জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী/পঞ্চদশ পর্ব

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
পঞ্চদশ পর্ব

দিনটি আজও খুব মনে পড়ে বিরজার। বিয়ের পর থেকে এবাড়ি-ওবাড়ি যাতায়াত করতে করতে ইতিমধ্যেই তিন তিনটে বছর পার করেছে সে। এখন তার বয়স এগারো,শাড়ি পরতে শিখেছে,ঘরকন্নাও মোটামুটি।গেলবার বাপের বাড়ি আসার সময়েই মা বলে দিয়েছিলেন জ্যাঠামশাইকে, 
-’এবার থেকে শ্বশুর বাড়িতেই থাকবে বৌমা,  বেশ বড়ো হয়ে গেছে তো।’
মনে মনে প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটির  আগামী জীবনের জন্য। এখন আর জ্যাঠাইমাকে ছেড়ে থাকতে তেমন মনখারাপ হয়না তার;বরং কলকাতার বাড়ির ইতিউতিতেই জড়িয়ে থাকে মন। এখানে এসেও মনে পড়ে মায়ের সঙ্গে দুপুরবেলার হাতপাখা টেনে ঘুম, দারোয়ান চাচার বাড়ি থেকে চিঠি আসার খবর, বামুনঠাকরানের কাছে মসৃন করে বিউলীর ডাল বেটে থালায় পোস্ত ছড়িয়ে গয়না বড়ি দেওয়ার কৌশল শেখা, সাহস করে সময়ে অসময়ে সেই দিগগজের ঘরে ঢুকে পড়া, তার সঙ্গে খানিক আবোল তাবোল বকবক… বেশ ভালো লাগে আজকাল। বিশেষত যখন বাবার বাড়িতে ফিরে আসে, তখন সেসব কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে। 
সেদিনও যেমন দুপুর বেলা খাওয়া দাওয়ার পরে, খিড়কিপারের পুকুরঘাটে এসে বসেছিল বিরজা;বাড়ির বাকি সবাই দ্বিপ্রাহরিক ঘুমের আরামে, ওর ঘুম আসেনা ছোট থেকেই। ও এমনই বসে বসে দেখে, ঘাটের পৈঠার কাছে মাছেদের ঘোরাঘুরি, ডালে ডালে পাখিদের ওড়াওড়ি, আরও কতো কি… কতো যে আবোল তাবোল চিন্তা মাথায় এসে জমা হয়;এই সময়টা আজন্মই তাই খুব প্রিয় বিরজার। 
সেদিনটাতেও ও বসেই ছিলো, হঠাৎ কোথা থেকে কেমন যেন এক হাওয়ার ঘূর্ণি পাক দিয়ে উঠলো ওর চারিপাশে… 
তখনকার দিনে গ্রামে গঞ্জে ভূতেদের উপদ্রব ছিল প্রবল। আসলে, তখনও টর্চ আসেনি বাজারে, ইলেকট্রিক আলোও আসেনি। সাধারণ মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলোও তেমন জ্বলেনি। স্বাভাবিক ভাবেই ভূত প্রেত দত্যি দানো দারুণ আনন্দে রাজত্ব করতো। সবাই তাদের কথা বিশ্বাসও করতো, বিরজারও অনেক দিন পর্যন্ত বিশ্বাস ছিলো ভূতে। 
🍂

সে যাই হোক, সেদিন দুপুরবেলা ঐরকম হাওয়া উঠতে কেমন যেন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘরে চলে এসেছিলো বিরজা। জ্যাঠাইমা তো বলেই এমন সব দুপুর বেলা অপদেবতারা ঘুরে বেড়ায় এধার- ওধার। ওদের হাওয়া লাগা ভালো না… 
এখনও মনে আছে, সেদিন ঘরে ঢুকেছে কি ঢোকেনি, সদর দরজায় জোর ধাক্কা;সঙ্গে চিৎকার, 
-’কে আছো গো? দোর খোল। তোমাদের বড়ো বিপদ’
সে আর্তনাদে এমন কিছু ছিলো, বাড়িশুদ্ধ সবাই মুহুর্তে তড়িঘড়ি উঠে পড়ে দোর খুলতে গেল। খুলতেই দুটি মানুষ, একজন বিরজার চেনা… ও বাড়ির মুনিষ গোপী দাদা। 
যখন যখন ওখানে থাকে, প্রতিদিনই সকালবেলা গুড় মুড়ি খেতে দিত বিরজা তাঁকে। আজ তিনি তাদের বৌমাকে দেখেই পরিস্থিতি ভুলে মাটির খুঁটিতে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো বিরজার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 
-’বৌমা গো, শিগগির বাড়ি চলো। দাদাবাবুকে দুপুর বেলা সাপে কেটেছে।’
-’সেকি?কোথায়? সে এখানে এলো কবে?’
সবার সম্মিলিত প্রশ্নে হতবাক প্রৌঢ় মানুষটি মাটিতে বসে শুধু কাঁদতে লাগলেন। 
খানিক ধাতস্থ হয়ে পাশের মানুষটি ক্রমে ক্রমে বললেন, 
-’দাদাবাবু গত পরশুদিন একাই এসেছেন বাড়িতে, পড়ালেখার নাকি ছুটি আছে কলকেতায়, তাই বেড়াতে এসেছেন। বাড়িতে থাকলে যা করেন, আজও খাওয়া দাওয়ার পরে তেমনই আমগাছের তলায় বইপত্তর নিয়ে বসেছিলেন, পড়ায় একমনে। কখন যে কি হয়ে গেল!’

সেবার শ্রাবণ মাসে একেবারেই বৃষ্টি হয়নি। দুপুরবেলার ঠা ঠা রোদ উঠোন জুড়ে জ্বালা ধরাচ্ছে;বিরজা গ্রামের মেয়ে,বুঝতে পারছিল কতো বড়ো অঘটন ঘটতে পারে… ওও খানিক হতচকিত হয়ে গোপী দাদার পাশে বসো পড়লো। অস্ফুটে বললে, 
-’তিনি কেমন আছেন গোপী দাদা? এলেই যদি আগে আসতে পারলে না!’
গোপী দাদা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। 
ইতিমধ্যে জ্যাঠামশাই গরুর গাড়িতে ওকে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছেন। নেহাত গৃহস্থের অকল্যাণ হবে, তাই একটুখানি জল বাতাসা মুখে দিয়েই গোপী দাদা ও জিতেনদাদাও ওদের সঙ্গে চললে। লজ্জা বা সঙ্কোচের অবকাশ নেই এমন বিপদের দিনে, সবাই একসঙ্গে চললে, সবাই চুপচাপ;মাঝে মধ্যে শুধু বলদের লেজ মুচড়ে কোচোয়ানের মুখের বিচিত্র শব্দ… ক্রমে সন্ধ্যা নেমে আসে, পথ তো ফুরায় না। 
সত্যিই,কখনও কখনও পথের দূরত্ব আমাদের মনের অস্থিরতার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না।তাই হয়তো, পরে যতবার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছেন বিরজা, কখনই সে দূরত্ব সেদিনের মতো মনে হয়নি। 
যাই হোক, সন্ধ্যা উতরে যখন শ্বশুরঘরের দেউড়ীতে এসে লাগলো গরুর গাড়ি, ভেতরে কান্নার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। জ্যাঠামশাই এবং বাকি দুজন দৌড়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল, ছোট্টো মেয়েটি যে একা রয়ে গেল পিছনে, কেউ খেয়ালও করলে না! 
ঠিক মনে নেই, তখন কি মনে হয়েছিল সেই এগারো বছরের নাবালিকার, শুধু মনে আছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে ও দেখেছিল চাঁদটা যেন কেমন নিস্প্রভ…চারিদিক নিস্তব্ধ,ভেতর থেকে ভেসে আসছে কান্নার আওয়াজ,দূর থেকে কালপেঁচার ডাক। কি ভীষণ ভয়ে কিংবা অসহায়তায় মেয়েটি একা একাই দৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করলে, ভিতর মহলের উঠোনের একপাশে কে যেন শুয়ে আছে, পাশে মা…খানিক দূরে ওঝা কি সব ঝাড়ফুঁক করছে,বাবামশাই, খুড়োমশাই, জ্যাঠামশাই সেখানে দাঁড়িয়ে। 
ওকে দেখেই খুড়িমা কি সব বলতে চাইলেন। মনে আছে, মা সেই সময়েও ওকে আগলেছিলেন।ওকে জড়িয়ে ধরে দিগগজের কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলছিলেন কান্নার সুরে, 
-’চোখ খোল, বাবা চোখ খোল। চেয়ে দেখ, বৌমা এয়েচে’
তাদের মা-মেয়ের দুর্ভাগ্য, তা শোনার বা সাড়া দেবার মতো শক্তি তখন প্রিয় মানুষটির ছিলনা… 
মুখ দিয়ে আর তখন গ্যাঁজলাও বেরোচ্ছে না, শুধু মাঝে মাঝে খিচুনি… রাত গভীর হলে তাও বন্ধ হয়ে গেল। বিরজা সামনে বসে বসে শুধু দেখলে… 
মনে আছে, কেউ যেন এসে ওকে টেনে নিয়ে যেতে চেয়েছিল দুটি মাছ ভাত মুখে দিতে;ও যায়নি। মাও জোর করেনি। 
আসলে তখনকার দিনে, এমন নিয়ম ছিল যে স্বামীর  মৃত্যুসময় হলে, পরিজনেরা সদ্যবিধবাকে সিঁদুর আলতা পরিয়ে চারটি মাছ খাইয়ে দিত, জন্মের শোধ শেষ খাওয়া… কারণ, সমস্ত সুখ আহ্লাদ শেষ হয়ে যায় বৈধব্য এলে;তা সে  কন্যা নাবালিকা হোক বা বিদ্যাসাগরের দেশের মেয়েই হোক।
পরের জীবনে যদিও এসব তিনি মানেননি, সবাইকে দেখিয়েই মাছ খেয়েছেন যতদিন ইচ্ছে করেছে, তবু সেদিনের মাছ সাজানো থালা তিনি ছুঁয়েও দেখেননি… চারিদিকে কতো লোক,কতো শব্দ,কতো কান্না,সবাই কাঁদছে,কেউ তাকে শাপ-শাপান্ত করছে,মা অচেতন হয়ে পড়ে আছেন পায়ের কাছে;তবু অনন্ত ব্রম্ভান্ডে যেন কেউ নেই,কিছু নেই!.... কি যে ঘটছে, তাও জানা নেই। 

পরবর্তী জীবনে আরও অনেক, অনেক ক্ষয়-লয়- আঘাত-দুঃখ পেয়েছেন, ভুলেছেন,নিজেকে সামলে আবার ফিরে এসেছেন কিন্তু জীবন প্রত্যূষে পাওয়া সেই না বোঝা নিঃসহায় একাকীত্ব তাঁকে কাঁদায়, আজও কাঁদায়, তার থেকে বুঝি জীবনভ’র তাঁর মুক্তি নেই... (ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments