জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৯/ বিজন সাহা

সারাতভের সেতু

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৯ 

বিজন সাহা 

সারাতভ 

সারাতভ প্রদেশে আমরা অনেক আগেই ঢুকে পড়েছি। মস্কো থেকে শুরু করে এতটা পথ এলাম, তাতে উগলিচের আগে কিলোমিটার দুয়েক পথ বাদ দিলে সমস্ত রাস্তাই ছিল মসৃণ। কিন্তু সারাতভে সমস্ত পথটাই কেমন ঝাঁকুনিপূর্ণ মনে হল। মনে হল অন্য কোন দেশে চলে এসেছি। এখানে আসলে রাস্তা ঘাটের মালিকানা বিভিন্ন ধরণের। কিছু আছে ফেডারেল হাইওয়ে যেটার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের, আছে প্রাদেশিক রাস্তা, আছে মিউনিসিপ্যাল রাস্তা। মালিকানার উপর নির্ভর করে বাজেট, আর বাজেটের উপর রাস্তার স্বাস্থ্য। আমার মনে আছে অনেক পুরানো এক ঘটনার কথা। তখন ছেলেমেয়েরা ছোট। পেরাম্বুলেটরে ওদের চলাফেরা। রাস্তায় রেল লাইন পেরুতে হয়। এক সময় পায়েচলা রাস্তা মেরামত করছে, অথচ রেল লাইনের ওখানটা ওভাবেই রেখে দিয়েছে। কেন সেটা ঠিক করছে না জিজ্ঞেস করায় বলল, এটার মালিক রেলওয়ে। চাইলেও ওদের স্পেশাল পারমিশন ছাড়া আমরা ওখানে হাত দিতে পারব না। যাহোক, এই প্রথম জার্নিটা বেশ ক্লান্তিকর মনে হল। সামারা থেকে আমরা বেরিয়েছিলাম সকাল সাড়ে নয়টার দিকে। পথে পুগাচেভে নেমে, গরুর পালের ছবি তুলে আমরা যখন সারাতভ পৌঁছুলাম বিকেল হয়ে গেছে। রাস্তাও খুব একটা কম নয় – প্রায় ৪১০ কিলোমিটার। দেমিদ জোরে টানতে চাইলেও দিলীপ রাজি হয় না। আমরা ধীরে সুস্থে সামনের দিকে এগুই। পথে দেমিদ থাকার জায়গা খুঁজে। একটা অফার ছিল শহরের বাইরে। অনেক ভেবে ঠিক হল শহরের ভেতরে কোথাও থাকব। একটা বাসা পাওয়া গেল। সব মিলিয়ে খারাপ নয়, তবে এসে একটু হতাশ হলাম। পুরানো বাড়ি, পাঁচ তলা, কিন্তু কোন লিফট নেই। জিনিসপত্র নিয়ে ওখানে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। দিলীপ বলল অন্য কিছু দেখতে। কিন্তু সারাদিনের জার্নিতে খুব টায়ার্ড। তাই কষ্ট হলেও রাতটা সেখানেই কাটানো ঠিক হল। তবে এটা ঠিক নীচে নামতে হবে নৈশ ভোজের জন্য। এই দীর্ঘ ভ্রমণে বিভিন্ন জায়গায় থেকেছি। প্রায় সব জায়গায়ই ছিল ভালো ব্যবস্থা। কিন্তু সেসব বাসার কথা তেমন মনে নেই। আর এই বাসার ছবি ঠিকই চোখের সামনে ভাসছে। কেন? বেশ কয়েক বছর আগে ফেসবুকে একটি গল্প পড়েছিলাম। এক শিক্ষক একটি সাদা ক্যানভাসে এক ফোঁটা কালি ফেলে সেই বিষয়ে রচনা লিখতে বললেন। সবাই লিখল সেই কালো দাগের কথা। শিক্ষক বললেন, বিশাল সাদা জমিন তাদের চোখে পড়ল না, অথচ একফোঁটা কালি তাদের চোখে পড়ল। মানুষ শুধু খারাপ দিকটা দেখে। আমি কমেন্টে লিখলাম এটা শিক্ষকের ভুল ধারণা। তিনি যদি কালো ক্যানভাসে সাদা ফোঁটা ফেলতেন তাহলে ঠিকই সবাই ঐ সাদা ফোঁটার কথাই লিখত। প্রশ্ন সাদা বা কালোয় নয়, প্রশ্ন কন্ট্রাস্টে। যখন সব কিছু খারাপ তখন হঠাৎ ভালো কিছু যেমন চোখে পড়ে, মনে থাকে, ঠিক একই ভাবে যখন সব ভালো তখন এমন খারাপ কিছুই আমাদের মনে থাকে। এই যে প্রতিদিন আমাদের কেউ একটু হাসি মুখে সম্ভাষণ করছে, মেট্রোয় দরজাটা ধরে যেতে দিচ্ছে – প্রতি নিয়ত হাজার হাজার কাজ করছে আমরা এসব মনে রাখি না, কিন্তু কেউ একটু গালি দিয়েই সেটা মনে রাখি। সারাতভের রাস্তা বা সেই সিঁড়ি ভেঙ্গে পাঁচ তলায় ওঠা এ সবই আমাদের খুব মনে আছে – কারণ প্রায় আইডিয়াল জার্নির মধ্যে এটা ছিল একটু ব্যতিক্রম। 

সেই রাতে আমাদের কিছুই দেখা হয়নি। বাসায় ফিরে আমি যোগাযোগ করলাম সাশা গুসেভের সাথে। সারাতভ ইউনিভার্সিটির অনেক প্রাক্তন ছাত্র আমাদের ইনস্টিটিউটে কাজ করে। সাশা ওদের একজন। আমার ধারণা ছিল ও এখান থেকেই। তবে ও অনেক দিন আগেই এখান থেকে চলে গেছে। পরিচিত কেউ এখন আর নেই। পরে অবশ্য জেনেছি ওর বাড়ি আসলে বেলগোরাদে। এখানে দিলীপের ইচ্ছে ছিল ইউরি গাগারিনের স্ট্যাচুর ছবি তোলা। ইউরি গাগারিন এখানেই পড়াশুনা করেছেন মানে সামরিক ট্রেনিং নিয়েছেন।  

ধারণা করা হয় যে সারাতভ নামের উৎস সকলোভা গারা বা বাজপাখির পাহাড় থেকে তুর্ক ভাষায় যার নাম সারি তাউ মানে হলুদ পাহাড়। সারি তাউ – হলুদ পাহাড় শব্দটি এসেছে হলুদ পেটের সাপের মত দেখতে সর্পাকৃতি পাথর থেকে। ভালুক দ্বীপে সারাতভ দুর্গের বিপরীত দিকে তেরেশকা নদীর মোহনায় এই হলুদ পাহাড় অবস্থিত। পরে কাস্পিয়ান সাগরের সাপের নামানুসারে এই দ্বীপের নাম রাখা হয় চারদীমস্কি। মতান্তরে, সার আতাব বা নীচু দ্বীপ অথবা সারীক আতাব বা বাজপাখির দ্বীপ নাম থেকে সারাতভ শব্দের উৎপত্তি। অন্য এক মতবাদ অনুসারে স্কিফ ও ইরানী শব্দ সারাত থেকে সারাতভ তার নাম পেয়েছে। এছাড়াও সারাতভের নামকরণ নিয়ে আরও অনেক মতবাদ বিদ্যমান।     

🍂

প্রিন্স গ্রেগরি জাসেকিন ও বয়ার ফিওদর তুরভ সামারা ও ৎসারিৎসিনোর মাঝ পথে ১৫৯০ সালে সারাতভ শহরের গোড়াপত্তন করেন। প্রথম ঠিক কোন জায়গায় শহর স্থাপন করা হয়েছিল সেটা এখন অজানা। ১৬১৩ – ১৬১৪ সালের শীতে শহর অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংস হয়ে যায়। ১৬১৭ সালে ভোলগার বাম তীরে সারাতভকা নদীর মোহনায় নতুন করে এই শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৬৭৪ সালে জার আলেক্সেই মিখাইলোভিচের আদেশে শহর ভোলগার দক্ষিণ তীরে সরিয়ে আনা হয়। এভাবে রুশ সেনাপতিরা সারাতভ শহর ১৫৯০, ১৬১৭ ও ১৬৭৪ সালে তিন তিন বার প্রতিষ্ঠা করেন এবং প্রতিবারই সেটা করা হয় নতুন নতুন জায়গায়। বর্তমানে সকলোভা গারা বা চিলের পাহাড়ের দক্ষিণে কর্নেল আলেক্সান্দর শেল নতুন শহরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। এই পাহাড়টি এখন সারাতভের জনপ্রিয় স্থানের একটি যেখান থেকে শহরের কেন্দ্র পুরোটাই দেখা যায়।    

সারাতভ শহরের একাংশ

পুরো সপ্তাদশ শতক জুড়ে দস্যু, কালমিকি ও কুবানের তাতারদের আক্রমণের শিকার হয়েছে সারাতভ ও তার আশেপাশের অঞ্চল। এই আক্রমণ চলতে থাকে অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত। ১৬৭০ সালে স্তেপান রাজিন তিন দিন ব্যাপি সারাতভ লুট করে। ১৯৭০ সালে বুলাভিনের সেনারা সারাতভ অবরোধ করে। বহু দিন পর্যন্ত ভূমি চাষকারী জনগণ এখানে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে পারেনি। যারা কসাকদের স্বাধীন জীবন পছন্দ করত আর যারা শাস্তির ভয় না করে ভোলগায় ডাকাতি করতে পছন্দ করত – শুধু তারাই এখানে বসবাস করত। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য প্রথম পিওতর ৎসারিৎসিনোয় গার্ড লাইন তৈরি সহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভোলগার দক্ষিণ পাড়ে বসবাসের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ১৭০৮ সালে সারাতভ কাজান প্রদেশের সাথে যুক্ত করা হয়। ১৭১৮ সালে সারাতভ আস্ত্রাখান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হলেও ১৭২৮ সালে পুনরায় কাজানের সাথে যুক্ত হয়, যদিও ১৭৩৯ সালে আবার আস্ত্রাখানে ফিরে যায়। ১৭৪৭ সালে লবন প্রশাসন প্রতিষ্ঠা হলে শহর দ্রুত বিকাশ লাভ করে। সারাতভের বিপরীতে লবন ব্যবসায়ীরা পাক্রভস্কায়া স্লবদা প্রতিষ্ঠা করে। মস্কো থেকে তুলনামূলক স্বল্প দূরত্বে অবস্থানের কারণে সারাতভ মৎস্য ও লবন বিক্রির এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৭৫০ সালে সারাতভ থেকে ৩২৬৪ টন মাছ রপ্তানি করা হয়। উল্লেখ করা যেতে পাড়ে যে ২০০৫ সালে এখানে মাত্র ১৮০০ টন মাছ ধরা হয়েছিল। সম্রাজ্ঞী দ্বিতীয় ইয়েকাতেরিনার নির্দেশে স্তারোভের বা পুরানোপন্থীদের উপর অত্যাচার বন্ধ করে ভোলগা তীরে তাদের জন্য জমি বরাদ্দ করা হয়। ১৭৬৩ সালে ভোলগা তীরে ও নভরসিয়ার ফাঁকা জমিতে বসবাস করার জন্য বিদেশীদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৭৬৬ সালে এখানে বিদেশীদের অভিভাবক অফিস খোলা হলে সারাতভ ভোলগা তীরে জার্মানদের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে পরিণত হয়।  এমেলিয়ান পুগাচভ সারাতভের তার শেষ বিজয় অর্জন করে। ১৭৭৪ সালের আগস্ট মাসে তার সেনাবাহিনী সারাতভ দখল করে। তবে অচিরেই মিখেলসনের সরকারি বাহিনী শহর পুনরোদ্ধার করে। ১৭৮০ সালে সারাতভ শহর সারাতভ প্রদেশের কেন্দ্রে পরিণত হয়।  

সারাতভের ভিডিও 

https://www.youtube.com/watch?v=QDFLSNL3C8g&t=8s

সারাতভের ছবি

http://bijansaha.ru/album.php?tag=259

Post a Comment

0 Comments