জ্বলদর্চি

অবহেলিত শিল্প এবং কিছু কথা /মিলি ঘোষ

 অবহেলিত শিল্প এবং কিছু কথা
 মিলি ঘোষ 

প্রতিদিনই তো কোনও না কোনও দিবস পালিত হয়। নেটের দুনিয়া এই দিবসগুলিকে চোখের সামনে তুলে ধরে। আজ তেমনই একটি দিন। বিশ্ব নৃত্য দিবস। কেন আজকের দিনটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে তার পেছনে কারণ আছে। আধুনিক ব্যালের জনক জিন-জর্জেস নভেরের জন্মদিন আজ। তাঁকে সম্মান জানাতে আন্তর্জাতিক নৃত্য দিবস হিসেবে আজকের দিনটি উদযাপিত হয়। মানে হওয়ার কথা। মুশকিল হলো নভেরের নাম ক'জন জানেন বা মনে রাখেন। এমন একটি শিল্পের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত, যা এই ২০২৪ সালেও অন্যান্য শিল্পের তুলনায় অবহেলিত। 

ব্যালে দিয়েই শুরু করা যাক। প্রধানত ছয় রকম ব্যালে আছে। তার মধ্যে বিশেষ উল্লেখ্য প্যারিস অপেরা ব্যালে। আমরা যে রাশিয়ান ব্যালে টিভিতে বা অন্য কোনও মাধ্যম থেকে দেখে থাকি, তা সাধারণত টো নির্ভর। অর্থাৎ পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে পরিবেশিত হয়। ঠিকভাবে পরিবেশন করার জন্য প্রচুর অনুশীলন দরকার। এই ধরনের নাচ আয়ত্ত করা অত্যন্ত কঠিন। 
আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরণের নাচের চর্চা আছে। শাস্ত্রীয় নৃত্যের মধ্যে জনপ্রিয় হলো, কথক, ভারতনট্যম, ওডিশি ইত্যাদি। জনপ্রিয়তা কম থাকলেও কথাকলি, মণিপুরি, কুচিপুডি ইত্যাদি নাচও শাস্ত্রীয় নৃত্যের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কোনও নৃত্যনাট্যে রাজার ভূমিকায় বা যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকের ভুনিকায় নৃত্য পরিবেশনার সময় কথাকলি নাচকেই কাজে লাগানো হয়। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কথাকলির প্রতি খুবই আকৃষ্ট ছিলেন। রবীন্দ্রযুগ থেকে শুরু করে আজও বহু রবীন্দ্র সঙ্গীতে কথাকলির প্রয়োগ দেখা যায়। তবুও শিখতে গেলে সেই ভারতনট্যম, সেই কথক নতুবা ওডিশি। মণিপুরি নাচের ক্ষেত্রেও একই কথা আসে। আপাত সহজ মনে হলেও মণিপুরি পুরুষের নাচ অত্যন্ত কঠিন। সবার দ্বারা হয়ও না। তাই প্রয়োগ কম। মণিপুরিতে খোল, পাখোয়াজের বিপুল ব্যবহার আছে। লক্ষ করে দেখবেন, যে সব রবীন্দ্র সঙ্গীতে এই ধরণের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেগুলিতে মণিপুরি নাচের প্রয়োগ চোখে পড়ার মতো। তারপরেও মণিপুরি একটু আড়ালেই থেকে গেছে। 

অনেক ক্ল্যাসিকাল গানের সঙ্গে ভারতনট্যম, কথক, ওডিশি নাচের সঠিক প্রয়োগ চোখের আরাম এনে দিচ্ছে। কোন গানে কী তাল ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা দেখে নিয়ে শিল্পীরা পরিবেশন করছেন। যা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। আর একটা নাচ হলো ফোক। ফোক যেন ফোকের মতোই হয়। অতিরিক্ত স্থুলতায় তা অনেক সময়ই রুচিহীনতার পরিচয় দেয়। ফোক সবথেকে বেশি আকর্ষণীয় হয় দলগত পরিবেশনে। 
নৃত্যগুরু উদয় শংকরের ঘরানা আবার নিজস্বতায় পরিপূর্ণ। তাঁর কন্যা ও পুত্রবধূ যা সসম্মানে এখনো বহন করে যাচ্ছেন।

অনেক কিছুই থেকে গিয়েও হারিয়ে যাচ্ছে।  আবার অনেক কিছুই নতুন ভাবে দেখা দিচ্ছে। যার সবটা গ্রহণযোগ্য নয় কিন্তু বাকিটা মুগ্ধ করে। কোরিওগ্রাফি আজকাল খুবই উন্নত। নাচ নিয়ে প্রচুর কাটাছেঁড়া করছেন এক শ্রেণির মানুষ। তাঁরা প্রত্যেকে গুণী নৃত্যশিল্পী অথবা শিক্ষক। এই কোরিওগ্রাফারদের বেসটা কিন্তু সাংঘাতিক তৈরি। তাল, লয় তাঁদের শিরায় শিরায়। কোথাও কোনও ফাঁক নেই। কোনও না কোনও শাস্ত্রীয় নাচ তাঁদের প্রতিদিনের চর্চায় থাকে। যেহেতু নাচের সঙ্গে কায়িক পরিশ্রমের একটা অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক থাকে, তাই একটা বয়সের পরে নাচ নিয়ে লড়ে যাওয়া খুবই কঠিন ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়। তবু শিক্ষকদের মননে নৃত্য। তাই বেশি বয়সে শিক্ষকতা করায় আন্তরিকতার অভাব থাকে না। সহযোগিতায় থাকে সিনিয়র ছাত্র-ছাত্রীরা। নাচে যে আধুনিকতার জোয়ার এসেছে, তা অবশ্যই মূল নাচকে অসম্মান করে নয়। কিছু ক্ষেত্রে অসম্মান হচ্ছে। যেমন পেছন করে ঢুকে অর্ধেক সময় পেছন করেই পরিবেশন করা। চোখে লাগে। বলতে দ্বিধা নেই, এদের মূল শিক্ষার অভাব আছে। তা নাচের প্রকাশ ভঙ্গিমায় স্পষ্ট। আসলে অনেকেরই ধারণা একটু তাল জ্ঞান থাকলে গানের সঙ্গে হাত পা ছুঁড়লেই সেটা নাচ হয়ে যায়। লিখতে গেলে যেমন পড়তে হয়, গাইতে গেলে যেমন শুনতে হয়, অভিনয় করতে গেলে, খেলতে গেলে যেমন দেখতে হয় তেমন দেখাটা নৃত্যেরও একটি প্রধান অঙ্গ। তার সঙ্গে দরকার প্রচুর অনুশীলন। সহজে বা স্বল্প শিক্ষায় কোনওদিন কিছু হয়নি। কোনও জগতেই নয়। প্রতিভা কম বেশি হতে পারে। কিন্তু পথ যতটা ততটাই হাঁটতে হবে। কোনও উপায় নেই। 
বহু শিক্ষক আছেন, যাঁরা তাঁদের নাচ শেখানোর ঘরটিকে মন্দির বলেন। কারণ, সেখানে আরাধনা হয়। 
তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা ঘুঙুর পড়ার আগে কপালে ঠেকিয়ে ঘুঙুরকে প্রণাম করে নেয়। এর মধ্যে ধর্মকে টেনে আনার দরকার নেই। এটি একটি শিল্পের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধার প্রকাশ। এমন একটি শিল্পের প্রতি যা এখনও শিল্পের তালিকায় একদম শেষের সারিতে।

ওপরের ছবিটি কথাকলি নৃত্যগুরু গোবিন্দন কুট্টির।🙏

🍂

Post a Comment

0 Comments