জ্বলদর্চি

অথচ লাল বালুঘড়ি, হ্রস্বস্বর ও যামিনী কালের অসুখ /শাশ্বত বোস

অথচ লাল বালুঘড়ি, হ্রস্বস্বর ও যামিনী কালের অসুখ

 শাশ্বত বোস

মাছ ধরার ছোট্ট ডিঙিটা এখনো তেরছা করে রাখা| ঠিক যেরকম আলো, সূর্য্যের গা থেকে ছিটকে এসে পড়লে, বালিতে সোনা বলে ভ্রম হয়, এটা ঠিক সেরকম নয়| বিকেলের শেষ কনে দেখা আলো, নিজের জন্মদাগ মুছে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে, লাল কাঁকড়ার বিচে পাড়ি জমিয়েছিল, কত শত আলোকবর্ষ আগে| এখনো হয়তো তার, পৌঁছাবার সময় হয়নি| তবু ভৈরবী রোদে, চিকচিকে বালির বদলে, সাগরের ফেনিল স্রাব গায়ে মেখে, বিচটার সারা গা বেয়ে, তখন হেঁটে চলেছে, কয়েক শত কিংবা কয়েক অর্বুদ, লাল কাঁকড়া| মাথার থেকে বড়, সামনে দুখানা দাঁড়া| সরু মোটা শরীর খানা দুলিয়ে, হেলে বেঁকে এগিয়ে চলেছে, দিগন্তের বিপরীতে| ঠিক যেমনটা কলিমুদ্দিন, ছোট বয়সে হামা দিত, এই নির্জন পুরুষোত্তমপুরে| তার বাপ দাদার সময় থেকে, এই অববাহিকায় বাস কলিমুদ্দিনের| তার ঈদ-পরব-রোজা-সেহরী-ইফতারী, সব কিছু জুড়ে, ক্ষুধা ভরা মানচিত্র আঁকে, এই নির্বিকার কাঁকড়ার দল| বর্ষার সময়, আকাশের গায়ে জোলো মেঘ লাগলে, ডিঙ্গিটাকে আলকাতরার পোঁচ লাগায় সে| অভ্যেসবশে, এবার শুধু ভেসে পড়বার পালা| এরকম কৃষ্ণকায় কল্পনায়, মায়াবিলাসী বিকেলে, আকাশের দিকে চেয়ে, সে বলে ওঠে, “মাছ বেইচ্চা, একদিন আমি বড়লোক হইবো|”

🍂

কিনারায় তার মা দাঁড়িয়ে থাকে অপেক্ষায়| নোনা জলে, ডিঙিটা নিয়ে ভেসে পরে কলিমুদ্দিন| লবনাক্ত ফেনা, ঝুপ করে ছিটকে এসে, তার শরীর ভিজিয়ে দেয়| সমস্তটা নুন, সে শুকনো চামড়ার নিচে শুষে নেয়| এখনো নিকে হয়নি তার, বাতচিত শুরু হয়েছে সবে| ছোকরী শরীরের নোনা, আর সাগরের পানি, দুটোই এখন এক কলিমুদ্দিনের কাছে| এক নিষিদ্ধ জগৎ, কিংবা দূর আকাশের গায়ে, গজিয়ে ওঠা মাংসের হাতছানি|

মা টাকে নিয়ে ইদানিং চিন্তা হয় খুব| বুড়ির বয়স বাড়ছে, চোখের আলো নিভু নিভু| মা চলে গেলে, এই নিস্তব্ধ চরাচরে, সত্যিই কলিমুদ্দিন একা| সেদিন হয়তো, ওই কাঁকড়াগুলোই ওর টুঁটি টিপতে আসবে| নোনা উপত্যকার স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে, নিজেদের মস্ত মাথা আর দাঁড়া দুলিয়ে, খুবলে খাবে, কলিমুদ্দিনের ঘুন ধরা, শরীরের মাংস| ভাবতেই ধড়ফড়িয়ে ওঠে কলিমুদ্দিন| জড়িয়ে ধরে বুড়ি মাকে| বুড়ি হেসে ওর জংলা চুলে হাত দেয়| মা ছেলের বাৎসল্যে, ওদের পাতার ঝুপড়িটা কেঁপে ওঠে| ফাঁক দিয়ে, আকাশের তারা দেখে কলিম| জ্যোতিষ্কব্যাপী শূন্যতায়, আকাশ ভেঙে ঝিকিমিকি তারা, নেমে আসতে চায়, মা-ছেলের মাঝখানে|


বীথিকার বুক কাঁপিয়ে, বালুচরে হাওয়া ওঠে| ছুটতে ছুটতে, গ্রহণযোগ্য সূর্য্যসীমা পেরিয়ে, বনজ্যোৎস্নাকে বুকে করে, সেই হাওয়া পাড়ি দেয়, শহরের কোন এক অভিজাত কলতলায়| কলকাতা শহরের দক্ষিণতম প্রান্তে, কোনো এক সভ্য প্রদেশে, তখন কর্পোরেট সর্বস্ব ছেলেটি, তার নিজের মা কে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়, দশ তলার ছাতে| অশীতিপর বৃদ্ধার,স্মৃতিভ্রংশের সুযোগ নিয়ে ঠেলে ফেলে দিতে চায়, ছাত থেকে| সারাজীবনের জন্য, সমস্ত দায়ভার থেকে আক্ষরিক অর্থেই মুক্তি পাবার বিপন্ন উপায় খোঁজে| পিছনে তখন সকাল-বিকেলের, নারীবাদী সমীকরণ, "উফফ আর পারিনা | এ বুড়ি আমার লাইফ টা হেল করে দিল| বুড়ি মাগী বিছানায় বসে হাগবে, আর সব ঠেলা আমার |" বয়সের অনেক ভুল আর নিয়মমাফিক নোটিফিকেশনের মাঝে, ছোট হয়ে যাওয়া শরীরটা, হঠাৎ বলে ওঠে, "বাবু, পাখি হবি?"

দূরে কোন গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে, শূন্যে ঝাঁপ মারে মাছরাঙা, নতুন উড়তে শেখা বাচ্চাটাকে বুকে করে| ওরা একদিন ঠিক উড়ে যাবে, ওই লাল কাঁকড়ার দ্বীপ দিয়ে|  

Post a Comment

1 Comments