জ্বলদর্চি

উদয়ের পথে /দশম পর্ব /মলয় সরকার

ওয়াকুদানির কালো ডিমের প্রতিকৃতি

উদয়ের পথে
দশম পর্ব
মলয় সরকার


সব থেকে মজা হল আমাদের রোপওয়ের যাত্রাপথের  নীচে, প্রায় ১৩০ মি তলায়  চারিদিকে অসংখ্য ,প্রায় মরা পাহাড়ের উপর দিয়ে যাচ্ছি। তার মাঝে মাঝে দেখি, অনেক জায়গাতেই পাহাড় থেকে ধোঁয়া উঠছে। কোন কোন জায়গায় মানুষ যেতে পারে, আবার কোন কোন জায়গায় মানুষ যেতে পারে না। হঠাৎ আমাদের চোখে সামনে ভেসে উঠল , যা দেখার জন্য আমরা এতক্ষণ ছটফট করছিলাম অধীর আগ্রহে, সেই মাউন্ট ফুজি। এটি আমাদের টাইগার হিলে সূর্যোদয় বা মুন্সিয়ারীর পঞ্চচুল্লী দেখার মতই ,সৌভাগ্য না থাকলে দেখা যায় না। এই সেই মাউন্ট ফুজি, যার নামে এতদিন ব্যবহার করে এসেছি, ফুজি ক্যামেরা বা ক্যামেরার ফিল্ম।একেবারে পরিষ্কার, অর্ধেক বরফে ঢাকা, যেমনটি, জাপনের আইকনিক ছবিতে থাকে, ঠিক তেমনই। আমরা তো উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলাম। ছবিও নেওয়া হল  বাক্সের মধ্যে থেকে।
যে জায়গা গুলোতে, উপর থেকে যা দেখলাম, ধোঁয়া উঠছে, আসলে সেখানে আছে সালফার জাতীয় পদার্থ। এগুলি সৃষ্টি হয়েছিল। আজ থেকে প্রায় ৩০০০ বছর আগে হাকোনে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে। এখানে চারিদিকেই আগ্নেয়গিরি। 

ঠিক এখন যখন এটির লেখা চলছে, আজ ২/১/২৪ এখনও টিভি তে দেখাচ্ছে গতকালের হনসু দ্বীপের( যে দ্বীপে আমরা গিয়েছিলাম) সেখানকার মারাত্মক ভূমিকম্প (রিখটার স্কেল বলছে মাত্রা ৭.৬) ও সুনামীর খবর। এখানে প্রচুর সম্পত্তি নষ্ট , প্রাণহানি ও প্রচণ্ড ক্ষয় ক্ষতির কথা খবরে বার বার দিচ্ছে। আমরা যখন ছিলাম, তখন হলে কি করতাম, তাই ভাবি।এই ভূমিকম্প জাপানের জনজীবনের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

যাই হোক, তখন তো এই যাত্রা আমার কাছে স্বপ্নের মত। এসে পৌঁছালাম প্রায় আধ ঘন্টা পরে ওয়াকুদানি (Owakudani)তে।এখানে নেমে দেখি প্রচণ্ড ঝকঝকে রোদ যেমন, তেমনি ঝোড়ো ঠাণ্ডা হাওয়া। মাথার থেকে টুপি ঊড়ে যাচ্ছে। 
দূরে দৃশ্যমান মাউন্ট ফুজি

সামনেই দেখি এর প্ল্যাটফর্ম থেকে নেমেই, সামনে রয়েছে একটা জায়গা যেখানে কিছু পাথরের উপর একটা কালো বড় ডিমের প্রতিকৃতি করা আছে। তার গায়ে জাপানী ভাষায় কিছু লেখা আছে। অনেকেই সেই ডিমের সঙ্গে, পিছনে মাউন্ট ফুজিকে নিয়ে সেলফি তুলছে।

এই মাউন্ট ফুজি হল শুধু হনসু দ্বীপের নয় , সারা জাপানের মধ্যে উচ্চতম আগ্নেয়গিরি বা পর্বত। এটির উচ্চতা প্রায় ১২৩৯০ ফুট। প্রায় একলক্ষ বছর আগে সৃষ্ট এই আগ্নেয়গিরি, যা তিনটি আগ্নেয়গিরির সমন্বয়। ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত এতে  কোন মহিলাকে উঠতে দেওয়া হত না, কারণ একে খুবই পবিত্র মানা হত।এটি  বর্তমানে একটি জীবন্ত আগ্নেয়গিরি, যা শেষবারের মত ঊদ্গীরণ করেছে ১৭০৭ সালে।এই মাউন্ট ফুজি হল জাপানের প্রতীকচিহ্ন।

🍂

 সামনেই একটি রেস্টুরেন্ট। তার দ্বিতলে গিয়ে দেখি বিশাল লাইন পড়েছে সেই কালো ডিম কেনার জন্য।অনেকেই একাধিক ডিম কিনছে। এখানে শুধু এই ডিম নয়, অনেক জিনিসই আছে, যা লোকে স্মারক হিসাবে নিয়ে যাচ্ছে।এ ছাড়া কিছু খাবার দাবারও আছে। ওরা বলছে এবং লেখাও আছে এখানে যে, এই ডিম যে খাবে তার সাত বছর করে আয়ু বেড়ে যাবে। আমরা তো এত সহজে আয়ু বেড়ে যাওয়ার লোভ ছাড়তে পারি না।লাইন দিলাম। ভাবছিলাম আয়ু বাড়ার বদলে যদি বয়স কমে যেত, কেমন মজা হত! কিংবা, একটা ডিমে যদি সাত বছর আয়ু বাড়ে, পাঁচ ছ’টা খেলে কি পঁয়ত্রিশ চল্লিশ বছর বাড়বে? এটা কেউ নিশ্চিত করতে পারল না।

নিলাম আমরা প্রত্যেকের জন্যই একটা করে । কেউই আর তার বেশি আয়ু বাড়াতে রাজী হল না। ডিমগুলো দেখি, সাইজটা মুরগীর ডিমের মতই প্রায়।তবে বাইরের রংটা কুচকুচে কালো। সাবধানে ডিমের খোসা ভেঙ্গে দেখি তার ভিতরে ডিমের কুসুম বা সাদা অংশটায় কোন বিশেষত্ব নেই। আমাদের চেনা মুরগীর ডিমের মতই। খেয়ে দেখি অবিকল মুরগীর সিদ্ধ ডিম।

তখন আস্তে আস্তে খোলাটা হাতে ঘসতে দেখলাম, গুঁড়ো গুঁড়ো কালো রঙ উঠে আসছে। তবে কি ওরা রঙ করা কালো মুরগীর ডিম দিয়ে ঠকাচ্ছে? তাহলে লোকে কিছু বলে না কেন? 

আসল সত্যিটা জানলাম পরে। তা হল, ওখানে যে পাহাড়ে গন্ধক মিশ্রিত গরম জল বেরোচ্ছে , পাহাড়ের ভিতর থেকে, সেই জলে মুরগীর ডিম ৮০ডিগ্রী উষ্ণতায় প্রায় এক -দেড় ঘণ্টা  সিদ্ধ করলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে এরকম কালো বর্ণের হয়ে যায় খোলাটা। কিন্তু ডিমের ভিতরে স্বাদের তফাত হয় না। তবে আয়ু বাড়ার ঘটনা প্রমাণসাপেক্ষ। স্থানীয় মানুষ  একে বলেন Kuro-Tamago। 

এই ওয়াকুদানি জায়গাটি তৈরী হয়েছিল প্রায় ৩০০০ বছর আগে যখন এই মাউন্ট হাকোনে, যার উপর এটি রয়েছে, সেটিতে অগ্ন্যুৎপাত হয়েছিল।

এই কালো ডিমের সম্বন্ধে ধারণা বা বিশ্বাস কিন্তু আজকের নয়।সেই প্রায় এক হাজার দু’শ  বছর আগে যখন বৌদ্ধ সাধু Kukai Kobo Daishi এখানে এসেছিলেন। তিনি এখানকার বাসিন্দাদের দুঃখী মুখগুলো দেখে তাদের একটি প্রার্থনা সহ, এই গন্ধক মেশানো জলে ডিম সিদ্ধ করে খেতে বলেছিলেন।এতে তাদের স্বাস্থ্য ভাল হবে, মুখে হাসি ফিরে আসবে এটাই তিনি বলেছিলেন। আজও ধর্মপ্রাণ মানুষ প্রার্থনা সহযোগেই এই ডিম খায়। তবে একটা ডিম খেলে শরীরের তা ভাল কাজই দেবে। কিন্তু অনেকেই বলেন, দুটো বা তার অধিক ডিম খাওয়া উচিত নয়।

এখানে তিনি একটি মূর্তি তৈরী করান ,যাকে বলা হয় Jizo।সেটি এখনও রয়েছে একটি ছোট মন্দিরে। সকলে তাঁকে আজও শ্রদ্ধা জানায়। তিনি আয়ু ও শিশুদের স্বাস্থ্যের দেবতা।

আগে এই জায়গাকে Great Hell বা বিশাল নরক বলা হত। পরে ১৮৭৩ সালে রাজা ও রাণী এখানে বেড়াতে এসে এর নাম বদল করে ফুটন্ত উপত্যকা বা Boiling Valley রাখেন।
ধোঁয়া উঠছে রুক্ষ পাহাড়ের গা থেকে

তবে এই জলে ফোটালেও ডিমের ভিতরের জিনিস যে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় ,তা নয়। কিন্তু এই কালো রঙের সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া মুস্কিল। আমরা দেখি নীচে থেকে অনেকে গাড়ি করেও এখানে আসছেন। অর্থাৎ ঐ রোপওয়ে ছাড়াও গাড়িতে আসা যায়। তবে রোপওয়ে তে আসার যে মাধুর্য তা নিশ্চয়ই গাড়িতে পাওয়া যায় না। আর তা ছাড়া গাড়িতে এলে রাস্তায় জ্যামে পরার সম্ভাবনা বেশি। এটি আসলে পাহাড়ের মাথা। বা এটা আসলে ৩০০০ বছর আগে অগ্ন্যুৎপাত হওয়ার ফলে ওয়াকুদানি আগ্নেয়গিরির ক্রেটার বলা যায়।এখানে বেশ কিছুটা সমতলের মত জায়গা। প্রচণ্ড হাওয়ায় বিধ্বস্ত অবস্থা এখানে।

একসময় দেখা মোটামুটি শেষ করতেই হল। কারণ সময় বড় বালাই। আমরা ফিরে এলাম ওয়াকুদানি
রোপওয়ের সেই বিশাল চাকার কাছেই। এবার যাওয়া আমাদের তোগেন্দাই। যেখানে আছে আসিনোকো (Ashinoko Lake)  বা আসি লেক।এখান থেকে লেক এবং মাউন্ট ফুজি প্রায় পুরোটাই দেখা যায়।
চলুন এর পর যাব অসি লেকে নৌকা বিহার করে তোগেন্দাই–

সঙ্গে থাকুন।
ক্রমশঃ—

Post a Comment

0 Comments