জ্বলদর্চি

দুয়ারে জেনোসাইড/পর্ব ১ /বাসুদেব গুপ্ত

দুয়ারে জেনোসাইড
পর্ব ১ 
বাসুদেব গুপ্ত

জিরেখালির হালহকিকত

—আমি বুঝলি এই জাতটাকে একদম  সহ্য করতে পারি না। একটা স্যাম্পল দেখলেও আমার গায়ে মনে হয় গরম তেল ছিটকে পড়ে। ঐ যে বলে না গা রি রি, সেই। এই যেমন ধর চা খাচ্ছিস তাতে ঝপ করে একটা আরশোলা পড়ল থ্যস করে, কেমন লাগে? সে শালাকে যে  চটির নীচে চ্যাপটা করে থেঁতলে ঘি বার করে দিব না, সেটাও পারি না। গা ঘিন ঘিন লাগে। 
সুদাম সর্দার  উপুড় হচ্ছেন একবার সোজা হচ্ছেন একবার। নীচের বম্বে ডাইংয়ের বীচ তোয়ালেটা সেই জবরদস্তি সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ আরো আধাঘণ্টার এই মাসাজ চলবে। গায়ে সুরভিত ঘৃতকুমারী দিয়ে ডলা হচ্ছে। মাঝে মাঝেই তানপুরার মত ঝংকার দিয়ে উঠছেন। বোধহয় গা শিরশির করে উঠছে। তখনই গা রি রি করার কথাটা শুরু হয়। 

কাল একজন জমি ফেরত পাবার জন্য আবদার জানিয়ে গেছে। ওপর মহল থেকে অর্ডার আছে ওদের জমি যেন কোনমতেই ফেরত না দেওয়া হয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এতে সুদাম সর্দারেরই   লাভ। জমির লিজের টাকাও দিতে হয় না আর জমির দামও দিতে হবে না। ব্যাটারা গোমুখ্যু  সারা গাঁয়ে পড়াশোনার বালাই নেই, চাষ কর, গুলতানি করো আর ফাঁকা মাসগুলো চোলাই। 
—এই তুই পড়তে পারিস? হাতীর আঙুলের মত মোটা তর্জনী  দিয়ে এক খোঁচা দেন সুদাম ম্যাসিওর জয় মালের পেটে। 

নাঃ পড়তি পারি না। 
—অ আ এ বি সি ডি কিচ্ছু না?
—কিচ্ছু না স্যার। ইস্কুলে গেলাম কোথায়। 
—টাকা পয়সার হিসেব করতে পারিস? এই ধর তুই চল্লিশ দিন কাজ করলি একশদিনের কাজে। তোর পাওনা একশদিনে তিন হাজার। তাহলে চল্লিশ দিনে কত পাবি? সুদাম মোটা ভুরুটা নাচায় প্রশ্ন করতে করতে ।

—আমি জানিনি বাবু। অত আমার গোবর মাথায় ঢুকবে নি। পঞ্চাতের বাবু  যা দেবে নিয়ে নেব। 
এবারে আর খোঁচা নয়, উল্লসিত হয়ে এক থাবড়া। অনেকক্ষণ মালিশের নাম করে পেটাচ্ছিলো তার যেন বদলা। 
—খুব ভালো কয়েছিস। পড়ালেখা শিখলেই  ফালতু মাথা গরম। ইসকুল যাও কলিজ যাও তারপরে মিছিল করে চেঁচাও চাকরি দাও চাকরি দাও করে। আরে খাটবি গতর দিয়ে, পয়সা পাবি পকেট ভরে। না সরকারের কাছে ঘ্যানঘ্যান, আন্দোলন কত কি। চাকরির মাইনে পেয়ে তো আবার চোলাই খেতেই ঢুকবি। এসব খাস টাস?
বিরাট  জিভ বার করে জয় মাল, কান মোলে। হাতের তেল গিয়ে কানটা জবজবে হয়ে যায়
—কি যে বলেন স্যার পয়সা কোথায় ওসব খাবার? খায় না এই ডাহা  মিথ্যেটা বলতে বাধে। 
বলতে বলতে মনে পড়ে স্যার মাঝে মাঝেই বিলিতি খেতে খেতে ঐ  ঘরে যান মেয়ে বৌদের   টোটকা চিকিচ্ছে করতে। তখন ও সুড়ুত করে টেনে দিয়েছে কবার। 

সুদামের রোজ উদাস লাগে ঠিক এই মাসাজের পর। শরীরে  আরাম আর মাথায় ব্যারাম।  গাঁয়ের হাজার চিন্তা মাথায় এসে কা কা করে ডাকতে থাকে। সারা দিন কাজ কাজ কাজ সন্ধেবেলা কখন হবে! আনমনে গান ধরে,
—মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে। 
লিলি, ডোমের মেয়েটা, বড় ভালো মেয়ে। ভাল গান গায়।  বলেছে ওষুধ নিতে আসবে। পিঠে বানিয়ে নিয়ে আসবে। সপ্তায় একদিন করে। শুধু একশ দিনের ফুল টাকাটা ওর চাই। 

🍂

বড় সরকার যে টাকা দিচ্ছে না এটা কে শোনে। আর সেটা না এলে তো পঞ্চাতের     মোড়লদেরই পশ্চাতে ক্যাঁত। হাঁড়িতে ঝাল মাংসের ঝোল রাঁধা বন্ধ। এখন ওদের পেটভাতারি কাজ দেয় সুদাম, আর তার জ্ঞাতি ছিদাম।  সে করে  হলুদমাটি। ছিদাম  লাল। তিরন্গা পতাকায় সবুজের রং যোগ করে  সবুজ দত্ত। ওদের বনেদী বাড়ী তিন তলা। সবুজ পতাকা সবুজ পারটি। । তিন বন্ধু কবে সেই হাফপ্যান্ট বয়স থেকে ইয়ার। তিন  গেরামের তিনজন, ইস্কুল এক, আনন্দময়ী জিরেখালি হাই ইস্কুল। সেদিন  থেকে অনেক ছুরিকাঁচিকোদাল শিক্ষা ও হাতে কলমে ব্যবহার পেরিয়ে তিন জন তিন গাঁয়ের অধীশ্বর। আগে তিনজনে একসঙ্গে কলকাতা ঘুরতে যেত। পার্ক স্ট্রীটের চাইনিজ খেয়ে ফেরার সময় ট্রেন দুলত, খেয়াকে  মনে হত নাগরদোলা। নিওন আলোর নীচে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েমানুষ দেখত। ইচ্ছে হত কিন্তু গাঁয়ের লোক, সাহস হত না। সেসব এখন বন্ধ। এখন দিন কাল বিগড়েছে, আবার ভোট আসছে। শান্তির সংসার, পাঁচ সাল পরে পরে  ভোট  আসে আর চারদিকে আবার ঝাড়পিট শুরু হয়। তিন বন্ধুর তিন পার্টি যে যার গলা টিপতে ব্যস্ত। সেই খেলায় নামতে হয় তিন ইয়ারকেও। 

সুদাম ভাবে, জয় মালদের কিছু যায় আসে না কোন দল এলো আর কোন দল গেলো। এদের পলিটিক নেই, কিন্তু  জিভে জল ঠিক আছে। মাসাজ করে পয়সা নেবে, লুকিয়ে চুরিয়ে মালের এঁটো চাটবে আর দরজার ফুটো দিয়ে লিলির লাচ দেখবে। মৌজা হি মৌজা একেবারে। শালা, নিজেকে কি চালাক ভাবে  এই জনগণ! সুদাম সব জানে, বোকা সেজে থাকে।  ভোট আসছে। এখন চাই জনগণের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। তারপর সপাটে একটা লাথ জনগণের মুখে। তিন পাটির একপাটি তো জিতবেই। সুদাম ছিদাম সবুজ, আহা হা,  আনন্দে জয় হিন্দ ভারতমাতার জয় বলে চেঁচিয়ে ওঠে সুদাম। 


জয় মালেরা  পেটপুরে ভাত ছাড়া কিছুদিন হলো আর কিছু পায় না। টুকটাক জমি ছিল একসময়, দুতিন বিঘে ধানজমি, একটু সব্জি খেতে পেত এটাই তো অনেক।  কিন্তু ঐ জমিগুলো আলাদা বিখরে বিখরে থাকলে মাছের চাষ করা হয় না। ধান পুষ্টিকর না মাছ? এসব বুঝে ওদের  কি লাভ?  তারচেয়ে একদিন অমাবস্যা দেখে জমিগুলো  ঘিরে  নোনা জল ঢুকিয়ে দাও বাস। চাষবাস মায়ের  ভোগে। আর একশদিনের লাইনে একের পর এক মুখে কাপড় ঢাকা  মেয়ে মানুষ। পুরুষগুলো যায় দুবাই, মুম্বাই, চেন্নাই। এখানে তাদের মাগীদের নাই নাই কাজ নাই। লাজও কি আছে? বুঝ গুরু যে জানো সন্ধান। 

—যা, অনেক হয়েছে। এবার ঘর যা। 
—স্যার জমিটা? ছাড়ানো যাবে না?
তেলমাখানো চকচকে ভুঁড়িটা সামলে উঠে বসে পাজামার কষি আঁটেন সুদাম। একবার এদিক দেখেন, একবার ওদিক দেখেন। তারপর ডান পা তুলে হঠাৎ গোদা পায়ে লাথি হাঁকান জয় মালের  পেটে। 
শালা হিজরের পো, আর একবার যদি জমির কথা বলবি তো লাশ পুঁতে দেব। তোর কোন লাল সবুজ দাদাদিদি ও তোকে বাঁচাতে আসবে না।  যা ভাগ। 
জয় মাল আস্তে আস্তে ওঠে, ওর খুব একটা লাগে নি। গোরু মোষের লাথি খাওয়ার অভ্যেস অনেকদিনের। কিন্তু ওর খটকা লাগে ঐ কথাটায়। লাল সবুজ দাদা দিদি.. বাঁচাতে আসবে না সেটা সুদাম স্যার কি করে জানল? তবে কি সত্যিই ভিতরে ভিতরে সাঁট।  তাহলে ঐ যে ওর বৌ সুদাম ছিদাম সবুজকে  চাঁদের আলোয় জমি ঘুরতে দেখেছে সেটা কি সত্যি কথা? সেদিন জয় তার বৌ সীতাকে খুব ডেঁটেছিল। তুই খুব বুঝনদার হলি বটে। হলুদ লাল সবুজ একসাথে মেলে? হতি পারে কখনো!
সীতা মুখে মুখে কথা বলা ছাড়েনি, এই মা মনসার দিব্যি তিনজন সিগ্রেট টানছিল আর জমি গুলো ঘুরি ঘুরি দেখছিলো। ফোন দি ফটোও তুলছিল। আমাকে চিনে না, দেখে হাত লাড়লো। বলে ভয় কি, আয় আয়, আমি এক দৌড়ে পাল্যে এইছি। 
জয়মাল আবার বোঝাতে গেল, একদল সাম্প্রদায়িক, একদল সমাজতান্ত্রিক আর এক দল দলতান্ত্রিক। এরা এক হবে কি করে? 
কেন এক ফেলাগে তিনটি রং নেই? সাধিনতার পর থেকেই তো আছে। সাধিনতা দিবসে তুমরা তোল না?
জয়মাল হাল ছেড়ে দিয়ে সীতার কোমরটা জড়িয়ে গালে একটা চকাস করে চুমু দিয়ে বলল যা চাল বসা। খিদে পেয়েছে। 
সীতা মুখ ঝামরে বলে, অ, আমি ভাবলাম অন্য খিদে। ঠিক আছে। 
জয়ের সব ভিডিওর মত মনে পড়ছিলো। সীতা বেশি বোঝে গণতান্ত্রিক ব্যাপার স্যাপার। দু বছর লুকিয়ে লুকিয়ে নয়া পার্টির ক্লাস করে তার এখনও ধোঁয়া ধোঁয়া লাগে। কে যে বন্ধু কে যে শত্রু?


Post a Comment

0 Comments