জ্বলদর্চি

ড. নবকুমার দুয়ারী (নৃবিজ্ঞানী, অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, কাঁথি)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১০০
ড. নবকুমার দুয়ারী (নৃবিজ্ঞানী, অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, কাঁথি) 

ভাস্করব্রত পতি

কাঁথির মারিশদা ব্লকের শিখরপাত্রবাড়ের সম্ভ্রান্ত দুয়ারী পরিবারের সন্তান ড. নবকুমার দুয়ারী। শিক্ষা দীক্ষা সংস্কৃতি শিল্প সমাজ সংগঠনে বিশেষ ভাবে যুক্ত এই পরিবার। দুই পুরুষ ধরে এলাকার খ্যাতনামা মৃৎশিল্পী ছিলেন দর্শনচন্দ্র দুয়ারী এবং চন্দ্রমোহন দুয়ারী। ইংরেজ শাসনকালে এলাকার প্রথম সরকারি চাকুরে ছিল প্রসন্ন দুয়ারী, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন ব্রজনাথ দুয়ারী এবং প্রথম ফার্মাসিস্ট ছিলেন বিভূতিভূষণ দুয়ারী। সেই পরিবারের অন্যতম সন্তান হয়ে আজ তিনি ভারতের বিখ্যাত অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার প্রোথিতযশা নৃবিজ্ঞানী। মেদিনীপুরের মানুষ রতন। অথচ সম্পূর্ণ আড়ালে থেকে গর্বিত করে চলেছেন মেদিনীপুরের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসকে। 

১৯৬৫ এর ১৮ ই নভেম্বর তাঁর জন্ম। বাবা বিভূতিভূষণ দুয়ারী এবং মা নুপুর রাণী দুয়ারীর প্রথম সন্তান তিনি। মোট পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে বাকিরা হলেন রাজকুমার তরুণকুমার, নীলিমা এবং অনিমা। ছোটবেলায় অনেক আদর স্নেহ ভালবাসা আর কড়া শাসনের ঘেরাটোপে বড় হয়েছেন। পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে চোখ থাকতো পাখি, পোকামাকড়, কুকুর, বেড়াল, গাছপালা ও খোলা আকাশের নিচে ঘাস, ফুল, ফড়িং, ব্যাঙ আর মেটেলি সাপেদের সাথে। মজে থাকতেন নানা লোকক্রীড়ায়।চলতো দেদার ঘুড়ি ওড়ানো। চড়ুইভাতি করা, নতুন বৌ নিয়ে পালকির ছুটে চলা দেখা, সরস্বতী পূজোর আয়োজন করা, শীতকালে আগুনে তাপ পোহানো, ছিপে মাছ ধরা ইত্যাদি করতে করতে কখন যে ভালোবেসে ছিলেন জীবনকে, প্রকৃতিকে, পরিবেশকে -- টের পাননি। যখন পেলেন, তখন তিনি মেদিনীপুর জেলার অন্যতম একজন নৃবিজ্ঞানী হয়ে গেছেন। আসলে মাটির সোঁদা গন্ধ শুঁকে বড় হয়ে ওঠা -- তাঁর জীবনের চলার পথকে সুগম করে দিয়েছে। যা কিনা তাঁর কর্মজীবনের কাজের সাথে জড়িয়ে গেছে আষ্টেপৃষ্ঠে। 
অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অফিসে কর্মরত ড. নবকুমার দুয়ারী

সাধারণ বাঁশের কলম বানিয়ে লিখতেন একসময়। সেই ঘরানা টপকে আজ তিনি শীর্ষে। আজ তাঁর আঙুলে থাকা দামি কলমে লেখা হয় ভারতের জনজাতির ইতিহাস। তাঁদের জীবনের কথা, ছন্দের কথা, গন্ধের কথা আর বেঁচে থাকার লড়াই সংগ্রামের কথা। কোটবাড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণীর পড়াশোনা শুরু। এরপর দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়া কাখুড়িয়া সুশীলা বালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ধান্যঘরা জ্ঞানেন্দ্র বিদ্যাপীঠে ১৯৭৩ ভর্তি হন পঞ্চম শ্রেণীতে। ১৯৮০ তে মাধ্যমিক পাস করে হেঁড়িয়া শিবপ্রসাদ ইন্সটিটিউশনে ১৯৮২ তে উচ্চ মাধ্যমিক পাস। নৃতত্ত্ববিদ্যা বিষয় নিয়ে হাবড়া শ্রী চৈতন্য কলেজ থেকে ১৯৮৭ তে অনার্স ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯১ তে ড. প্রবোধ কুমার ভৌমিকের তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৯১-৯২ তে ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড অ্যানথ্রোপলজিতে রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৯২-১৯৯৫ পর্যন্ত অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অব ইণ্ডিয়ার জুনিয়র রিসার্চ ফেলো নির্বাচিত হন। রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে TRIBAL EDUCATION IN MEDINIPUR DISTRICT OF WEST BENGAL বিষয়ে ২০০১ সালে পি এইচ ডি সম্পন্ন করেন ড. এ কে হালদারের অধীনে। মেদিনীপুরের লোধা, কোঁড়া, মাহালিদের নিয়ে তাঁর নিরন্তর গবেষণা ছিল এই কাজে। ১৯৯৬ তে অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার রাঁচি শাখায় প্রথম চাকরি পান। এরপর ২০০৩ তে কলকাতার প্রধান অফিসে যোগ দেন। আপাতত শিলংয়ে কাজ করছেন অ্যানথ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার অন্যতম নৃবিজ্ঞানী হিসেবে। তাঁর লেখা Biraja Sankar Guha : Centenary Year of Teaching of Anthropology in India বইটি একটি নৃতত্বের মূল্যবান গ্রন্থ। 
ক্ষেত্রসমীক্ষাতে জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামে

তিনি লিখেছেন নানা বিষয় নিয়ে। ভারতের নৃবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তিনি হেঁটেছেন নিরলসভাবে। প্রাচীন থেকে বর্তমান -- জনজাতির ইতিহাস তুলে ধরেছেন নিরন্তর ক্ষেত্রসমীক্ষা এবং ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে। শুধু মেদিনীপুরের জনজীবন নয়, সারা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের এলাকার লোকসমীক্ষা করেছেন নৃতত্ত্বের দৃষ্টিভঙ্গিতে। তিনি লিখেছেন পূর্ব মেদিনীপুরের মন্দির মসজিদ, মৃণ্ময়ী মা দুর্গা ও সমকালীন চিন্ময়ী নারী, উপকূলবর্তী পশ্চিমবঙ্গে লোক সংস্কৃতিতে ঢেঁকি পূজা, বেনীপুতুল: শিল্প ও শিল্পীর অস্তিত্ব সংকট, বাংলা চলচ্চিত্রে আদিবাসী চরিত্র, ভারতীয় আদিবাসী ও লোকসংস্কৃতির প্রেক্ষিত, পূর্ব মেদিনীপুরের একটি পটের দুর্গা, লোক শিল্পের আঙিনায় নকশি কাঁথা, দক্ষিণবঙ্গে পটের দুর্গা পূজার এক ইতিকথা, সময় আলখ্যে পশ্চিমবঙ্গ সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রথাগত পেশা, ভারতীয় সংস্কৃতিতে সাপের পুজা: অতীত ও বর্তমান, সীমান্তবর্তী পশ্চিমবাংলার আদিবাসী শিক্ষা ও সমস্যা, শিশু চিহড় এবং প্রৌঢ় বিরহড়: জঙ্গল ও মানবের এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা, সীমান্তবর্তী পশ্চিমবাংলার আদিবাসী শিক্ষা ও সমস্যা, হাঁড়িয়া ও ছোটনাগপুরের একটি আদিবাসী সংস্কৃতি, জেলেদের জীবন, জীবিকা ও প্রথাগত জ্ঞান, দেহতত্ত্ব গানে শহর কলকাতা ও রেলগাড়ি, মোরগ লড়াই: আবাদে অবাধে আদিবাসী সংস্কৃতিতে, কৈবর্ত লোকশ্রুতিতে সতী রাধিকার আখ্যান, ভারতীয় সংস্কৃতিতে সাপের পুজা: অতীত বর্তমান ও কিছু অভিজ্ঞতা, মাদুর: প্রথাগত জ্ঞান ও গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট, কুম্ভকার: নর্মদার তীরে শহুরে জীবনের গহন ধারায়, সুন্দরবনে আদিবাসী সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা সুন্দরবন আবিষ্কার ইত্যাদি। 
এভাবেই কাদা পথ পেরিয়ে নৃতত্ত্বের কাজ করছেন

এছাড়াও তাঁর গবেষণায় উঠে এসেছে Traditional Coastal Fishing in Bengal: An Observationin Haripur Khoti, Dash Avatar Tas: An Anthropological Understanding of Human Evolution, Mahua Tree: Myth in Santal Society of Ayodhya Hill, Traditional Knowledge in Weather Forecast: An Observation among Cultivators in Coastal, Educational Development among Tribal Females in India, Education among the Kheria of West Bengal, Change and Continuity in Ho Religion: An Impact Study in South Bihar, Role of Economy in Educational Development: A Comparative Study of Ho in Different Settings, Oraon Dances in Chotanagpur: An Impact Study in South Bihar, The Portrait of Sarjam Dare: A Cultural Study in Santal Society, The Souria Paharia: A Study of Ethno-Medical System ইত্যাদি। 

শুধু লেখা নয়, প্রচুর ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানিয়েছেন মেদিনীপুর এবং ভারতের জন ইতিহাস নিয়ে। সেগুলি যেন এক একটি অমূল্য দলিল। বিভিন্ন প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে তা। এইসব ডকুমেন্টারি ফিল্ম গুলির এরকমই কয়েকটি হল Man in India (২০২৪), Route to the Root In search of the birthplace of the Anthropological Survey of India (২০২২), Untiring Mind (Life and work of B.S. Guha on the occasion of 125th birth anniversary (২০১৯), Ranta (Traditional knowledge in well-making in Madhya Pradesh, ২০১৭), Bheribathan (Camp life of the shepherd community in Indo Nepal border in Bihar, ২০১৬), An Epic Journey (50 years journey of the Indian Anthropological Society, Kolkata, ২০১৬), Beniputul (Life and the role of the glove puppeteer from coastal Bengal, ২০১৪), Song of Earth (Life and philosophy of Boul faqir in West Bengal, ২০১৫), Magic Fingers (Clay idol makers in Krishnanagar in West Bengal, ২০১৫), Tale of Two Cities (A story of two cities Kolkata and New Town, ২০১০), An Incessant Voyage (Introduction to Anthropological Survey of India, ২০১০), Utra or Northern Wind (Traditional knowledge of the coastal fisherfolk in West Bengal, ২০১০), Ghotul (Youth dormitory of the Muria Gond in Chhattisgarh, ২০০৯) এবং Dom in Kolkata: Craft & Cremation (Traditional occupation of the Dom community, ২০০৯)। 
তথ্য সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত ড. নবকুমার দুয়ারী

ভারতের বিভিন্ন এলাকায় গবেষণামূলক জাতীয় প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করে চলেছেন ড. নবকুমার দুয়ারী। বিভিন্ন স্থানে তাঁকে এজন্য থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন। ১৯৯৯-২০০০ এ ইন্দো নেপাল সীমানায় মধুবনী চিত্রকলা নিয়ে কাজ করেছেন Documentation and Dissemination of Folk Art, Folk Music and Folk Traditions প্রকল্পে। এরপর ২০০২-২০০৭ এ আসামের বরপেটার কৈবর্ত্য, নদীয়ার সাহেবধনী এবং  রাঁচির মাণ্ডেরে ওঁরাওদের নিয়ে Syncretism in India: Multidisciplinary Approach শিরোনামে কাজ করেছেন। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উপকূলীয় মৎস্যজীবীদের নিয়ে ২০১০-২০১২ তে ছিলেন Traditional knowledge: Tangible and Intangible Cultural Heritage প্রকল্পে। এরপর ২০১২ সালে ওড়িশার গজপতি ও গঞ্জাম জেলার সাওরা উপজাতিদের নিয়ে Particularly Vulnerable Tribal Groups in India শিরোনামে কাজ করেছেন। এছাড়াও Bio-Cultural Diversity, Environment and Sustainable Development এ গবেষণা করেছেন (২০১২-২০১৭) বিহারের যোগবানিতে ভারত নেপাল সীমানায়, ভারত বাংলাদেশ সীমানা ত্রিপুরার মাতাই গ্রামে। মধ্যপ্রদেশের বারাউনি জেলার কুমোরদের নিয়ে ২০১৭ তে কাজ করতে গিয়েছেন। ২০১৮-২০১৯ সালে Anthropological Study of Denotified, Nomadic and Semi nomadic Communities প্রকল্পে গঞ্জাম জেলার ডাণ্ডাসি এবং পাঞ্জাবের সাঙ্গরুর জেলার বাউড়িদের নিয়ে। গত ২০২০-২০২২ এ হরিয়ানার হিসার, সিরসা ও ফতেহাবাদ জেলার হেডি, হেরি, নায়েক, উত্তরপ্রদেশের প্রতাপগড়, মহারাজগঞ্জের চামার মাংতা, লোনা চামার, বিহারের বাউড়িয়াদের নিয়ে নিবিড় অন্বেষণ করতে হয়েছে তাঁকে। ২০২৩ এ ওড়িশার মুণ্ডাপোট্টা জনজাতি নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেছেন নৃতত্ত্ববিদের দৃষ্টিতে। এই মুহূর্তে অরুনাচল প্রদেশের ভারত চিন সীমান্তে করছেন International Border Study। তাই এই মুহূর্তে রয়েছেন শিলংয়ের এক সীমান্তবর্তী এলাকায়। ঘরবাড়ি ছেড়ে দেশের বিভিন্ন ধরনের জনজাতির জনজীবন নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণায় রত তিনি। 
লিখিত বই

মেদিনীপুরের বহু লিটল ম্যাগাজিনের অন্যতম লেখক তিনি। কলমের আঁচড়ে তুলে ধরছেন মেদিনীপুরকে। নানা দিক থেকে, নানা কোন থেকে, নানা বিষয় নিয়ে তাঁর কাজ আজ প্রণিধানযোগ্য। আজ ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় নীরবে নিভৃতে সেখানকার মানষজনকে নিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন ভারত সরকারের এক সুযোগ্য সৈনিক হিসেবে।

🍂

Post a Comment

0 Comments