জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা/পর্ব- ৩৯ /গৌতম বাড়ই

চিত্র- মণিদীপা দাস 

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৩৯
গৌতম বাড়ই


ছোটোমহলের গুপ্তকথায়


দাস- দাসী আরও এসেছে বঙ্গরাজার রাজপ্রাসাদ থেকে। বঙ্গেশ্বর পাঠিয়ে দিয়েছেন রাঢ়ের এই ছোটোমহলে। যাতে তার কন্যা ও পৌত্র- পৌত্রীর একদম কষ্ট না হয়।  সিংহবাহুর জন্য সেনাপতি অনুরের তত্ত্বাবধানে অসিচালনা, তীরন্দাজী, অশ্বচালনার নিবিড় অনুশীলন চলছে। রাজবংশের রক্ত তো শোণিত ধারায় আছে, সেনাধ্যক্ষ অনুর কদিনেই বুঝতে পারলেন তার অনুশীলন দেখে, এই যুবক অচিরেই একজন শ্রেষ্ঠ বীরে পরিণত হবে। পিতার কাছ থেকে এই দেহে যেমন কিছু দুষ্টুক্ষতের মতন পশুচিহ্ন পেয়েছেন, আবার তেমনি প্রবল প্রকাণ্ড একটি কলেবরও পেয়েছেন। দুচার বছর পরে ক্রমে এই ছেলে একজন ভীমাকৃতি চেহারায় বিপুলায়তন মানুষে না পরিণত হন! সুসীমা আপন পুত্রের দিকে তাকিয়ে কত কথা ভাবছেন, আর দাঁতে দাঁত চেপে ভয়াল ভয়ংকর সেই প্রতিজ্ঞা মনে মনে পুষছেন। একদিন তিনি তার এই প্রতিজ্ঞার বাস্তবটুকু ঘটাবেন-ই।

প্রতিটি বিষয়ে শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের হাতেই সিংহবাহুর অনুশীলন চলছে। তীরন্দাজ দলের গুরুমশাই এর মধ্যে সেনাপতি অনুরের কাছে সিংহবাহুর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অশ্বারোহণ আর পরিচালনার ক্ষেত্রে সেনাপতি অনুর নিজেই যতটা পারেন দেখভাল করছেন। যদিও এখানেও তার জন্য একজন সুদক্ষ ঘোড়সওয়ারী সৈন্য শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। ছোটোমহলের প্রান্তরে সিংহবাহু একজন সুদক্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠছেন। অনুর দাগচিহ্ন এঁকে রেখেছেন একটি বড় প্রস্তর খন্ডের ওপর। কারণ, আবার ঋতু বদলে বদলে এমন সময় ফিরে এলে, সিংহবাহু একটি চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। 

এদিকে পশুরাজের অত্যাচার দিনকে দিন বেড়েই চলেছে, রাঢ়ের বনাঞ্চলে সব মানুষ জন আজ বিপদগ্রস্ত আর আতঙ্কের মধ্যে বাস করছে। কেউ জানে না কখন কার ওপর ভয়াল ভয়ংকর এক আক্রমণ করে বসবে সিংহরাজ। সেই মানুষটি যদি নারী হয়, তবে তার আক্রোশ আরও বেশি হয় তার ওপর। শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হন তিনি। কিশোর কিশোরী কেউ তার আক্রমণ থেকে ছাড় পাচ্ছেন না। রাঢ়ের প্রজাদের ঘরে- ঘরে আজ প্রবাহমান শান্তি শ্মশানের মতন নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে। তার স্ত্রী এবং পুত্র- কন্যাকে হারিয়ে সে পাগল হয়ে উঠেছে। ক্রোধে হিতাহিত জ্ঞান আজ শূন্য। আর এই শূন্যতাই যে ধ্বংস করে সবাইকে। সুসীমার সেই অরণ্যের গুহা-আবাসের নিকটস্থ গ্রামগুলির মানুষজন সিংহরাজের অত্যাচারে একদম বিপর্যস্ত। সিংহরাজ জানে এখানকার লোকজনের গোপন আশ্রয়ে সুসীমা তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে লুকিয়ে আছে। তাদের নিকটজনেদের মধ্যে বেশকিছু জন এর মধ্যে সিংহের আক্রমণে পড়ে প্রাণ খুইয়েছেন। সবমিলিয়ে বাতাসে এক ভয়ের আবহ তৈরী হয়েছে তাতুলি পাহাড়ের দিকে। 

🍂

সৈন্যেরা, দাসদাসীরা, পাচক, পাহারাদার সবাই আড়ালে নিজেদের মধ্যে সিংহবাহুর চেহারা নিয়ে নানান কথা বলেন। সুসীমার অল্প বয়সে কামাতুর হয়ে সিংহের কাছে নিজেকে সমর্পণ করার গল্পও সময়ের স্রোতে চাপা পড়ে থাকেনি, সময়ের ধারায় তারাও হাজির হয়েছে তাদের কর্ণকুহরে। সিংহবাহু এক দুটো ঋতু বদলের মধ্যেই শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপুলভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। এখন এই ছোটোমহলে তাদের বাসস্থানের অভাব নেই, সিংহবাহু এখন বিরাট এক আরামদায়ক কক্ষে একাই থাকেন। তার মাতা সুসীমা আর ভগ্নী সিংহসিবলী পৃথক একটি কক্ষে থাকে রাজকন্যাদের মতন । মেয়েরা বড় হয়ে গেলে যতটা মায়ের দরকার হয়, ছেলেদের ঠিক উল্টোটাই ঘটে। শরীর ওদের নিকটে আনে, শরীর ছেলেদের দূরে ঠেলে। এর বাইরে আরও একটি কথা, আসলে তার মাতা বঙ্গেশ্বরের কন্যা সুসীমারই তো বংশানুক্রমে এই সম্পদ পাওয়ার কথা। বঙ্গেশ্বর তাদের কথা শুনতে পেয়ে হয়ত সেইমতন নির্দেশও পাঠিয়েছেন। না হলে তাদের তদারকি খাতির যত্ন দাসদাসী লোকবল সবই এরমধ্যে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে, সিংহবাহু নিজেই তা বুঝতে পারছে। সিংহবাহু অরণ্যে গুহাআবাসের বসতকালে , সেই চরম দুর্দিনে মাতার কাছ থেকে তাদের বংশ পরিচয় পেয়ে আর তার পিতৃদেব সিংহরাজের ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। শুধু মনে হয়েছে তার মাতা সুসীমা শুধুমাত্র রূপসীমাত্র একজন মহিলা নয়, তার রূপের বাইরেও তিনি অসামান্যা। তিনি দৃঢ়চেতা আর লড়াকু, সাহসিনী। মোলায়েম জমিতে বসবাসের একচেটিয়া স্বত্বাধিকার নিয়ে এসেও তিনি রুক্ষ বন্ধুর শক্তমাটিতে স্বেচ্ছায় বসবাসের জীবন বেছে নিয়েছেন, নিজের সাথে এই জগতের কারও সাথেই কোনোদিন আপোস করেননি। 

সিংহবাহুরা সৈন্যদের ঘেরাটোপে নিশ্চিন্ত জীবন- যাপন করছেন। বাইরে থেকে কেউ এসে সহসা তাদের আক্রমণ করতে পারবে না। সেনাপতি অনুর বঙ্গেশ্বরের জরুরি তলব পেয়ে বঙ্গদেশের রাজপ্রাসাদে ছুটে গিয়েছেন আজ প্রায় দুদিন হল, তার কিছু বিশ্বস্ত অনুচর নিয়েই। বঙ্গেশ্বর সেনাপতির অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। অনুর রাজমহলে প্রবেশ করতেই বঙ্গেশ্বর রাজসভা থেকে হঠাৎ প্রস্থান করলেন তার নিজের কক্ষে। সেনাপতির কাছে আগে রাঢ়াঞ্চলের সব খবরা খবর নিলেন। কুশল জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর কন্যা এবং পৌত্র-পৌত্রীর। সিংহের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করলেন অনুর, আর বললেন-" পশুরাজের অত্যাচার সহ্যের শেষমাত্রা ছাড়িয়েছে। " বঙ্গেশ্বর অনুরের কাছ থেকে এইসব সংবাদ পেয়ে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠলেন, বললেন- " সেই পশু এখনও জীবিত আছে কী করে? সেনাপতি জলে যেমন কুমির শক্তিশালী, বনে- জঙ্গলে বাঘ সিংহ শ্বাপদেরা। এতবড় অরণ্যে ঐ সিংহকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সে এই বন- জঙ্গলের নাড়ি নক্ষত্র জানে। তার নিজের আগাম বিপদ বুঝে কোথাও সাময়িক ঘাপটি মেরে থাকা কোনও ব্যাপার নয়। রাঢ়ের গ্রামে- গ্রামে রাজার এই পুরস্কার প্রদানের বার্তা ছড়িয়ে দাও, সিংহকে সংহার করতে পারলে রাজকোষ থেকে সেই ব্যাক্তি বা তাদের সম্মিলিত জোটকে প্রচুর সোনাদানা আর মূল্যবান সামগ্রী দেওয়া হবে। মানুষজনকে জোট বেঁধে একত্রিত হতে বলো। এই জোটবাঁধাকে পৃথিবীর সব শক্তি ভয় পায়, সিংহ তো কোন ক্ষুদ্রকীট এখানে! "

সেনাপতি অনুর শোনালেন সিংহবাহুর একনিষ্ঠ হয়ে অনুশীলন চালনার কাহিনী। এরই মধ্যে সে বলতে গেলে সামান্য কদিনের নিবিড় অনুশীলনে বড়যোদ্ধা হয়ে উঠেছে। বঙ্গেশ্বরের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেনাপতিকে বললেন, "কাশীরাজ্য প্রভূত শক্তিশালী জ্ঞান, গরিমায়, সম্পদে। কাশীনগরের সুনাম পৃথিবীর নানান দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ওখান থেকে পন্ডিত ব্যাক্তির সন্ধান করতে হবে, তাকে কিছুকালের জন্য রেখে, সিংহবাহুকে রামায়ণ আর মহাভারতের শিক্ষাদান করাতে হবে মূল ভাষাতে। না হলে তার জ্ঞানচক্ষু খুলবে না। সেনাপতি অনুর, তোমায় হিসেব করেই তার পারিশ্রমিক ঠিক করে নিতে হবে। দেখো কোনো কাপর্ণ্য না হয় এতে। আমার বংশধরকে আমি আরও আলোর পথে নিয়ে যেতে চাই। আলোকিত শক্তি দীর্ঘদিন পৃথিবীতে স্থায়ী হয়ে রয়ে যায়। ক্ষমতার শক্তি বাহুবলে বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তাই, ছোটোমহলে ফিরে যেতে যেতে পথে সিংহনিধনের পুরস্কারের বার্তা ছড়িয়ে দেবে আগে। পরে দূতের মাধ্যমে কাশীদেশে মুনি ঋষি পণ্ডিতের সন্ধান করবে সেনাপতি। কলিঙ্গদেশেও রাজার কাছে এ সংবাদ প্রেরণ করতে পারো আমার নাম করে। এতেও অনেকটা কাজ হবে। তারও বংশের রক্তের ধারা ওদের শিরায় শিরায় । আর অতি অবশ্যই সিংহের অরণ্যআবাসের স্থানের লোকালয়েও পৌঁছে দিতে হবে এ বার্তা। এতে সিংহপশুর মনের ওপর একটি চাপও সৃষ্টি হবে। এখন বঙ্গরাজও যে তাকে রেহাই দেবে না সে বুঝতে পারবে। তার অত্যাচার আর ছোট করে দেখা হচ্ছে না। রাজকন্যা সুসীমার সাথে ওর সম্পর্কটা দুঃস্বপ্নের মতন। এই দুঃস্বপ্ন চিরদিনের মতন মুছে ফেলতে হবে। তাই সিংহের হত্যা ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন। শুধু দুঃস্বপ্নের দুটোবীজ ইতিহাসে চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে যাবে! অনুর উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করো। "
সেনাপতি অনুর তার চিরকালের বিশ্বস্ততা অটুট রেখে প্রতিটি কথা গভীরভাবে মনযোগ দিয়ে শুনলেন। 


তিনি পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লেন রাজ আজ্ঞা অক্ষরে  অক্ষরে পালন করতে। তার সৈন্যদল ভোররাতে উঠেই তৈরি হয়ে আছে। প্রতিটি রাজার নির্দেশের ভেতরে অনেকগুলো অভিসন্ধি লুকিয়ে থাকে এ দীর্ঘদিনের দক্ষ সেনাপতি অনুর ভালোমতন জানেন। অনুর শুধু সেনাধ্যক্ষ নন, প্রয়োজনে মহামন্ত্রী তো আদতে তিনিই। পুরো বঙ্গদেশের পরিচালনা একা এই সেনাপতির হাতেই পরিচালিত হয়। তবুও রাজার সর্বোচ্চ ক্ষমতা আর রাজশক্তির ক্ষুদ্ররূপ যাতে প্রকট না হয়ে পড়ে, সেজন্য অনুরকে ছোটোমহলের মতন ভিন্ন এক জায়গায় বহিঃশত্রুর আক্রমণ আরও সুচারুরূপে ভাবে  প্রতিহত করবার জন্য রেখে দেওয়া হয়েছে। সেনাপতি অনুরও বিলক্ষণ জানেন, বঙ্গরাজের অন্তর ভেতরে পুড়ে খাঁক হয়ে গেলেও রাজকন্যা সুসীমা আর তার পুত্রকন্যার কাছে সহজে ভেঙে পড়বেন না। শুধু সময়ের অপেক্ষা। রাজা মচকাতে জানেন, ভাঙতে জানেন না। বঙ্গরাণীর অকাল মৃত্যুর পর বঙ্গরাজ ভেতরে আরও ভেঙে শতধা টুকরোয় চৌচির হয়ে গিয়েছেন, বাইরে প্রকাশ নেই। নিস্তব্ধ রাজ হৃদয়! অনুর  বঙ্গরাজের নিকটস্থ একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারী বলেই এ অনুভব করেছেন। তবে তার অন্তরের সুপ্ত এবং গভীরতম ইচ্ছে,  যত দ্রুত সম্ভব তার কন্যার সাথে দীর্ঘ যুগের বিচ্ছেদের অবসান ঘটিয়ে সাক্ষাৎ করবেন, আর এ সাক্ষাৎ রাজা তো যে কোনও দিনে করবেন না, তাকে স্মরণীয় করে রাখতে চাইবেন। অনুর জানে এ সব হবে শুভ এক সময়ের দিনক্ষণের সাথে, বঙ্গরাজ সেই সময়ের অপেক্ষায় আছেন। একাকী মধ্য নিশীথে বঙ্গরাজা নিদ্রাহীন এক একদিন ঠায় বসে থাকেন রাজমহলায়, সেনাপতি জানেন সব। 

প্রাতকালে বেরিয়ে পড়লেন সেনাপতি,  লোকালয় দেখলেই সেনাপতি অনুরের নির্দেশে ঘোষক ঢেরা পিটিয়ে দিচ্ছেন, ঢাক- ঢোল বাজিয়ে, মহারাজ বঙ্গেশ্বরের মহার্ঘ্য পুরস্কারের। প্রজাগণ পুরস্কারের বিবরণী শুনে এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। আড়ালে বলতে লেগেছিলেন, " এ কর্মটি খুব সরল তো নয়ই, এতে আবার প্রাণহানির আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। তবে সেই পশুরাজের কাছ থেকে বাঁচতে হলে আমাদের জোট বাঁধতেই হবে। রাজার এই বার্তাটি সুন্দর। তবে ভীষণ কঠিন এই কর্ম!"

সেনাপতি অনুর তার অশ্বারোহী দলের সঙ্গে রাঢ় দেশের ছোটোমহলের দিকে ছুটে চলেছেন। সমগ্র বনাঞ্চল জুড়ে ঘোড়াদলের টগবগানো আওয়াজে মুখরিত। আর বারেবারে ঘোষকদলের বাদ্যের আওয়াজে প্রকৃতির সেই নিরিবিলির দেশে নিস্তব্ধতা খানখান হচ্ছিল শব্দে- শব্দে। 
ক্রমশ

Post a Comment

0 Comments