জ্বলদর্চি

বাগদি চরিত ( পঞ্চপঞ্চাশত্তম পর্ব) /শ্রীজিৎ জানা

বাগদি চরিত ( পঞ্চপঞ্চাশত্তম পর্ব) 

শ্রীজিৎ জানা

আড়চোখে কটমট করে তাকায় লোখা। সুবল দেখতে পায় না। দেখার কথাও নয় তার। এদিকে লোখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঝন্টা বিরক্ত হয়। রাগত স্বরেই লোখাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– মাইরি একটা ছেনা তুই! তখন থিকে দাঁড়ি আছু। ভগী খুড়াকে ডাকতে বোল্লম যে। দেখেঠু একটা ইম্টটেন কথা তার জন্যে আলচনা হচ্চে নি। যা না এট্টু তাত্তাড়ি।
– যাইঠি রে বাবা। অত রেগে যাউঠু কেনে!
কিন্তু লোখাকে খুব বেশিদূর যেতে হয় না। কয়েক পা এগোতেই লোখা দেখতে পায় ভগী খুড়া আসছে। তবে পিছন ফিরে না এসে খুড়ার জন্য অপেক্ষা করে। ভগী খুড়া কাছে আসতেই লোখা গলা নীচু করে বলে,
— তমাকেই ডাকতে যাচ্ছিলম। সব শুনেচ ত। মাধুর বরটা মরে গেছে। যে সে রোগে নয়,এডেস রোগে। সব ম্যাদ্দারা জুটেচে কালিতলায়। তুমি কুন্তু এই সুযোগে বেদাশালা পিয়নটাকে দু'কথা শুনাবে বলে দিলম। অর বউটাকে শুনাতে পাল্লে মোর গায়ের ঝাল মিটত। তাকে ত ইখিনে পাবা যাবেনি। এখন ওই ঢেমনাটাকে এক দু'ডোজ দাও। নাইলে নি তমার বাপ মার কিছু বাকি রাখবো নি পরে। দেখবে খন।
ভগী খুড়া কোন উত্তর না করে মুচকি হাসে। আর বলে,
– হ্যা রে মেস্টার কি করেঠে?
—আমি জানতম, তুমি ইটাই পথমে জিগাস কোরবে। তমাকে আমি চিনি ত ভাল কোরে। সে ত পুরা লেতি গেছে। ঝমকা লাগা পুঁইগাছের মত। কুন্তু বাইর থিকে বুজা যাবে নি। তা অনেক কথা আছে পরে বোলবো খন। এখন চল তাত্তাড়ি। তমার জন্নে সব আটকি আছে।
– না রে যাই বলি কেনে, ছেনাটা ত মাধুকে ভালবাসত। অমন ছেনার জন্নে খুব মায়া হয়। 
– অত যেদি মায়া, তবে ইবার ত রাস্তা ফাঁকা।  মেস্টারকে বিয়া করে লিতে বল। 
—মোর কাছে বোলুঠু ঠিক আছে। মেস্টারের কাছে যেদি বোলু তোকে জান্ত গেড়ে দিবে। খপরদার উসব কথা মুখে আনুসিনি। এখন চল দিখি।
             ভগী খুড়া আসতেই তাকে চাথালে বসতে দেয়। ভবতারণ বলে,
– ইখিনটায় বস খুড়া। কথা চলে গেইলে সক্কালবেলায়?
– অই মাঠকে গেইলম। ছাগল গুলানকে বেঁদে দিয়ে এসিঠি কি শুনতে পেলম এই খপর। তাই সজা ইদিকেই এসছিলম।
—থাইলে এখন একটা পরামশ্য দাও। কি করা যায়। যত হোক গেরামের বয়জেষ্ঠ লোক তুমি।
সুবল এতক্ষণ মরা গাছের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। ভবতারণের কথা শেষ হতেই একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। ভগী খুড়া সুবলের দিবকে তাকিয়ে বলে,
– দাঁড়ি আছু কেন, বোস না। অত চিন্তা কোরে কি কোরবি। জম্ম মিত্যু বিয়া তোর আমার হাতে নাই। সবই অই উপরবালার হাতে। সেখিনে জোরজবস্তি চলে নি। এখন যা হইচে সেটাকে মেনে লিয়ে মোদের এগাতে হবে। দেকতে হবে মেইছানাটার ভবিষ্যতটা কি করে ভাল হয়। একটা ছেনাও ত আছে জানতম..
এরকম আলোচনা সভায় সাধারণত ঝোন্টা চুপ করে থাকে না। গলার জোর বাড়িয়ে প্রমাণ করতে চায়,সে-ই হত্তাকত্তা। এদিকে ততক্ষণে অনেকেই জুটতে শুরু করেছে। ঢোলের ঘটনা বলে কথা। বোলতার চাকে ঢিল পড়লে যেমন হয়, তেরমনি বাগদি পাড়ায় কোন একটা ঘটনা ঘটলেই হল। কিলবিল করে লোক জড়ো হবেই হবে। ভিড় দেখে ঝোন্টার নেতাগিরি ভাবটা মাথা চাড়া দেয়। বলে,
– খুড়ার কথাটা ত একশ পারসেন কারেট। কুন্তু খুড়া ইখিনে একটা ফ্যাচাং আছে। সেটা হোল,জামাই গত হইচে এডেস রোগে। শুনিঠি মেইছেনা আর কোচা ছেনাটার বেলাড পরীক্ষায় ওই রোগের জাম কুনু নাই। তবু নাকি অদের পাড়ার লোক তাদের থাকতে দিবেনি বলেঠে। ইটা লিয়ে এখন কি আলোচনা কোরবে, সেটা বল।
শিবা একই দলের হলেও ঝোন্টাকে সে পছন্দ করে না। ঝন্টার জন্যই পার্টির বড় পদ তার হাতছাড়া হয়েছে। এমনকি আগামী দিনেও পাবে কিনা সন্দেহ। ফলে অনেকক্ষেত্রে শিবা তার যুক্তির ধারে সবার সামনে ঝন্টাকে হারাতে মরিয়া হয়। তবে খুব কৌশলে। কালিতলার এই ভিড়ের মওকা শিবা সহজে ফসকাতে দেবে কেন! সে ঝন্টার উদ্দেশ্যে বলে,
— তুই ঠিক পয়েন্টাই তুলেচু। কুন্তু অই কথাটা ত লোকের মুখে শুনা। অর কুনু ভিত্তি নাও থাকতে পারে। আগে সেখিনে যাবা হোক। আসনে বসা হোক। তাদের বাচকটা শুনা হোেক না। তারপর মোেদের কথা বোলবো।
— তা না হয় বোলবি। কুন্তু আগে থিকে যেদি এই পয়েন্টটা আলোচনা কোরে যাই থাইলে সেখিনে বলার সময় আর ভাবতে হবে নি। কারণ মোদের কার কি মত সেটাও ত জানা দরকার।
ভবতারণ এসব কথার মারপ্যাঁচ ধরতে খুব ওস্তাদ। কথা শেষ হতেই সে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ঝোন্টার দিকে,
– বুইতে পেরেচি তোর ইঙ্গিতটা। থাইলে তুই পথমে বল, তোর মতটা কি? মেইছেনাকে তার শ্বশুর ঘরের গেরাম যেদি থাকতে না দেয়,সে তার বাপের ভিটায় থাকতে পারবে না পারবেনি?
ভবতারণের কথায় বেকায়দায় পড়ে যায় ঝোন্টা। মনে মনে খুশি হয় শিবা। ভিড়ের কাউচান শুিরু হয়ে যায়। সুবল মাথা নীচু করে ফোঁপাতে শুরু করে। আর বলে,
— তমরা মোর মেইছেনাটাকে ভাসি দিও নি গ। ছোট থিকে অনেক লাত ঝাঁটা খেইচে উ। কুনু দিন তেমন কোরে সুখ পাইনি। তমরা কিছু একটা কর গ মেইছেনাটার জন্যে।
লোখা আর চুপ থাকতে পারে না। গামছা বাম কাঁধ থেনে নিয়ে ঝটকিয়ে ডান কাঁধে ফেলে বলে,
– দেখ, তখন থিকে আলোচনা শুনিঠি। অত ঘুঁজুটুপু কথা মোর কাছে চোলবেনি। সুবলকা তুমি যে বলঠ মেইছেনাটাকে দেখার কথা। যেদি আমরা তাকে আনি, তমার বউ সিটা মেনে লিবে ত। আগে সিটা বল দিখি পরে গেরামের লোক ভাববে।
শিবা ঝাপট দেয় লোখাকে,
– কুন কথা থিকে কুন দিকে চলে গেলু। আগল বক্তা হোয়ে কথা বোলিসিনি দিখি। আগে ঝন্টা কি বলে দেক না।
ঝোন্টা পিঠ বাঁচানোর একটা সুযোগ পেয়ে যায়। লোখাকে সে সমর্থন করে বলে,
— মোর কথা ছেড়ে দে। সুবলকা আগে কি বলে শুন। কাকি মেনে লিবে ত!
ভীড়ের গুঞ্জন দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মানুষ এক অদ্ভূত জীব। পাড়ায় আগুন লাগলে আগে নিজের ঘরের চালে জল ছিটায়। যাতে আগুনের ফুলকি ছিটকে এসে তার ঘর না পোড়ায়। তারপর ছুটে যায় আগুিন লাগা ঘরে জল দিতে। স্বার্থের খাতায় কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব বুঝে নিতে কেউ কম যায় না। মাধুকে গোটা ঢোল চেনে। ছোটবেলা থেকে সতল মায়ের কাছে কম নির্যাতন হয়নি সে। তার মত শান্ত সরল মেয়েকে ভাল না বেসে থাকা যায় না। এই অল্প বয়সে তার বিধবা হওয়া নিয়ে গোটা গ্রামই হা -হুতাশ করছে। কিন্তু যেই শুনেছে তাকে গ্রামে নিয়ে আসার কথা অম্নি তর্কাতর্কি শুরু নিজেদের মধ্যে।
–হোেতে পারে উ গেরামের মেইছেনা,তা বোলে সব জেনে শুনে তাকে ইখিনে রাখা যায় কখন!
— ই যে সে রোগ লয়,এডেস রোগ! ছুঁইচা রোগ! ছেনা পেনার সংসার! মোরবো নাকি শেষকালে সবাই!
–উ হবে নি। জেনেশুনে সাপের গত্তে হাত দিবা যাবেনি। মোর মত নাই।
– উ মেইছেনা এখন তাদের গেরামের বউড়ি। তারা বুজু। মোরও মত নাই এগবারে। তাপরে পাঁচজন চিন্তাভাবনা কোরু,কি কোরবে।
সকাল মানেই জন খাটতে যাওয়ার সময়। ভীড় ক্রমশ ফাোকা হতে থাকে। ভবতারণ বলে,
– কি মেস্টার! তুমি কি চুপ কোরেই থাকবে? একটা কিছু ডিসিশাস লাও।
🍂

মাস্টার কিছু বলার আগে ভগী খুড়া বলে,
– মেস্টার কিছু বলার আগে আমি বোলচি শুন, আগে থিকেই কেনে আমরা এত বাড়াবিস্তর ভাবিঠি। বুড়া মানুষ আমি। মা মরা মেইছেনাটা! মোর যত কষ্ট হউ, আমি যাব। আগে যাই চল সেখিনে। তাবাদে নিজেদের ঝিউড়িকে যেদি নিজেরাই ইভাবে দুই দুই কোরু, থাইলে তারা ত কোরবেই। তবে রোগটা লিয়ে ত বেশি কিছু মোর জানা নাই। মেস্টার বোলতে পারবে। কুন্তু শুদু রোগের নাম কোরে একটা ছোটছেনা সহ মেইছেনাকে ইভাবে গেরাম ছাড়া কোরবে সেটাও যেমন মানতে পারবোনি,তেমনি আমরাও উটা কোরব, তায়েও মোর সায় নাই। যত হোক নিজের জাতের ঝিউড়ি ত। ঝন্টা তোর কি মত রে? মেস্টার তুমি বল ইবারে।
এতক্ষণ সেভাবে কোন কথা বলেনি খগেন মাস্টার। মনের ভিতরে তার ঝড় বইছে। সেই ঝড়ের তান্ডবে ভেঙে দিচ্ছে তার ধৈর্য, তার নিজেকে সামলে রাখার সংযম। কেন সে বসে আছে এখানে! কেন ছুটে এল সে খবর শুনে! সে না থাকলেও তো সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিত। ভাল - মন্দ তো আজ আর তার হাতে নেই। তাহলে অনেকের মতো সে কেন পালিয়ে যেতে পারছে না। কেন বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেই নিষ্পাপ একটা কিশোরী মুখের প্রতিচ্ছবি! এখন তার কী বলা উচিত? গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ মাধুকে আনার কথা মানতে চাইছে না।  খগেন মাস্টার জানে ঝোন্টা মুখে যাই বলুক,সেও গ্রামের মানুষের বিরুদ্ধে যাবে না। সে শুধু বুঝে ভোটের অঙ্ক। বাগদি পেটের খিদা না বুঝুক, আজকের দিনে ভোটের খিদা বুঝতে শিখেছে। ঝোন্টাদের মতো কয়েকজন সেই রাক্ষুসে খিদা নিয়ে তান্ডব করে চলেছে গ্রামে গ্রামে। যদিও তারা আসলে যে উচ্ছিষ্টভোজী, উপতলার হাতের পুতুল, এটা বোঝার ক্ষমতা আদৌও নেই তাদের। খগেন মাস্টার এদের মোকাবিলা করার কৌশল জানে। তাই নিজেকে সামলে ঝোন্টার উদ্দেশ্যে বলে,
— দেক্, ঝোন্টা!  সবার আগে তুই প্রশাসনের সঙ্গে একটু যোগাযোগ কর। ওই গ্রামের পঞ্চায়েত কে আছে জান। তার সাথে এখানের নেতৃত্ব দিয়ে কথা বলা। থাইলে দেকবি সেখিনের আলোচনা সুষ্ঠ হবে। বাদ বাকি ভগী খুড়া যেমনটা বোলছে, আগে সেখিনে চ। আনা হলেও আজ কালের মধ্যে ত আনা হবে নি। তখন না হয় সবাই বসেই ঠিক কোরবো। আগে তুই ফোন কর।
খগেন মাস্টারের মুখে প্রশাসনের কথা শুনে ঝোন্টা যারপরনাই খুশি হয়। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে। সুইচ টিপতে টিপতে বলে,
– মেস্টার এগবারে কারেট ডিসিশান দিছে। এই যে কল কোচ্চি এখুনি। থাইলে কে কে যাবে রেডি হও। আমি ইদিকটা দেখে লিচ্চি। আর মেস্টার, তমাকে ত যেতেই হবে। নাইলে ইসব ক্যাচাল সামলানা যাবে নি।

মুম্বাইয়ে দাহ করা হয় লাশ। বন্ধু বান্ধবরাই সহযোগিতা করে। তবে পাড়ার দু'জন খুড়তুতো ভাই ছিল। তারা মাধুকে নিয়ে আসবে। মুম্বাই থেকে আসতে দুদিন লাগবে ট্রেনে। তার আগে মাধুর শ্বশুর বাড়িতে আলোচনায় বসা হবে। দুপুরে খেয়েই রওনা দেয় সকলে। সুবল তার গিন্নি সহ আগেই চলে যায়। বঙ্কা তার মোটরসাইকেল করে নিয়ে যায় তাদের। খগেন মাস্টার বলেছিল, তার যেতে সামান্য দেরি হতে পারে। আসলে সে একটু পিছনেই যেতে চাইছিল। এবারও লোখা তার সঙ্গী হয়। কিন্তু অনেকটা রাস্তা দুজনেই নিশ্পুপ থাকে। মোটরসাইকেল যেন আনমনেই আপন গতিতে এগিয়ে যায়। তারপর মোটরসাইকেল সোজা গিয়ে থামে গোপীগঞ্জ বাজারে। চন্দ্রেশ্বর খাল রূপনারায়ণে যেখানে মিশেছে সেখানে দাঁড়ায় একটা রাধাচূড়া গাছের তলায়। মাস্টার বাইক থামালে লোখা জিগ্যেস করে,
— কি গ গাড়ি থামালে কেনে? যেতে ত দেরি হবে! তারা মোদের জন্যে অপিক্ষা কোরবে।
— যাব দাঁড়ানা, বোস একটু। 
বলেই গাছতলায় নদীমুখা হয়ে বসে পড়ে। বাধ্য হয়ে লোখাও তার পাশটিতে বসে। মাস্টার লোখার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,
— বিড়ি আনুনু? দে দিখি একটা।
লোখা মাস্টারকে একটা দিয়ে, নিজেও ধরায়। বড় একটা টান দিয়ে বলে,
— কি সব ভাবঠ বল দিখি? এই কোরে কি শরীরটাকে শেষ কোরবে। কুনুকিছু কি মোদের হাতে আছে। সব উপরবালার খেলা। তমাকে বুজাব মোর অত যোগ্যতা নাই। তবু বোলিঠি, অত চিন্তা কোরোনি।
কোনরকম উত্তর না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খগেন মাস্টার। লোখা নিজের কৌতুহল চেপে রাখতে পারে না। বলে,
—একটা কথা বোলবো মেস্টার, কিছু মনে কোরোনি। তমার কি মত বল দিখি? মাধুকে আনা ঠিক হবে? গেরামে যেদি বিবাদ লাগে, থাইলে!

Post a Comment

0 Comments