্ছে তা না। একটু আগেই সব পরিষ্কার ছিল। পাহাড়ের ধর্ম অনু্যায়ী আবহাওয়ার পরিবর্তন সে ভালই বুঝতে পারে। আশ্চর্য হওয়ার কারণ নেই। তা বলে এত তাড়াতাড়ি এমন দৃষ্টিরোধক অন্ধকার! ভাবতে ভাবতে পাহাড় ভাঙা বৃষ্টি এসে ওদের সবাইকে ভিজিয়ে দিল। 
একে দুপুর শেষের পাহাড়িভূমি। ধারে-কাছে তেমন গাছালি না থাকলেও অদূরে ঘন জঙ্গল থেকে হিমেল উলুঢুলু হাওয়া বেশ কিছুটা রুক্ষ ভূমির মাঝে তৃণ-গুল্মকে লাঞ্ছিত করছে। সঙ্গে সঙ্গে রামসিদের মত সমতলের মানুষদেরও। 
রামসির আবার চমকানোর পালা। লক্ষ্য করে একসঙ্গে গিজগিজে লোকের তীক্ষ্ণ শিষের মিলিত পিলে চমকানি ধনি বৃষ্টির একটানা শব্দকে ছাপিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখে ধূসর সবুজ মাঠের আদিবাসীরা বানপক বুকের কাছে আড়াআড়ি ভাবে তুলে ধরে রয়েছে। অনেকে আবার দু হাতে দু রকম অস্ত্র,-এক হাতে দুমুখো ছুঁচালো তীক্ষ্ণ ফলা লাগানো বাঁশের বর্শা। কারো আবার চপার জাতীয় ভারী কিছু।-কারও যেন আদেশের অপেক্ষায়। 
শুধু সময়ের অপেক্ষা। শুরু হবে সংঘর্ষ। চলবে খুনোখুনি। ধ্বস্তাধ্বস্তি। গুলিবাজি বোমাবাজি। কিংবা আরো কিছু। 
রামসি ভুলেই গিয়েছিল জুং ও তার সঙ্গীদের হাতে পিঠে অন্য ধরণের অস্ত্রও বাঁধা আছে! অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। ছবিতে এবং মোবাইল গেম খেলতে গিয়ে যে স্নাইপার এবং স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সে ব্যবহার করে তার মতই। একসঙ্গে অনেক গোলা-গুলি বেরিয়ে শত্রুকে আক্রমণ করে। কিন্তু সে তো ব্যবহার করে বিদেশি আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য। যাতে করে দ্রুত এবং একসঙ্গে অনেক শত্রুকে শেষ করে দিতে পারে। তা বলে, এই দেশের ভেতর এই দেশের লোকেরই হাতে! তার মানে বাইরেই শুধু ভয়ঙ্কর শত্রু আছে তা নয়, ভেতরে একেবারে গৃহের অন্দরে যেখানে দেশবাসী অনায়াসে আপন মুক্তির আনন্দে ঘুরে বেরাতে পারে। অথচ এখন এই জুং ও তার সঙ্গীরা যারা এদেশেরই নয়, কেউ কাম্বোডিয়ার, কেউ তাঞ্জানিয়ার তো কেউ সিরিয়া কিংবা কাতারের। কেউবা চীন-তিব্বতের অংশের। যাদের কাউকে চেনা যায় না। তাদের প্রত্যেকের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। যখন তখন চালালে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। 
 সে যুদ্ধ দেখেনি কখনো। হয়তো দেখবে এমন কথা ছিল না। অন্তত বেড়াতে এসে । এই মুহুর্তে সেই শ্বাসবন্ধ মুহুর্তেরই অপেক্ষা। হয়তো এখুনি গোটা পাহাড় লাল রক্তের চাদরে ঢেকে যাবে। নিস্তব্ধ নৈঃশব্দ্যের নিবিড় প্রশান্তি বিঘ্নিত হয়ে এই পাহাড়ে জঙ্গলে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করে আছে সেই সব জীব-জন্তুরা সন্ত্রস্ত হয়ে অকুস্থলের দিকে উঁকি মারবে। আর রক্তের গন্ধে কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ভয়ঙ্কর নেকড়েরা যারা এই পাহাড়েরই এক সংকীর্ণ গহ্বরের পাদদেশে রক্ষিত হয়ে আছে তারাও অপেক্ষায়। শুধু তাদের প্রভুর আজ্ঞা পেলেই সাক্ষাৎ মৃত্যুর থাবা নিয়ে ধেয়ে আসবে।  পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লাফাতে লাফাতে কিংবা বায়ুর গতিতে ছুটে এসে টার্গেটেড শত্রুর ঘাড় কামড়ে ধরবে। তারপর শরীরের মাংস হাড় ছিন্ন ভিন্ন করে ছড়িয়ে দেবে। আর ভয়ঙ্কর উল্লাসে নর্থ সিকিম কাঁপিয়ে চিৎকার করেই যাবে। ইতিহাস আবার ফিরে আসবে। 
আঁতকে ওঠে রামসি,-শাদুল মা-মা? 
সঙ্গে সঙ্গে নেকড়ের মত লাফ দিয়ে দুজন আদিবাসী ওর ঘাড় চেপে ধরে। রক্ত হিম হয়ে যায় রামসির! গলা দিয়ে রা বেরোয় না। কিছু বলার আগেই ঘাড়ের ওপর ধারাল শীতল ধাতব ছোঁয়া লাগতেই রামসি জ্ঞান হারিয়ে দন্ত-নখর যুক্ত পাথরের চাট্টানের ওপরে এলিয়ে পড়ে।
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments