জ্বলদর্চি

অনন্তের চশমা জুড়ে কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা :দুই /গৌতম মাহাত


অনন্তের চশমা জুড়ে কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা :দুই

গৌতম মাহাত 

'আজকাল ভাবনার জন্য ভাবনা হয়'

"কবিতার আনাচ কানাচ ও মোড় মোচড় বুঝতে গেলে কবির জীবনশৈলি বোঝা একান্ত প্রয়োজন। না হলে কবিতার মাত্রিকতা পাঠককে ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে যায়"-- (ব্যক্তিগত মত)।

   এই "কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা" কাব্যগ্রন্থের নিহিত রসাস্বাদনের জন্য তো ওপরের কথাগুলি ধ্রুবক। কবি ঋত্বিককে যাঁরা চেনেন/জানেন তাঁরা পাশাপাশি সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে রাখুন অনেক জট সহজে খুলে যাবে। কবির বাস্তববাদ থেকে বস্তুবাদের সফর রোমাঞ্চকর। এমন অনেক ঘটনারই সাক্ষী। তবে সে সবই এখানে অপ্রাসঙ্গিক। কখনও কবি ঋত্বিকের আলোচনা করলে নিশ্চয় বলব। তবে একটা ঘটনা প্রসঙ্গত না বললে আলোচনার সূত্র টানা জটিল হবে। 

      একদিন ঠেকে চা খেতে খেতে আমার তিরিক্ষি মেজাজ দেখে বলল-- কী কেস?

 বললাম-- অ্যাতো মধ্যমেধার ছেলেমেয়েরা লিখছে তোমার মনে হয় না, ক্ষেত্রটা ঘেঁটে 'ঘ' হয়ে যাচ্ছে!!

বলল--আমি জানি আমরা কেউ চিরস্থায়ী তো নয়ই দীর্ঘস্থায়ী হওয়ারও যোগ্যতা নেই।

-- আমি তোমার কথা বলছি না তোমার পত্রিকায় লিখতে আসা কিছু নতুন প্রজন্মের কথা বলছি।

-- ধুসসস! এরা যদি না লিখত তাহলে রকে বসে সিটি বাজাতো। কিম্বা ডিপ্রেসনের কবলে পড়ে নষ্ট করত নিজেকে, এতে সমাজের অস্থিরতা তৈরি হত। এই কবি পদবাচ্যের অমোঘ হাতছানিতে তার সংখ্যা কিছু তো কমল!
  সেদিন 'চা'তে মনাদা চিনি বেশি দিয়ে ফেলেছিল।

       উপরি উক্ত কথোপকথন  ওপর কেউ দ্বিমত পোষণ করতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তি স্বাধীনতা। তবে কবি ঋত্বিকের জীবনচর্যা এমনই। আমরা দুজনেই একই জিনিস দুরকম ভাবে দেখে এসেছি চিনে এসেছি। তাই কবির বহু অনুক্ত ভাষ্য বুঝতে আর ঘিলু নাড়াতে হয় না। কিন্তু এই গ্রন্থটি পাঠকের অন্তত মস্তিষ্কের অনেক খোরাক প্রদান করবে এতে দ্বিমত নেই। আগের আলোচনাতেই বলেছি- ভাববাদ থেকে বাস্তবতার সাম্পানে বস্তুবাদের কুঞ্ঝটিকায় প্রবেশের যে সাধনা সেটা সচেতন পাঠকের মনকে তছনছ করে দেবে। কিন্তু কবির কোনও তাড়া নেই এই জার্নিতে। তিনি এই জার্নিকে য্যামোন আত্মস্থ করেছেন তেমনি জার্নিও তাকে আপন করে নিয়েছে। তাই দুজনই সচল আবার দুজনই মন্থর এবং কখনও কখনও নিশ্চল। দু'জন দু'জনকেই উপভোগ করছে। আর এদের মাঝে যা নিরাবয়ব অস্তিত্ব নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছে তা সময়।  ত্রিমাত্রিকতা প্রসঙ্গ পাঠক য্যানো সব সময় সচেতন স্তরে রাখেন। কারণ কবির ভ্রমণ অবচেতন ও অচেতনের টানেল দিয়ে।

"জীবন কখনও মিলবে না জেনেও যাত্রা..."
                                    (কবিতা : দ্বিখণ্ডিত)

অথবা

"চেয়েছি বলেই দেশ নইলে একটাই পৃথিবী হয় 
দুঃখ সুখের সমূহ ঐশ্বর্য একার কারও নয়"
                          (কবিতা : সংজ্ঞার বিপরীতে)

      কথাগুলো হয়তো জটিল হয়ে উঠছে কিন্তু আমি নিরুপায়। কবি ঋত্বিকই এর জন্য দায়ী। কবিতার অ্যাতোগুলো স্তর আর অ্যাতো বাঁক যে সব কটাকে স্পর্শে ও ব্যক্ততার আদল দিতেই সব আয়োজন। তাই পাঠক ধৈর্যের সাথে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি বর্ষণ করবেন এটুকু আশা করাই যায়। 
       যাই হোক আলোচনার আঙিনায় ফেরা যাক। কবির গতিশীল জার্নির নান্দনিকতাই আসলে কবির গন্তব্য। ডেস্টিনি। কবির আসলে কোথাও পৌঁছোনোর উদ্দেশ্য নয়, কোনও কিছুই প্রমাণ করার তাগিদও নেই। তাই কবির এই রীতি। এই প্রসঙ্গে ঋত্বিকের শৈলি নিয়ে দু'চার কথা সেরে নেওয়া ভালো। কারণ এই কাব্যগ্রন্থটির শৈলিও পরম্পরারহিত। 'কবিতার ভাষায় প্রবন্ধের আস্বাদ'-যতটা সত্যি, উল্টোটাই বা বাদ দিই কিভাবে! প্রবন্ধকে কবিতার আটপৌরে উঠোনে এনে গাল-গপ্প শোনানোর মত ধৃষ্টতা রাখতে দম লাগে মোহাই। এই থিওরিটিক্যাল আলোচনার মধ্যে কিছু উদাহরণ নিয়ে বিশ্লেষণের চৌহদ্দিতে পা রাখলে সামান্য সুবিধা হতে পারে। তাই চলুন ক'টা উদাহরণ রাখা যাক--

"পরিক্রমা কিছু পূর্বনির্দিষ্ট তবু সাযুজ্য খোঁজে সূচক অলক্ষিত প্রতিশ্রুতি সরণশূন্য, লৌকিক অনুবর্তনের লীলা...

লক্ষ্মণরেখার মতো উন্নত আর কী-ই বা হতে পারে চিত্রকল্প অলংকৃত রেখাচিত্রের স্মৃতি-একক সংসার, লুকিয়ে মহাদেশ আগুনের ব্যঞ্জনায় ধ্রুবপদ, সামান্য বিধিনিষেধ সেখানেও....
.............
   একে অন্যের প্রতিরোধে লীন, পুণ্যশ্লোকের ব্রত নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রেরক প্রাপকের সমস্বর, নির্ভার ক্ষেত্রে নিয়তির মতো, একমাত্র..."
                         (নিষিদ্ধ চারণভূমি)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
এই কবিতার যে সমস্ত শব্দের প্রয়োগ দেখছি, তারা প্রত্যেকেই তাদের স্বাধর্ম ছেড়ে পরবর্তী পদের সম্পূরক  শব্দ হয়ে উঠছে। আর সেই শব্দগুলি প্রবন্ধধর্মী। কিন্তু তাদের অ্যারেঞ্জমেন্টটা কাব্যিক। প্রথম লাইনটিতে রয়েছে চারটি ঘাত-শব্দ। (পরিক্রমা, পূর্বনির্দিষ্ট, সাযুজ্য ও সূচক) এই শব্দগুলি এক একটি পরিভাষা বলা যেতে পারে। কিন্তু কবি এদের মূল অর্থকে অতিক্রম করে ভিন্ন কোণ থেকে দেখলেন এবং ব্যবহার করলেন। শুধু ব্যবহারই করলেন না পরের লাইনটি লিখে ছড়িয়ে দিলেন সেই কাব্যিক নান্দনিকতা ও দর্শনের ম্যাজিক। যা দক্ষ জাদুকরের হাতেই মানায় কোনও আনাড়ির হাতে নয়। এই নান্দনিকতা আর দর্শনে ত্রিরৈখিক রেখাটি আলতো করে ছেড়ে গেলেন। তাতেও সামনে এলো তিনটি শব্দবন্ধ যা নির্দিষ্ট বিষয়ের পরিভাষা,(অলক্ষিত প্রতিশ্রুতি, সরণশূন্য, লৌকিক অনুবর্তন)
      আশ্চর্যের বিষয় কবি কিন্তু খুব সন্তর্পনে অবগাহনের জন্য এক পা এক পা করে নামছেন ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে, ভাব থেকে অভাবে। কবিতার শেষ দুটো লাইনটি লক্ষণীয়--

"একে অন্যের প্রতিরোধে লীন, পুণ্যশ্লোকের ব্রত নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রেরক প্রাপকের সমস্বর, নির্ভার ক্ষেত্রে নিয়তির মতো, একমাত্র..."

এই বাক্যবন্ধে এসে যখন কবি পৌঁছচ্ছেন তখন আর ভাব নেই, অভাবও নেই। চিরন্তন ও অমোঘ বাস্তবতাকে ডিঙিয়ে পাঠককে এনে দাঁড় করিয়ে দিলেন বস্তুবাদের মুখোমুখি।

        এই কাব্যগ্রন্থটির ম্যাজিকের শেষ নেই তাই প্রতিটি কবিতা লাইন ধরে ধরে আলোচনা করতে গেলে আমার সমালোচনার বহর বেড়ে কাব্যগ্রন্থকে ছাপিয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাই একটি উদাহরণ থাক। তবে-- "মহাকবির ব্যঞ্জনা", "আত্মজ্ঞান", "নির্ঘুম সৌরকণা", "ব্রাত্যজন", "অলৌকিক প্রকল্প", "ত্রিভুজ"  কবিতাগুলি নিয়ে একটা দীর্ঘ দর্শনসার ও মনোবৈজ্ঞানিক আলোচনার লোভ থেকেই যায়। তবে ঋত্বিকের "দিনলিপি" নামক কবিতাটি আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে 'দেশ' পত্রিকাতে পড়েছিলাম কোনও একটা সংখ্যায়।
         যাক সে কথা যা বলে লেখাটা এই পর্যায়টি শেষ করা উচিত তা হল ম্যাজিক। এই ম্যাজিক কবিতার ভাব ভাষা কিম্বা গভীরতা ভিত্তিক নয়, এই ম্যাজিক কবিতা ক্রমসজ্জায়। যাঁদের প্রাচীন লিপি সম্পর্কে সামান্য ধারণা থাকবে তারা 'ক্লু'টা ধরে ফেলবেন টুক করে। একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা সহজ করি--

ওপরের চিত্রটি একটি প্রাচীন মন্দিরের। পাঠোদ্ধার কষ্টকর তাই বর্তমান লিপিতে লিখলে দাঁড়ায় তা নিম্নরূপ--

  "পক্ষ্যবেদসমুদ্রশ্চ শশি-
 সঙ্খ্যা সকাব্দসু। কেশবঃ 
 প্রিতকার্য্যে সুদার্ষদা চ দদা-
ম্যহং।। সকাব্দা ১৭৪২। ১১।।

এবার অন্তত ভাবুন শ্লোকটির অর্থ? 

অনুবাদে যা দাঁড়ায়--
পক্ষ, বেদ, সমুদ্র, শশি ১৭৪২ সকাব্দের ১১ সংখ্যক মাসে কৃষ্ণের প্রীতিকার্যের জন্য আমি এই সুন্দর প্রস্তরনির্মিত মন্দির দান করলাম।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই কাব্যালোচনায় আবার এই সব পুঁথিপত্র ক্যানো বাওয়া! এমনিই সব ঘেঁটে যাচ্ছে আবার অ্যাত্তো প্যাঁচ ক্যানো! সত্যি দরকার ত্যামোন নেই সহজবোধ্য করার সামান্য চেষ্টা মাত্র।

এবার নিশ্চয় শ্লোকটি বুঝেছেন? কিন্তু আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে যখন সব সংকেত পরপর সাজালাম, আমার সামনে মুহূর্তে ঘটে গ্যালো একটা অনির্বচনীয় ম্যাজিক। "পক্ষ, বেদ, সমুদ্র, শশি" এই চারটি শব্দের প্রয়োজনীয়তা কী? উত্তর হবে--

পক্ষ (২টি), বেদ (৪টি), সমুদ্র (৭টি), শশি (১টি)।
এবার এই সংখ্যাগুলি রিভার্স বা অঙ্কের বামাগতিতে সাজালে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১৭৪২(যা ঐ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সন)
         কবি ঋত্বিকও এই কাব্যগ্রন্থের ক্রমসজ্জা সেই বামাগতির পদ্ধতি চুপচাপ ছেড়ে গ্যাছেন যা ধরতে হলে মস্তিষ্ক তো সামান্য খাটাতেই হয়। 
      জানি আপনারা প্রশ্ন করবেন, এর প্রমাণ কী?

তাহলে বলব শেষ কবিতাটা একটু পড়ে নেবেন। নাম "কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা" যা কাব্যগ্রন্থেরও নাম। অর্থাৎ মেধার ওপর আস্থা রাখলে এই কবিতাটি হবে বইটির প্রথম কবিতা। তবে প্রথম কবিতা যেটা সেটা কী প্রথম নয়? আজ্ঞে সেটাও প্রথম, কিন্তু আপনি যদি ভাববাদের ওপর নির্ভরশীল হন। এবার বাকিটুকু আপনার হাতে আপনি কোনটাকে বেশি প্রাধান্য দিতে চান।

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা

১.
স্বনামধন্য সংসারেই থাকে নশ্বরতার প্রখর রোদ

এই তো চিরায়ুষ্মান গণ্ডিরেখা, আত্মার প্রতীক সীতা রাবণের প্রতিরূপে ঘুমিয়ে, স্বপ্নে ত্রিভুজ উপধ্বনি চন্দ্রাবতী জানেন স্বগত শ্রুতি ও আধুনিক অনুষঙ্গ

কর্ষণ অযোগ্য জেনেও গড়ে ওঠে ভূমি ও ভূমা...

২.
আকর্ষণ হারিয়ে বোধগম্য আয়ুর বিপরীতে সাধন অশ্রুর পথ ধরেই নিহিত পাতাল নির্ণয়, কারুকাজ যা পূর্বধ্বনিত কীলক লিপিতে, শেষপালা রাধাবিরহ নিষ্প্রয়োজন 'খণ্ড' লেখা। গৌণ ব্যক্তি, নক্ষত্রপ্রলাপ ভূর্জপত্রে লেখা থাকে সমাসবদ্ধ রোদনের গান।          

🍂

Post a Comment

0 Comments