জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫০ /বিজন সাহা

মুক্তি সেনা

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫০ 

বিজন সাহা 

সারাতভের সকাল 


১৮১২ সালের পিতৃভূমির যুদ্ধ সারাতভের জনজীবনে পরিবর্তন নিয়ে আসে। সারাতভের অনেক সেনা রাষ্ট্রীয় পদক পায়, আর তিন জন সোনার তলোয়ার উপহার পায় যেখানে লেখা ছিল – সাহসের জন্য। ১৮১৩ সালে সারাতভে যুদ্ধবন্দী ফ্রান্স সেনাদের এনে তাদের শহর নির্মাণের কাজে ব্যবহার করা হয়। পরে এদের অনেকেই রাশিয়ার নাগরিকত্ব গ্রহণ করে জার্মান বস্তিতে বসবাস করতে শুরু করে। এদের অনেকেই গৃহশিক্ষক, শিক্ষক, চর্মকার, সূত্রধর ইত্যাদি পেশায় নিয়োজিত হয়। ফ্রান্সের বিরুদ্ধের বিজয়ের স্মৃতি হিসেবে সারাতভের কেন্দ্রে আলেক্সান্দর নেভস্কি গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়। নিকোলাই পাভলোভিচের রাজত্বকালে সারাতভে জেল, দুর্গ, গ্যারিসন, অগ্নি নির্বাপক টাওয়ার ইত্যাদি গড়ে ওঠে। ১৮২৮ সালে এখানে টোব্যাকো কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়াও এখানে দড়ি, চর্ম, ঘন্টা ও ইটের কারখানা গড়ে ওঠে। তাঁতিরা সারপিনকা নামে স্বল্প মূল্যের কাপড় উৎপাদন শুরু করে। এই সারপিনকার জন্মস্থান ছিল সারেপ্তা নামে এক জার্মান বস্তি যেখানে আমরা যাব ভোলগাগ্রাদ ভ্রমণের সময়। আঠারো শতকের শেষ ও উনিশ শতকের শুরুতে সারাতভে বিভিন্ন স্থাপনা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ১৭৮৬ সালে পাবলিক স্কুল, ১৭৯৪ সালে ছাপাখানা, ১৮০৬ সালে আলেক্সান্দর হাসপাতাল, সিনেট হাউজ (১৮০৭), শপিং মল (১৮১১), ছেলেদের জিমনেশিয়াম বা আবাসিক স্কুল (১৮২০), স্পাসো-প্রিওব্রাঝেনস্কি সাবর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৮৩০ ও ১৮৪৮ সালে শহরে কলেরার প্রাদুর্ভাব হয়, ১৮৩০ সালে এতে প্রায় দশ হাজার মানুষ মারা যায়। ১৮৪৪ সালে শহরের দুমা বা পৌর সভার নতুন ভবন উদ্বোধন করা হয়। ১৮৮২ সালে সারাতভের স্টক একচেঞ্জ কাজ করত শুরু করে। ধীরে ধীরে ভোলগা রাশিয়ার প্রধান জলপথে পরিণত হয় আর সারাতভ পরিণত হয় বিশাল নদীবন্দরে। বাড়তে থাকে শহরের জনসংখ্যা, বদলে যায় শহরের রূপ। ১৮৭১ সালে তামবভ – সারাতভ রেলপথ তৈরি হলে সারাতভ মস্কো, সাঙ্কত পিতেরবুরগ ও বাল্টিক সাগরের বিভিন্ন বন্দরের সাথে সংযুক্ত হয় যা সারতভের শিল্পোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। ১৯১৬ সালে সারাতভে ইনডোর বাজার উদ্বোধন করা হয়। উনিশ শতকের শেষ দিকে সারাতভের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল রুটি। এ সময় সারাতভ রাশিয়ায় গম ও আটার বানিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।   

নিস্তব্ধ ঘন্টা

১৯৪১ – ১৯৪৫ সালের মহান পিতৃভূমির যুদ্ধের সময় সারাতভে শিল্পায়ন ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চল থেকে কল কারখানা ও সেনাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এখানে নিয়ে আসা হয়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আহত সেনাদের এখানে এনে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। এখানে ত্রিশটি হাসপাতাল কাজ করে, সারাতভ থেকে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ এসব সরবরাহ করা হতে থাকে যুদ্ধক্ষেত্রে। ১৯৯০ সালে পর্যন্ত সারাতভ বিদেশীদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ বা বন্ধ শহর অর্থাৎ সারাতভে বিদেশীদের আগমনের অনুমতি দেয়া হত না। এর মূল কারণ এখানে বেশ কিছু অস্ত্র নির্মাণের কলকারখানার অবস্থান। ছিল সারাতভ বিমান কারখানা যেখানে সামরিক ও বেসামরিক উভয় প্রকারের বিমান তৈরি হত। এছাড়াও সারাতভের অনেক কলকারখানা সোভিয়েত মাহাকাশ প্রোগ্রামের সাথে যুক্ত ছিল। এ কারণেই সারাতভে কোন বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রী ছিল না, আর আমারও কাউকে চিঠি লেখা হয়নি। তবে সারাতভ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই দুবনায় কাজ করে, অনেকের সাথেই আমার ঘনিষ্ঠতা বিধায় দিলীপের জন্য কিছু করা যায় কিনা সেই চেষ্টা করলাম। মনে পড়ল সাশা গুসেভের কথা। ওকে ফোন করলে জানালো, এখানে ওর পরিচিত কেউ আর নেই এখন তাই কোন রকমের সাহায্য করা সম্ভব হবে না। পরে আমি জেনেছি ও আসলে বেলগোরাদ থেকে, সারাতভে পড়াশুনা করত, এখন দুবনায় কাজ করে। সারাতভের চেরনিশেভ বিশ্ববিদ্যালয় বেশ নামকরা। ভাভিলভ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও গাগারিনের নামানুসারে আছে দুই দুটো বিশ্ববিদ্যালয়। গাগারিন এখানেই পড়াশুনা করেছেন বিধায় তিনি এই শহরের অন্যতম প্রধান ব্র্যান্ড। ভোলগা তীরে শোভা পাচ্ছে তাঁর স্ট্যাচু। তবে সেই সময় এই এলাকায় নির্মাণ কাজ চলছিল বলে কাছ থেকে দেখা হয়নি। দূর থেকে ছবি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। তবে এই নির্মাণ কাজ রুটিন মাফিক নাকি কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে সেটা ঠিক জানা নেই। আসলে রাশিয়ার ভোলগা তীরের অনেক শহর এবং অনেক ঐতিহাসিক শহর এখন জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। বিশেষ করে গ্রীষ্মে এখানে প্রচুর পরিব্রাজক আসে। আর গ্রীষ্ম শেষ হলেই এসব শহরে শুরু হয় নির্মাণ কাজ, শহর প্রস্তুত করা হয় আসন্ন শীত আর পরবর্তী গ্রীষ্মের জন্য। বিশেষ করে নদী তীর ও অন্যান্য জনপ্রিয় এলাকা। 

রাশিয়ার প্রয় প্রতিটি শহরেই আছে স্মৃতিসৌধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেনাদের মহান আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এসব মেমোরিয়াল তৈরি করা হয়েছে। সকালে উঠেই আমরা সেদিকে রওনা হলাম। যদিও গতকাল বিকেলে আমরা এদিক দিয়েই গেছি, আজ খেয়াল করলাম ভোলগার উপর বিশাল সেতু। অনেকটা দুই কুঁজওয়ালা উটের মত। বিশেষ করে উপর থেকে দেখলে সেটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিশাল এই মেমোরিয়ালের মূল সৌধ সোকোলিনো গরি বা বাজপাখি পাহাড় চূড়ায় একদল বলাকা। মুক্তির সংবাদ নিয়ে উড়ে যেতে চাইছে। অনেক সিঁড়ি বয়ে উঠতে হলেও এখান থেকে পুরো শহরটা হাতের মুঠোয় চলে আসে। দূরে দেখা যাচ্ছিল গির্জা, সিনাগগ ইত্যাদি। এখান থেকে বিশাল বিশাল দালানকোঠা মনে হচ্ছিল একতলা বাড়ির মত।


🍂

 মেমোরিয়ালে বেশ কিছু স্থাপনা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এদের একটি মুক্তি সেনার স্ট্যাচু। প্রথমে ভেবেছিলাম বার্লিন থেকে তুলে এনেছে কিনা। আসলে এটা বার্লিনের সেই বিখ্যাত স্ট্যাচুর কপি, মূল স্ট্যাচুর চেয়ে তিন গুণ ছোট, কিন্তু অবিকল কপি – এক সোভিয়েত সেনা জার্মান এক শিশুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে জার্মান সেনারা শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে এ দেশের মানুষদের হত্যা করেছিল, সোভিয়েত সেনাদের বেসামরিক লোক বিশেষ করে শিশু বৃদ্ধ ও মহিলাদের উপর অত্যাচার না করার নির্দেশ ছিল। মার্শাল ঝুকভের কড়া নির্দেশ ছিল এরকম কিছু কেউ করলে তাকে সাথে সাথে গুলি করার। এটা কতখানি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আর কতটা সেনা বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য সেটা অবশ্য বিতর্কের বিষয়। আড়াই মিটার উঁচু পলিমারের তৈরি এই মনুমেন্টের ওজন মাত্র ৪০০ কিলোগ্রাম। অসংখ্য স্ট্যাচুর মধ্যে আরও একটি মনুমেন্ট এখনও মনে গেঁথে আছে। সেটা যুদ্ধে মৃত সারাতভের মানুষের স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি নিস্তব্ধ ঘণ্টা – এই সৌধের নীচে শ্বেত পাথরে খোঁদাই করে লেখা – যারা রাশিয়ায় কাঁদছে তাদের অশ্রু জমে গেছে। স্তব্ধ হয়ে গেছে ঘন্টা। এখানে স্মৃতিসৌধগুলোয় আরেকটা জিনিস মনকে খুব নাড়া দেয়। সেটা হল মিউজিক। সব মিলিয়ে একটা গুরুগম্ভীর পরিবেশ। বিভিন্ন মনুমেন্টের সামনে তাজা ফুল দেখে বোঝা যায় – মানুষ নিয়মিত এখানে আসে, মনে করে কী মূল্য তাদের দিতে হয়েছিল ফ্যাসিবাদের থাবা থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য। এটাও মনে হয় এ দেশের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। 

অনির্বাণ শিখা

প্রায় ঘণ্টা খানেক মেমোরিয়ালে কাটিয়ে আমরা গেলাম ভোলগা তীরে। সাতারের মৌসুম শেষ। পুরাদমে চলছে নির্মাণ কাজ। একটু দূরে গাগারিনের স্ট্যাচু। খুব ইচ্ছে ছিল কাছে গিয়ে দেখা। কিন্তু সে আশার গুঁড়ে বালি। তবুও যতটুকু কাছে যাওয়া যায় ততটুকু গিয়ে বেশকিছু ছবি তুললাম। একটা কথা না বললেই নয়, যদিও ভোলগা স্নান বা রৌদ্র স্নানের জন্য ভোলগা তীর বন্ধ, খাবারের দোকান কিন্তু ঠিকই কাজ করছে। সেখানেই আমরা সকালের খাবার খেয়ে নেবার পরিকল্পনা করলাম। এখনও আউটডোর খাবারের ব্যবস্থা আছে। আমরা বাইরেই বসলাম। ধীরে ধীরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন ভোলগাগ্রাদের দিকে রওনা হব, চোখে পড়ল এক গির্জা। যথারীতি কিছু ছবি তুলে গাড়িতে উঠলাম। সারাতভ শহর তৈরি হয়েছিল সামারা ও ভোলগাগ্রাদের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। তার মানে সামনে আমাদের প্রায় ৪০০ কিলোমিটার পথ। যদিও এখন মনে হয় এই শহরে নতুন নেতা, তবুও বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল দ্মিত্রি আইয়াৎস্কভের মুখ। নব্বুইয়ের দশকে রাশিয়ার রাজনৈতিক মঞ্চে সারাতভের এই গভর্নরকে প্রায়ই দেখা যেত। তবে সেই সময়ের অনেকের মতই তিনিও এখন রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে হারিয়ে গেছেন। বা হতে পারে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের পাশে তাদের যতটা উজ্জ্বল মনে হত শক্তিশালী পুতিনের পাশে তাদের ততটাই ফিকে মনে হয়।      

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments