জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৯ / সালেহা খাতুন

সুফল ও তার কীর্তি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৪৯ 
সালেহা খাতুন 

ইসলামে কিন্তু কঠোর নির্দেশ আছে একমাত্র সর্ব শক্তিমান আল্লাহ ছাড়া কারোর কাছে মাথা নোয়ানো যাবে না। ইদে আমরা বড়োদের সালাম অর্থাৎ প্রণাম করতে গেলে অনেকেই না জেনে সালাম গ্রহণ করেন। কেউ কেউ পা ছুঁতে না দিয়ে কাছে টেনে নেন। কিন্তু শরিয়ত মেনে চলা আমার সেজোকাকা কোনোদিন আমাদের মাথা নোয়াতে দেন নি। বলতেন একমাত্র আল্লার কাছেই মাথা নত করো। কোরআন শরিফের স্থান আমাদের মাথায় উপর। সে কথা খেয়াল রেখো। 

আমার ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই জানে আমি তাদের প্রণাম করতে দিই না। জোর করলে বলি আমিও তোমাদের প্রণাম করবো। ওদের বলি হাত মেলাও। এটার পেছনে কি তাহলে অবচেতনে সেজো কাকার খানিকটা প্রভাব আছে? তবে সেজো কাকা আমি পড়াশোনা করি বলে ভীষণ গর্ব করতেন। আসলে পড়াশোনা শিক্ষাদীক্ষা মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটায়। দৈনন্দিন জীবনে শরিয়ত যথাযথভাবে মেনে চলতে পারি না। চোদ্দোশো বছর আগেকার জীবনযাত্রা টো টো ফলো করা আজকের দিনে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আমার নিজেরই ধর্মাচরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এটাকে সুনজরে সবাই দেখছেও না। কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তর্কে জড়াই না। নীরব থাকি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়েও যখন পড়ছি রমজানের সারামাস রোজা রাখতাম। ক্লাস শেষ  করে বাড়ি ফেরার পথে ট্রেনেই ইফতার করতে হতো। টিফিন বক্সে মা ভেজা ছোলা, আদার টুকরো, খেজুর দিয়ে দিতেন। সময় হলে ট্রেনেই ইফতার করতাম। হ্যাঁ কষ্ট হতো খুবই। কিন্তু মনের জোর ছিল।

কত কিছুই তো বদলেছে। ছোটোবেলায় দেখেছি ছবি তোলায় যেখানে আপত্তি ছিল সেখানে হজ্বে যাওয়ার সময় পাসপোর্ট বানাতে ছবি তুলতে বাধ্য হতে হয়েছে এক সময়ের কট্টর মনোভাবাপন্নদের। ছবি প্রসঙ্গে মনে পড়লো সুফলের কথা। সুফল আমার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বন্ধু। এ সেকশনেই ছিল। ওর সঙ্গে কলেজ স্কোয়ার, সূর্য সেন স্ট্রিট বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতাম। শিক্ষার্থী থাকাকালীনই ওর লেখা একটি কিশোর উপন্যাসের জন্য ও পুরস্কার পেয়েছিল। সেটির টাইপরাইটারে টাইপ করা কপিটি বাড়িতে এনে পড়েছিলাম। “পথের পাঁচালী” ওকে কতটা অনুপ্রাণিত করেছিল সেটি পড়ে অনুভব করি। 

ওর একটি পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিয়ে আমার কাছে অনেকদিন রেখেছিলাম। যেমন মমতাজের থেকেও একটি ছবি নিয়েছিলাম। কিন্তু মা সুফলকে ছবিটি ফেরত দিতে বলে। মা কী ভেবেছিল কে জানে! সুফল নদীয়া জেলার মানুষ। এখন থাকে শিলিগুড়িতে। শিলিগুড়ির সূর্য সেন মহাবিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে। কবিও বটে। বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশ করেছে। তিরিশ বছরে তিরিশ কেজির ওপর ওজন বাড়ানো আমাকে ফেসবুকে দেখে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করেছিল “তুমি তো আমাদের ৯৪-৯৬ এর সালেহা?” লোকে সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে যতই গেল গেল রব তুলুক আমি এর সুফল পেয়েছি এবং বন্ধু সুফলকেও পেয়েছি।

🍂

সেদিন ক্লাসে রবীন্দ্রনাথের “মধ্যবর্তিনী” আলোচনা করছি। খেয়াল করলাম শিক্ষার্থীরা মন দিয়ে শোনার ভাণ করে এ ফোর পেপারে খসখস করে কী একটা লিখে একে অন্যকে সেটা দিচ্ছে। বললাম সব্যসাচী নাকি তোমরা! মাল্টিটাস্কিংয়ে  পারদর্শী হয়ে উঠেছ। ওরা না বললেও আমি জানি ফিল্ড সার্ভেতে যাওয়ার আগে ওদের কাছে অভিভাবকের অনুমতি পত্র চাওয়া হয়েছে আর ওরা একে অন্যের অভিভাবক হয়ে অনুমতি পত্র লিখে সই করছে। ওরা তো আর জানে না ওদের ম্যাডামও তিরিশ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দিন অভিভাবকের সইয়ের জায়গায় প্রথম দিন দেখা হচ্ছে এমন এক বন্ধু মোস্তফা কামালকে দিয়ে বাবার সই করিয়ে ছিলেন। না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াই হয়তো হতো না। ডেট পেরিয়ে যেতো। 
সন্তানসহ মোস্তফা এবং রফিক

বর্তমানে শিক্ষক ও সুলেখক মোস্তফা কামাল তিন সুসন্তানের বাবা। ওর ছোটো মেয়ে রুম্মানা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল’য়ের ডিগ্রি অর্জন করেছে। এখন মালদা কোর্টের অ্যাডভোকেট। রুম্মানা একদিন মেসেঞ্জারে লেখে আপনি আমাকে চেনেন? বলি হ্যাঁ, তুমি আমার বন্ধু মোস্তফা কামালের মেয়ে। শুধু বলি না, তোমার বাবা একদিন আমার বাবার ভূমিকা পালন করেছিল।

মোস্তফা পড়াশোনা করতে করতেই চাকরি পায়। ফলে অনেকদিন ওর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। একদিন হঠাৎ করে ওকে ফোনে ধরিয়ে দেয় সহপাঠী বন্ধু আবদুর রফিক সরদার। রফিকও কবি এবং অধ্যাপক। এখন গভর্মেন্ট কলেজে পড়ায়। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার এক বন্ধুকে চেতন শর্মা বলে ডাকতাম। তখন আমাদের মধ্যে ক্রিকেট জ্বর প্রবল ছিল। সে দেবাশিস না শুভাশিস এখন গুলিয়ে ফেলেছি। তবে দেবাশিসই হবে। দেখি এ ব্যাপারে শুভাশিসেরই দ্বারস্থ হই।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments