জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—তিব্বত (এশিয়া)মোড়লের মীমাংসা /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস 

দূর দেশের লোকগল্প—তিব্বত (এশিয়া)
মোড়লের মীমাংসা
চিন্ময় দাশ


অনেক অনেক কাল আগের কথা। তিব্বতের একটা পাহাড়ি এলাকা। পাহাড়ের একেবারে মাথায় বড়সড় একটা গ্রাম। জায়গাটা এতো উঁচু এতো উঁচু, মনে হয় যেন অন্য আর সব কিছুর থেকে, আকাশটাই বেশি কাছে। 
সেই গ্রামের মোড়লের ভারি সুনাম। সব্বাই চেনে তাকে। সুবিচারক হিসাবে ভারি নামডাক মানুষটার। তো, সেই পাহাড়ের তলায় দু’জন গরীব মানুষের বাস। দুজনের ঘরেই দু’জন বুড়ি মা আছে তাদের। অভাবী হলেও, দুজনেই তারা মোটামুটি ভালো মানুষ।
একদিনের ঘটনা। তাদের একজন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। হাতে তেল্ভর্তি একটা ভাঁড়। পাহাড়ের উপরে একটা বড় গ্রাম আছে। সেখানেই চলেছে লোকটি। তেল বিক্রি করে দুটো পয়সা আসবে, সেই আশায়। 
পাহাড়ি রাস্তা। যেতেও হবে একেবারে পাহাড়ের সেই মাথায়। কতটা পথ চলবার পর, লোকটির মনে হোল, আর পারা যাচ্ছে না। একটু জিরিয়ে নিই। রাস্তার গায়েই একটা পাথরে তেলের ভাঁড়টা রেখে, নিজেও বসে পড়ল।
একটু বাদেই একটা খট খট শব্দ। লোকটার প্রতিবেশী মানুষটি নেমে আসছে পাহাড়ের উপর থেকে। সামনে তার পোষা গাধাটা। গাধার পিঠে দু’দিকে দুটো কাঠের বোঝা ঝোলানো। বোঝার ভারে, একেবারে ঝুঁকে পড়েছে বেচারা। হোল কী, গাধাটা তেলের ভাঁড়টা খেয়াল করেনি। তার পা লেগে গেল ভাঁড়টাতে। ভাঁড় ভেঙে গেলে যা হয়! পুরো তেলটা গড়িয়ে গেল রাস্তা জুড়ে। 
আর যায় কোথায়! হায় হায় করে উঠল লোকটি-- সর্বনাশ করে দিলে আমার। এক দানা খাবার নাই ঘরে। কী নিয়ে ঘরে ফিরব এখন? কী তুলে দেব বুড়ি মানুষটার মুখে। তেলের দাম মিটিয়ে দাও আমার।
গাধার মালিক লোকটা তেড়িয়া হয়ে জবাব দিল—আমি কেন তেলের দাম দিতে যাবো হে? ভাঁড় কি আমি ভেঙেছি নাকি? 
--তোমার গাধাই তো ভাঙলো। তোমার গাধা ভেঙ্গেছে, মানে তুমি ভেঙেছ। তুমি ছাড়া দাম কে দেবে?
সে লোক ভারি সেয়ানা। জবাব দেবে কী, উলটে তড়পাতে লাগল—এতো বড় সাহস তোমার? আমাকে গাধা বললে? চলো মোড়লের কাছে। মজা দেখাচ্ছি। তেলের দামের কথা মাথায় তুলে রাখো। উলটে জরিমানা করিয়ে ছাড়ব তোমার। 
প্রথম লোকটা খেঁকিয়ে উঠল—চলো তাহলে। দেখি কতো বড় বিচারক সে। দোষ করলে তুমি। আর খেসারত দিতে হবে আমাকে?  
পাহাড়ের মাথায় সেই যে বড় একটা গ্রাম। সেখানেই থাকে গাঁয়ের মোড়ল। দুজনে গিয়ে হাজির হোল লোকটার কাছে। 

🍂

খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল সে ঘটনাটা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কতো কথা জানতে চাইল দুজনের কাছে। কে আছে বাড়িতে। সংসার চলে কী করে তাদের। কে কোথায় যাচ্ছিল? কী করে ভাঙল তেলের ভাঁড়। কোথায় রাখা ছিল সেটা। গাধাটাই বা দেখতে পেল না কেন? কত ভারি বোঝা চাপানো ছিল তার পিঠে। এই সব হাজারো প্রশ্ন।
সব শুনে মোড়ল ভাবল, দুজনেই তারা অভাবি মানুষ। বুড়ো মায়ের যত্নও করে দুজনে। তাহলে মানুষ হিসাবেও ভালোই বলতে হবে দুজনকেই। এদিকে ক্ষতিপূরণ না পেলে, একজনের অসুবিধা হবে। আবার ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে, অসুবিধায় পড়তে হবে আর এক অভাবীকেও। 
অনেক ভেবে, একটা উপায় বের করল মোড়ল। বলল—আমার মতে দোষ তোমাদের কারুরই নয়। তুমি তেলের ভাঁড় রেখেছিলে পাথরের উপর। সেটা বাঁচাবার দায় ছিল পাথরেরই। একজন মানুষ ভরসা করে তোমার হেফাজতে একটা জিনিষ রেখেছে। তোমার কোনও দায় নাই সেটা বাঁচাবার? পাথরেরই দোষ হয়েছে।
--এদিকে গাধাটা ছিল সামনে। তার মালিক ছিল পিছনে। ভাঁড়টা তার চোখে পড়বার কথা নয়। গাধারই উচিত ছিল ভাঁড়টা বাঁচিয়ে চলবার। তাহলে মানেটা দাঁড়াল, এক্ষেত্রে দোষ যদি কেউ করে থাকে, সেটা করেছে পাথর আর গাধা। আজকের দিনটা তোমরা আমার বাড়িতেই থাকো। কাল আমি দুজনের বিচার করে, এর একটা ফয়সালা করে দেব।
এমন অদ্ভূত কথা কে কবে শুনেছে? লোক দুটো ফ্যাল ফ্যাল করে দুজনের দিকে চেয়ে রইল দুজনে। তা দেখে মোড়ল মুচকি হেসে বলল—এখনই ভড়কে যাচ্ছো কেন হে? কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করো। বিচারটা কেমন করি, দ্যাখোই না। কাউকেই হা-হুতাশ করতে হবে না। খুশি মনেই বাড়ি ফিরিয়ে দেবো দুজনকে। যাও, এখন বিশ্রাম করো গিয়ে।
একটা লোক পাঠিয়ে রাস্তার ধার থেকে পাথরটাকে তুলে আনা হোল। পাঁচিল দিয়ে ঘেরা বাড়ি মোড়ল মশাইর। রাস্তার গায়েই। রাস্তার ধারে দুটো খুঁটি পুঁতে, গাধা আর  পাথরটাকে শক্ত করে বেঁধে রাখা হোল। পরের দিন দূপুর বেলায় বিচার হবে দুজনের। 
এমন অদ্ভূত বিচারের কথা কেউ শোনেনি কোনদিন। বিশেষ করে, পাথরের টুকরো কি পালাবার জিনিষ না কি? সেটাকে কেন দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, কারুর মাথায় ঢুকছে না।
এক কান দু’কান হতে হতে, গোটা গ্রাম শুনল, দেখল ব্যাপারটা। এমন আজব বিচার দেখতে কার না মন চায়। কৌতুহলি মানুষ কোনও দেশেই কম নাই। পাহাড়ের মাথাতেও না।
সকাল না হতেই, দু’জন চারজন করে লোক জমতে শুরু করল মোড়লের বাড়িতে। বেলা বাড়ছে, জমায়েতও বাড়ছে। মোড়ল জানতো, এমনটাই হবে। সেটাই তার সুবিচারের ফন্দি। তার মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠছে। সবাইকে বেশ খাতির করে বসাচ্ছে মোড়ল। যখন দূপুর হয়ে এলো, মোড়লের বাড়ির আঙিনা একেবারে ভরে উঠেছে। 
মোড়ল বলল—তাহলে আর দেরি করে কাজ নাই। বিচারটা শুরু করা যাক।
লোকজন হইহই করে উঠল—শুরু হোক, শুরু হোক। আসলে তাদের কৌতুহলের বাঁধ ভাঙতে শুরু করেছে ততক্ষণে।
মোড়লের কথায়, তার চাকর গিয়ে, পাঁচিলের আগড় টেনে খিল আটকে দিল বাইরে থেকে। পুরো জমায়েতটা বন্দি হয়ে গেল ভিতরে। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল অবাক হয়ে। 
তখন মোড়ল বলল—একটা গাধা আর একটা পাথরের বিচার হয়, এমন কোন বিধান আছে নাকি কোথাও? না কি কোনদিন দেখেছ বা শুনেছ তোমরা কেউ? তবুও একটা আজব ব্যাপারে, কাজকর্ম ফেলে দৌড়ে চলে এলে সবাই? সেই ভোরের বেলা থেকে এই দূপুর পর্যন্ত ঠায় বসেও রইলে এতগুলো লোক? আজগুবি বিষয়ের এই টানের জন্য, খেসারত দিতে হবে তোমাদের। প্রত্যেককে চার পয়সা করে জরিমানা করা হল। জরিমানা আদায় দিলে, তবে পাঁচিলের আগড় খোলা হবে। 
একে তো মোড়লের তিরষ্কার শুনে মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল। কথা ফোটেনি কারও মুখে। এবার ছাড়া পাওয়ার উপায় শুনে, বেস খুশিই হোল লোকগুলো। সকলে চার আনা করে জরিমানা আদায় দিতে, আগড় খুলে দেওয়া হোল। 
ছাড়া পেয়ে, লোকগুলোর তো হুড়মুড় করে বেরিয়ে পালাবার কথা। তা কিন্তু হোল না। তারা আবদার ধরল মোড়লের কাছে—জরিমানা তো দিলাম। তা হলে, বিচারটা একটু দেখে যাই।
মোড়লের মুখে চওড়া হাসি। বলল—অবশ্যই দেখবে। কেন দেখবে না। 
জরিমানা হিসাবে যা জমা পড়েছিল, তা থেকে এক মুঠো তুলে নিয়ে, গাধার মালিকের হাতে ধরিয়ে দিল মোড়ল—কাল থেকে আটকে আছো এখানে। কাজের ক্ষতি হয়েছে তোমার। এটা তার ক্ষতিপূরণ। 
লোকটা তো আহ্লাদে ডগমগ। জরিমানা দিতে হবে, সারা রাত এই ভয়ে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। এখন কিনা উল্টে এক মুঠো পয়সা হাতে এসে গেল।
মোড়ল বলল—তবে বাপু, পথ চলবার সময় একটু হুঁসিয়ারও থাকতে হয়। অন্যের কোন রকম ক্ষতি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়।
বাকি টাকাগুলো তুলে দিল দ্বিতীয় জনকে—আশাকরি, তোমার তেলের দামের চেয়েও কিছু বেশিই পেলে তুমি। মনে কোন দুঃখ রেখো না। বাড়ি যাও এখন।
সবাই ধন্য ধন্য করতে লাগল মোড়লের।

Post a Comment

0 Comments