জ্বলদর্চি

তন্ময় পৃথিবী মন্ময়-মোহন মঙ্গলমালা /তনুশ্রী ভট্টাচার্য

তন্ময় পৃথিবী মন্ময়-মোহন মঙ্গলমালা 

তনুশ্রী ভট্টাচার্য 

রক্তাক্ত আকাশ থেকে নুনের শরীর 
তোমার ফাঁকা দুপুর বেলায় 
 আমি ত্রিভুজ এঁকেছিলাম ---

জ্যামিতিক ব্যঞ্জনায় আত্ম স্বরূপ উদ্ঘাটনের অকপট স্বীকারোক্তির মানসিক সৌকর্য সমন্বিত ভূমি ও ভূমার বন্ধনে  জীবনের  মোহন মঙ্গল মালা রচনা করেছেন  কবি ঋত্বিক ত্রিপাঠী তাঁর "কীলক‌লিপিতে ভূমি ও ভূমা"  কাব্যগ্রন্থে। প্রথম কবিতা "আত্মস্বীকার" যেখানে অকপটে কবি ঋণ স্বীকার করেছেন। আসলে আত্ম স্বরূপ উদঘাটন কখনোই চূড়ান্ত হয় না। কবি কোন রাখ ঢাক না করেই বলেছেন "আমাদের আত্মস্বরূপ চিরকাল দুহাতে ঢেকে রাখা"--অকপট স্বীকারোক্তি বৈ কি। শিশুর সারল্যে কবি নিজেই মজেন আনন্দে  এবং পাঠককে মজিয়ে  দেন-- "আশ্চর্য নত তলের আনন্দ ভৈরবীতে মজে আছি / কোন দুঃখই দুঃখ নয় এখন আমার।" আনন্দ বিহারী কবির এ এক দর্শন। রাবীন্দ্রিক দর্শন। ভারতীয় দর্শন তো বটেই। জীবনের চলার পথে  ত্রিভুজ আরো বিভক্ত হয়, যতি চিহ্নে বিশ্লিষ্ট হয়। কবি জানেন জীবন কখনো মিলবে না তবুও যাত্রা করেন। এই গতিময়তার দর্শন সমৃদ্ধ কবিতাগুলিতে পাঠক সন্ধান পাবেন এক তীব্র চলমানতা -- এক অমোঘ মন্ত্রস্বরূপ। উত্তর আধুনিক সংজ্ঞায় নিয়ত বাঁক নিয়ে চলে সমাজ সভ্যতায় মানুষের ভূমিকা। অস্তিবাদী দর্শন রক্তমাংসের মানুষকেই কেন্দ্রাতিগ করে। কবির কলমে সেই সুর-- "কোন মানুষকেই গভীরভাবে নিয়ো না।/ নিতে গেলে আত্মা মরে যায়। মানুষ তো মানুষই।' মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মত এই কথায় এখনো বুকে বল জাগে।শুধু তাই নয়  এ সেই পুরাণবাণী--আত্মানং বিদ্ধি।--Know Thyself.। কবি রচনা করেছেন "ভুবনকথামালা"। কখনো অবিনাশী গাছ, কখনো স্বর্ণ সন্ধানী আমাদের আয়ু, কখনো চন্দ্রাহত  নদীরা হয়েছে গাছ, গাছ হয়েছে নদী। দৃশ্য পট বদল হয়েছে তবুও মঙ্গল ঘটখানি রয়েছে কানায় কানায় পূর্ণ। ত্রিভুজ, বৃত্ত, কেন্দ্র, ব্যাস, ব্যাসার্ধ, সমকোণ ইত্যাদি জ্যামিতিক ব্যঞ্জনায় কবি জীবনের স্বাদ গ্রহণ করেছেন। আগুয়ান হয়েছেন অনিবার্যতার দিকে ধীরে ধীরে। মহাকাশ উত্তর কথা, অভিজাত ডুবোজাহাজ, সোনার কাঠি রুপোর কাঠি, বিস্ময়চিহ্ন -- প্রভৃতি মেধাবী কবিতায় কবিকে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। বোঝাযায় তাঁর ভাবনার ব্যাপ্তি ও গূঢ়ত্ব। বিজ্ঞানের সাধনা  আর কবিতার আরাধনা  এক সরলরেখায় চলে।কোনো দ্বৈরথ নেই। তার পরিচয় এমনটা--কৃষ্ণবিবরের শ্বাস নিয়ে স্টিফেন হকিং প্রবন্ধ লেখেন । কবিও পারেন সেই সৃষ্টিরহস্য কবিতায় ধরতে। এখানেই কবিতার জিৎ।         নোয়াম চমস্কি, আনন্দপটবর্ধন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, লিন্ডেম্যান অনায়াসে তাঁর কবিতায় ঢুকে পড়েন। সম্পৃক্ত হয়ে যান কবিতার অবয়বে।  কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাতেই আমাদের জন্মঋণ শোধের ঈপ্সা--"বিশ্ববৈভবের কাছে সবারই খরস্রোতা ঋণ, মনোযোগ ও আকর্ষণ"-- (মাঠ পেরোচ্ছে শকুন মান্ডি')। আত্মশুদ্ধির প্রয়াস না থাকলে মানুষ‌ বুঝি আর মানুষ থাকে না। "বিপ্রতীপ" কবিতায় কবির কন্ঠে প্রত্যয়--'বিপরীতেই হয় বন্ধুত্ব গভীর, আত্মশুদ্ধি-------
 ভয় ও সংকর ধানের হে প্রিয় গ্রাম
 পিঠে পিঠ দৌরাত্ম্য ও গ্লানি অভিমানেই
 ধ্বংস ,অভিমানে শত গদ্য পদ্যমুখী---- 
আহা--যেন এক  সদ্যপ্রস্ফুটিত  পদ্মের  বিন্যাস। অনুশীলিত পাঠক বুঝবেন  একটি কবিতার জন্মক্ষণ !

কবিতা গুলির নিবিড় পাঠে বোঝা যায় কিভাবে সেগুলি বাঁক নিচ্ছে। "ফলশ্রুতি"  কবিতায় প্রথম পংক্তি একটি মন্তব্যপ্রকরণের বাক্য--"মিথ্যা নয় কোন কিছুই সব অমোঘ, স্মরণীয়"। "বড় প্রয়োজন, রোদের। যেহেতু বছর শেষে এখন শীতকাল। মাথার ওপর বাংলার ঘুড়ি উড়ছে। ছায়াহীন। অলস, বহু ব্যবহৃত পংক্তির মত সংখ্যাতীত"--(ডিসেম্বর)--কবিতার মায়া ছাড়িয়ে এ উচ্চারণ দৈনন্দিনতাকে প্রশ্রয় দেয়। "মানুষের কথা মানুষকেই বলতে হয়, বেশি করে।
" মানুষের কথা ততটাই যতটা বৃত্তের পরিধি।--(মানুষের কথা: এক )--
"বস্তুত, সময়ের দ্বিধা নিয়েই মানুষ থেকেছে মানুষের পাশে"। --(মানুষের কথা :দুই )‌ 
এখানে কবির আড়াল করার  কোনো চেষ্টা নেই। নির্মোহ ভাবে বলে চলেছেন মানুষের কথা। মানবীয় দর্শন। কবি জানেন গভীর ঋণের কথা, কবি জানেন জীবন এক নিমগ্নতা ,শান্তি আঁচল মহিমা, এক উন্মোচন।
নদীর উচ্চ মধ্য নিম্ন ধারার মতোই কবিতাগুলো গতিবদল করছে। "অলৌকিক প্রকল্প "থেকে পরবর্তী কবিতাগুলোতে এক অমলজ্যোৎস্নার আলোছায়া খেলা।"ত্বকের যত্ন নেয় জল" -- পড়লেই মনটা যেন ভিজে যায়। জলের ঐতিহ্যে পাঠক লোভী হবেন নতুন গল্প পড়ার আশায়।চোখ বন্ধ করে শুনে নেবেন জল সম্পর্কিত রূপকথা । "জল থেকে চিরকালের মতো ডাঙায় উঠে বলেছি প্রাণ হে "-- এ বড় স্নিগ্ধ উচ্চারণ। "হলুদ বিকেল" এমনই একটি মেদুর কবিতা--" যে যা বলে বলুক ,হলুদ বিকেল/ আমি তোমাকেই বলি দহন অনুরাগ"-- কিশলয় প্রেমের সলজ্জ উচ্চারণ।

ইচ্ছাপত্রে লেখা থাকে উচ্ছ্বাস ও অঙ্গীকারের বহুবর্ণ চেতনা । সেই চেতনায় জারিত হয়ে কবি রচনা করেন ঋতরূপ। যেখানে বর্ণময় পলাশ, কাঁচা মাটির রাস্তা আর পদচিহ্নে জমে থাকে জল। থাকে আলোকবর্তিকা। শেষ নিঃশ্বাস। ভেতরে ভেতরে একটা শিরশিরানি অনুভব করি পাঠক হিসেবে। যেন চোখের সামনে কেউ একজন শেষ নিঃশ্বাস ফেলে । যেন জমে থাকা জলে আকাশের প্রতিবিম্ব। ভেসে যায় ছিন্ন দলাপাকানো পুষ্প মালা। জ্বলে ওঠে হারিয়ে যাওয়া দিনলিপি। লুকানো চিঠি চন্দ্রাহত নদীতে মিশে যায়। যেন কোথাও একটা চূড়ান্ত পর্বে পৌঁছে যাওয়া। কবি হাত ধরে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন সেই কিনারে। সেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে। কিন্তু তবুও থাকে মুগ্ধতা। শান্তি পুরুষের আঙুল ছুঁয়ে দেখার অনুভব। কারণ এদিকে তৈরি হয়ে উঠছে ভূমি ও ভূমা। যে ভূমিতে এতক্ষণের বিচরণ তা যদি কর্ষণ  অযোগ্য হয় তাও সেখানে রচিত হবে নতুন সংলাপ। সমাসবদ্ধ রোদনের গানের নতুন সুরে গাওয়া হবে আনন্দ গান। "আনন্দম্ যদবিভতি"।‌ আনন্দ হি কেবলম্।

পুরো কাব্যগ্রন্থটিই জ্যামিতিক দ্যোতনায় জীবনের মিথোস্ক্রিয়াকে ব্যক্ত করেছেন। যথেষ্ট মুন্সিয়ানায় সেই প্রয়োগ  কবিতার অঙ্গ হয়ে উঠেছে। মেধাবী কবিতাগুলির জন্য অনুশীলিত মনের বৈদ্যগ্ধ ও উপলব্ধি থাকা দরকার। মাঝে মাঝেই থমকাতে হয়। ভাবতে হয় ।কোন কোন কবিতা এক নিঃশ্বাসে পড়া যায়। আবার বেশ কিছু কবিতা তিনবার পর্যন্ত পড়িয়ে নেয়।  খনিতে নীলকান্তমণির এত  উজ্জ্বল্য থাকে না  তার বিশুদ্ধ রূপ শোধন করে নিতে হয়। কবিতা গুলি পড়তে গেলে পাঠককে শোধন করে নিতে হয় তার দৃষ্টি ও মনন। শুধু চোখ ধাঁধানো শব্দ দিয়ে নয় নতুন নতুন শব্দ বন্ধ উৎসারিত মায়া জাদু পাঠককে ভাবায়, চুম্বকের মত আকৃষ্ট করে রাখে। হয়তো কিছু কবিতায় কাব্যিক সুষমা ব্যাহত হয়েছে স্টেটমেন্ট ধর্মী বাক্যের প্রয়োগে তবুও সেগুলোর একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। একটা তন্ময়তা বাতাসের মতো পাক খেয়ে খেয়ে বেড়ে উঠেছে গোটা কাব্যগ্রন্থে। হিরণ্যজলে মাৎস্যন্যায়,কুসুম উপমা, শীতের একগুঁয়ে আলস্য ,উদ্ভাস ও উল্লাসের ইতি---খাদহীন সোনার মতো সংহত  শব্দবন্ধগুলোর বেশ চুম্বকীয় আকর্ষণ আছে। আলাদা করে রাখতে হয় এগুলোকে সম্ভ্রমের সঙ্গে। কবিকে সাধুবাদ।

হারিয়ে যাওয়া  কীলক লিপিতে যেন জন্মান্তরের সংকেত চিহ্ন। কীলকলিপি কৌণিক আকৃতির। জীবন নানাবিধ কোণের সমাহার। পৃথিবী মানুষ আদর্শ দর্শন চ্যুতি প্রাপ্তি সুপ্তি মগ্নতা বিপ্রতীপ সমান্তরাল --সব কোণেই আলো পড়ে। তার বিচ্ছুরণই জীবন। তার  তন্ময়তায় গাঁথা হয় মোহনমঙ্গলমালা। এই প্রত্যয় জেগে থাকে কাব্য পাঠে। কবি পরিব্রাজক। নির্জন পথ এগিয়ে যায় পথের সঙ্গী হয়ে। দূরতম পথ ছুঁয়ে যায় অগণিত উপপথ। তিনি হেঁটে চলেছেন ধ্রুব পথের সন্ধানে। কী এক স্পন্দিত আনন্দে চোখ বুজে আসে, অস্ফুটে বেরিয়ে আসে--- প্রাণ হে !

এ কাব্যগ্রন্থ নিঃসন্দেহে পাঠকের আলমারির সম্পদ। রাখা জরুরি। সিগনেট প্রেস-কে ধন্যবাদ এমন একটি কবিতার বই প্রকাশ করার জন্য। "কৃতাঞ্জলী মেঘ" এর কবি অনিতা অগ্নিহোত্রী র প্রতি কবির এই  অঞ্জলি উৎসর্গ  যেন অগ্রজ -অনুজের রেশমীবন্ধন। ভালো থাকুন কবি। ভালো থেকো — ভূমি ও ভূমা।

🍂

Post a Comment

0 Comments