জ্বলদর্চি

সোনাঝুরি /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব - ১৫
সোনাঝুরি

ভাস্করব্রত পতি

"বসন্তে নাগকেশরের সুগন্ধে মাতাল 
বিশ্বের যাদুর মঞ্চে রচে সে আপন ইন্দ্রজাল 
বনতলে মর্মরিয়া কাঁপে সোনাঝুরি 
চাঁদের আলোর পথে খেলা করে ছায়ার চাতুরী"। 
      'নামকরণ', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সোনাঝুরি গাছের নাম দিয়েছিলেন 'অমলতাস'। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ নাগাদ কাঁচা সােনার রঙের ফুল ফোটে এই গাছে। তাই এই গাছকে সোনাঝুরি, সোনারু, সোনালু, সোঁদাল, সোন্দাল, সান্দাল, সোনাইল, কর্ণিকার, অলানু বলে। রাস্তার ধারে Ornamental plants হিসেবে রোপন করা হয় গাছটি। এর ফুল দারুণ শোভাবর্ধক। বৈশাখ জৈষ্ঠ্য নাগাদ সোনাঝুরি ফুলে গাছ ভরে ওঠে।  এই সোনাঝুরি গাছ দিয়েই পরিবেষ্টিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনের বিখ্যাত সোনাঝুরি হাট। 

সােনাঝুরি গাছকে নেপালীতে অমলতাস, রাজবৃক্ষ, উর্দুতে অমলতাস, মারাঠীতে বাহাভা, অমলতাস, মনিপুরীতে চহুই, তেলুগুতে রেল্লকায়া, তিব্বতীতে ডোন গা, হিন্দিতে ঘনবহেড়া, অসলতাম, শিয়ার কি লাঠি, মারাঠিতে সঙ্গাতিলগব, সংস্কৃতে সুবর্ণ, আমলতাস, আবগ্বধ, রাজকৃষ্ণ, শম্পাক, পার্শিতে খিয়ার শানবর, অসমিয়াতে খ্যারেচম্বর, কোঙ্কনীতে বাসরলাঠি, কানাইলড়ি, পালিতে ইন্দিবর, ওড়িয়াতে সন্দরী, শোনারী, আরবিতে কানালহড়ি এবং কন্নড়ে বড়িলুবাহবাহেগাক বলা হয়। ইংরাজিতে PURGING CASSIA, INDIAN LABURNAM, GOLDEN SHOWER TREE, DRUMSTICK TREE, PUDING PIPE TREE ও বলে। 

কেরল রাজ্যের রাজ্য ফুল এটি। এখানে বিষ্ণু ফেস্টিভ্যালে এই ফুল কাজে লাগে। আবার থাইল্যাণ্ডেরও জাতীয় ফুল এই সোনাঝুরি। এখানে একে বলে Ratchaphruek বা Dok Khuen। এটিকে সচরাচর দেখতে পাওয়া যায়না। খুব একটা পরিচিত গাছও নয়। ইদানীং এই গাছ বেশি মাত্রায় রোপণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কাঞ্চনাদিবর্গের (Fabaceae) এই গাছটির বিজ্ঞানসম্মত নাম Casia fistula। 

মাঝারি আকারের পর্ণমোচী সোন্দাল গাছ ১০ থেকে ২০ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। পাঁচটি পাপড়ি বিশিষ্ট ফুল খুব নয়নাভিরাম। বসন্তের শেষে ফুল ফোটার আগে গাছে নতুন পাতা গজায়। গ্রীষ্মের শুরুতেই গাছের শাখা প্রশাখা জুড়ে ঝুলন্ত মঞ্জুরিতে সোনালী হলুদ রঙের ফুল ফুটে এবং তা সারা গ্রীষ্মকাল জুড়ে থাকে।

অনেকটা ঝাড়লন্ঠনের মতো দেখতে হলুদ বর্ণের ফুলগুলো। আকৃতিতে অঙ্গুলির অগ্রভাগের মতো। তাই বলা হয় 'কর্ণিকার'। মহাকবি কালিদাস তাঁর 'মেঘদূত' কাব্যের 'উত্তরমেঘ' এর ১৭ তম শ্লোকে প্রাক আর্য সভ্যতার যক্ষ রমণীদের কানের গহনায় পরিয়েছেন এই সোনালু বৃক্ষের পুষ্পগুচ্ছ। এই কাব্যের টীকাকার মল্লিনাথ লিখেছেন, "এই বৃক্ষের সমীপে যদি সুন্দরী যুবতী আহ্লাদে নৃত্য করে, তবে এই বৃক্ষের গর্ভ হয়"। 

প্রাচীন তন্ত্রসংস্কৃতি অনুযায়ী দেবদেবীর চরণে এবং কন্ঠে বিভিন্ন ধরনের ফুল দেওয়ার রীতি থাকলেও এটিই একমাত্র ফুল যেটি কিনা দেবদেবীর কানে পরানো হয়। যা খুব চিত্তাকর্ষক এবং দর্শনীয় বিষয়। মহাকবি ব্যাসদেবের লেখাতেও এসেছে কানে কর্ণিকার ফুলের উপস্থিতি। শ্রীকৃষ্ণের কানে স্বর্ণকুন্তলের বদলে তিনি পরিয়েছেন কর্ণিকার ফুল -- "বর্হা পীড়াভিরামং .... আর কর্ণয়ো কর্ণিকারং"। 

তবে এই ফুলের গন্ধ নেই। রূপসর্বস্ব সোনাঝুরিকে মহাকবি কালিদাস তাঁর 'কুমারসম্ভবম্'তে উল্লেখ করেছেন, "বর্ণ প্রকর্ষে সতি কর্ণিকারং... নির্গন্ধতয়াস্ম দুনোতি চিতঃ"। অর্থাৎ বর্ণোজ্জ্বল কর্ণিকার ফুলের গন্ধহীন অবস্থান মনের মধ্যে কষ্টের সঞ্চার করে। 

পরবর্তীতে ফুল থেকে গাছে এক থেকে দেড় ফুট লম্বা লম্বা লাঠির মতো সবুজ রঙের ফল হয়। যা দেখতে সজনে ডাঁটার মতো। তবে পেকে গেলে ফলের রঙ কালচে বাদামী রঙের হয়। ভেতরটা মিস্টি স্বাদের। গ্রামের দিকে এই সোনাঝুরি বাঁদরলাঠি, বান্দরলাঠি, বানরনড়ি, রাখালনড়ি নামে পরিচিত। আশ্বিন কার্তিক মাসে এর লম্বা লম্বা ফল ঝোলে গাছ থেকে। যা দেখতে লাঠির মতো লম্বা। আর বাঁদরের খুব পছন্দের খাবার। তাই বাঁদরলাঠি। এই ফল অন্যের মঙ্গল বিধান করে, তাই এটি 'শম্পাক'। রোগ শঙ্কাকে দূর করে, তাই এটি 'আরগ্বধ'। আবার এই গাছের পুষ্পগুচ্ছ মালার মতো, তাই এটি 'কৃতমাল'। 'চরক সংহিতা'র বিভিন্ন ছত্রে এই ভেষজ গাছটির উপকারীতা বিধৃত রাজবৃক্ষ, চতুরঙ্গুল, প্রগ্রহ ইত্যাদি নামেও। 

এর বীজগুলি একসঙ্গে থাকে না। ফলের মধ্যে সমদূরত্বে আধুলি পয়সার মতো দেওয়াল সৃষ্টি করে থাকে। সেই দেওয়ালের গায়ে তেঁতুলের মাড়ির মতো চটচটে আঠার মতো জিনিস ভরপুর থাকে। এটি ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ঔষধ তৈরিতে। ইউনানি চিকিৎসকরা বলেন, 'মগজ ফুলুস'। এই 'ফুলুস' অর্থে এক সময়কার 'বড় পয়সা' বোঝাতো। ফাল্গুন চৈত্র নাগাদ পাতাবিহীন গাছে কেবল পাকা পাকা বাঁদরলাঠি ফল ঝুলতে দেখা যায়। এই বাঁদরলাঠি ফলের নির্যাস থেকে তৈরি হয় চ্যবনপ্রাস। ছোটবেলায় এই লাঠিগুলো ছিল অনেক ছেলেমেয়েদের খেলার অন্যতম উপকরণ। অবশ্য আজকালকার ছেলেমেয়েদের কাছে এসব এলিয়েনদের মতোই অজানা অচেনা। আমবাত, শূল রোগ, উদরীরোগ, ক্ষার মেহে, অগ্নিমান্দ্য, কুষ্ঠের ক্ষত, ভগন্দর, রক্তপিত্ত ইত্যাদি নিরসনে সোন্দালু গাছের বিভিন্ন অংশ বেশ উপকারী। 

"জীবন মৃত্যুর হাইফেন বসানো বারান্দায় বসে 
চায়ে চুমুক দিচ্ছি বেশ, বোহেমিয়ান স্তবগান 
শিকড় ছুঁয়ে নেমে আসছে আরো গভীরে 
ঝুরিগুলি দোল খায়, তমসায় ঢাকা নিরন্নরাতে।
রোদ ছুটি নিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে আকাশগঙ্গা
শুক সারির আখড়ায় মহুলের ঢল
ছুঁয়ে বনসাই শরীর, সোনাঝুরি ক্লান্তি মাখে, 
হারিয়ে যাওয়া পথের মার্গসংগীত...... !"
    (অমলতাস, গুরুপদ মুখোপাধ্যায়)

🍂

Post a Comment

0 Comments