জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৮ /বিজন সাহা

মি-৪ বা ক্রোকোডাইল যা আফগান যুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছিল

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৪৮ 

বিজন সাহা 

পুগাচেভ 

সামারা থেকে আমরা চলছি সারাতভের দিকে। আমার মনে তখন হাজারো প্রশ্ন। এত কাছে এসেও রাশিয়ার অন্যতম প্রধান এক শহর প্রায় না দেখেই আমরা চলে যাচ্ছি। মনে করার চেষ্টা করছি সামারার পরিচিত মানুষদের কথা। সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করত। আমি খুব পছন্দ করতাম চিঠি লিখতে। বিশেষ করে ১৯৮৬-১৯৮৭ সালে যখন সর্ব সোভিয়েত ছাত্র সংগঠনের শিক্ষা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি তখন ফর্মাল ইমফর্মাল প্রচুর চিঠি লিখতাম। খারকভ, লেনিনগ্রাদ, কিয়েভ, ওদেসা, কিশিনেভ, মাহাচকালা, তাসকেন্ত (তাসখন্দ), আস্ত্রাখান, রাস্তভ না দানু (রোস্তভ অন ডন), ভারোনেঝ, ক্রাস্নাদার, মুরমানস্ক – কত শহরে যে চিঠি লিখেছি। পরবর্তীতে কাজান, উলিয়ানভ, পেরম ইত্যাদি বিভিন্ন শহরের অনেকের সাথে আলাপ হয়েছে। কিন্তু মস্কোয় এক বিকেলে পরিচয় হওয়া সামারার এক মেয়েকে ছাড়া কারো কথা মনে করতে পারছিলাম না। পড়ে বুঝলাম এর কারণ সামারা বা তৎকালীন কুইবিশেভ ছিল বিদেশীদের জন্য বন্ধ। তাই আমাদের কেউ এখানে পড়াশুনা করত না, যেমন করেনি গোর্কি বা নিঝনি নভগোরাদে। যাহোক, আমরা সামারা থেকে চলে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত সামারাই একমাত্র শহর যেখানে আমি কোন উপাসনালয়ের দেখা পাইনি, কোন ছবি তুলিনি। আসলে গত সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের কয়েকটি ছবি আর আজ সকালে ভোলগার তীরে কয়েকটি স্ট্যাচুর ছবি ছাড়া আমার আর কিছুই তোলা হয়নি। সেদিক থেকে সামারা আসা অনেকটা না আসার মতই। তবে আমার ধারণা এতে দিলীপ আর দেমিদের খুশির সীমা ছিল না। সামারা মিলিওনিয়ার শহর, মানে এখানে দশ লাখের বেশি মানুষ বাস করে। আমাদের দেশের যদি ছোট বড় অনেক শহরে প্রচুর লোক বসবাস করে এ দেশে সেরকম শহরের সংখ্যা তেমন বেশি নয়। সোভিয়েত আমলে এ রকম এক আইন (হয়তো অলিখিত) ছিল বলে শুনেছিলাম। কোন শহরের লোকসংখ্যা এক মিলিয়ন বা দশ লাখ হলে সেখানে মেট্রো রেল তৈরি হত। ১৯৬৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর কুইবিশেভে মিলিয়নতম বাসিন্দার জন্ম হয়। তার নাম নাতালিয়া বেলভা। ১৯৮৬ সালে সামারায় লোকসংখ্যা ছিল সর্বাধিক ১২৬৭০০০ জন। এসব কথা এ জন্যেই মনে হচ্ছে যে রাশিয়ায় এত গুরুত্বপূর্ণ শহর হওয়ার পরেও মাত্র এক রাত্রি সেখানে কাটানো নিজেদের ও শহরের প্রতি অন্যায়। এখানে আরও একটি মজার তথ্য দিয়ে রাখা ভালো। কেননা সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে যেভাবে এদেশে নাম বদলানোর পালা শুরু হয়েছিল তাতে অনেকের ধারণা দেশের খোলনলচে একেবারে বদলে গেছে। সামারা শহর নিজেই তার নাম বদলিয়েছে। এই শহর নয়টি এলাকায় বিভক্ত। এর নামগুল খেয়াল করার মত – কুইবিশেসভস্কি, সামারস্কি, লেনিনস্কি, রেলপথ, অক্টোবরস্কি, সোভিয়েতস্কি, প্রমিশ্লেন্নি বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল, কিরোভস্কি ও ক্রাস্নোগ্লিনস্কি। অর্থাৎ কুইবিশেসভস্কি,  লেনিনস্কি, অক্টোবরস্কি, সোভিয়েতস্কি ও কিরোভস্কি এ নামগুলো সোভিয়েত ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বলা চলে ১৯৯১ সালে ব্যাপক পরিবর্তনের পরেও এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটলেও ঐতিহাসিক বিষয়গুলো এরা ঠিকই সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছে। আসলে বিপ্লবের পর পর বলশেভিকরা জার আমলের অনেক কিছু ধ্বংস করলেও খুব দ্রুতই সে আমলের ইতিহাস সংরক্ষণে মনযোগী হয়। একই ঘটনা ঘটে ১৯৯১ সালের প্রতিবিপ্লবের পরেও। প্রতিবিপ্লব শব্দটি এখানে অনেকেই ব্যবহার করে, সেজন্যেই বলা। 

পথের ধারে খামার বাড়ি

ধীরে ধীরে সামারা হারিয়ে যাচ্ছিল চোখের আড়ালে। বিস্তীর্ণ মাঠের উপর অজগর সাপের মত পড়ে থাকা কালো রাস্তার উপর দিয়ে দেমিদ আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল সারাতভের দিকে। এসব জমিকে বলে চেরনোজেম বা কৃষ্ণভূমি  – সবচেয়ে উর্বর ভূমি। সোনালী শস্যে ভরা। সোনালী বলছি এ জন্য যে বাংলাদেশের এই চিত্রটাই আমার চোখে ভেসে ওঠে। মাঝে মধ্যে সূর্যমুখীর ক্ষেত। তবে মনে হয় এখনও ফুল ঠিক ফোটেনি, দ্রুতগামী গাড়ি থেকে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। কোথাও কোথাও অবশ্য ফসল কাঁটা হয়ে গেছে। উত্তরে, মানে ইয়ারোস্লাভল, নিঝনি এসব এলাকায় ইতিমধ্যেই ফসল তোলা হয়ে গেছে। দক্ষিণে শীত দেরিতে আসবে বলে হয়তো এখনও ফসল তোলার কাজ পুরাদমে শুরু হয়নি। এভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যাচ্ছি, হঠাৎ চোখে পড়ল এক হেলিকপ্টার। আমি সাথে সাথে দেমিদকে বললাম গাড়ি থামাতে। কিছুটা অমত থাকা সত্ত্বেও গাড়ি থামল। আমি গাড়ি থেকে নেমে চললাম হেলিকপ্টারের ছবি তুলতে। আমাদের দেখে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন।
আপনারা ইন্ডিয়া থেকে?
আমি বাংলাদেশের, আমার বন্ধু ভারতীয়।
বেড়াতে এসেছেন?
আমি দুবনায় কাজ করি। উনি এসেছেন ভোলগার বিভিন্ন শহর ঘুরে দেখতে।
আমি ইউক্রেন থেকে। তবে অনেক বছর হল এখানেই থাকি।

🍂

কী নাম এই জায়গার?
পুগাচেভ!
পুগাচেভ? এমিলিয়ান পুগাচেভের নামে?
হ্যাঁ। এসব অঞ্চল এক সময় তাঁর দখলে ছিল। এই এলাকায় তিনি ঘাঁটি গাড়েন আর এখানেই ধরা পড়েন।  

এই বলে তিনি কিছু দূরের বনাঞ্চল দেখালেন। মনে পড়ে গেল মাত্র কিছুদিন আগে শেষ করা আলেক্সান্দর পুশকিনের কাপিতানস্কায়া দচ বা ক্যাপ্টেন দুহিতা উপন্যাসের কথা। দেশে থাকতেই সুধীর দার কেনা বইটি পড়েছিলাম বাংলায়। বয়সের কারণে হতে পারে বা তখন বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলাম বলে হতে পারে, খুব একটা পছন্দ হয়নি। কিছুদিন আগে যখন মূল রুশে পড়লাম তখন নতুন করে এই উপন্যাসতি আবিষ্কার করলাম। চোখের সামনে ভেসে উঠলো দৃশ্যাবলী। তবে যতদূর জানি সেসব ঘটনাবলী উপন্যাসের মত এমন রোম্যান্টিক ছিল না। সারাতভ থেকে কাজান পর্যন্ত সমস্ত জায়গা ছিল পুগাচভের দখলে। প্রচুর মানুষ মারা গেছিল, ধ্বংস হয়েছিল অনেক ধনসম্পদ। পাশেই কাঁটাতারে ঘেরা বিশাল মাঠ দেখে আমি ভদ্রলোককে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করে জানলাম – এটা ক্যান্টনমেন্ট। দূরে দেখা যাচ্ছিল বিভিন্ন যুদ্ধ বিমান, মূলত হেলিকপ্টার। ওনার কাছ থেকেই জানলাম এখানে রাখা হেলিকপ্টারটির নাম মি ৪, যার ডাকনাম ক্রোকোডাইল। ও আফগান যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। এই হেলিকপ্টারটি যখন উদ্ধার করা হয় এর কেবিনের ভেতরে একটি আইকন পাওয়া যায়। এটা ছিল মৃত পাইলটের। এখনও সেই আইকনটা ওখানেই রাখা আছে। আর দূরের যে হেলিকপ্টারগুলো – সেগুলো মি ৮ যা হাঙ্গর নামেই বেশি পরিচিত। সেখানে মিনিট দশ পনেরো কাটিয়ে আমরা আবার পথে নামলাম।   

লাল গাইএর উত্তরসূরিরা

আসলে এ ধরনের মাঠের শুরু এখানেই নয়। সামারা আসার আগেও এরকম মাঠের পর মাঠ আমরা পেরিয়ে এসেছি। এক জায়গায় তো এক খামার বাড়ি দেখে আমরা নেমেই পড়েছিলাম। দিলীপের খুব ইচ্ছে ছিল স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলা। সেখানে ছিল বেশ কিছু কম্বাইন – এসব মেশিন বীজ বোনা থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত সব কাজই করে। দূরে কিছু ঘোড়ার দেখাও মিলল। তবে কৃষকদের টিকির দেখা পর্যন্ত মিলল না। দেমিদ বলল, হয়তো তারা লাঞ্চ করতে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও তাদের দেখা না পেয়ে আমরা পথে নেমেছিলাম। আজ পুগাচেভ শহর থেকে বেরুনোর মুখে কিছু কল কারখানা মত দেখলাম। মনে হয় পরিত্যক্ত, তবে নাও হতে পারে। ওটা ছিল নদীর অন্য পাড়ে। আমরা সেখানে নেমে কয়েকটি ছবি নিয়ে আবার চললাম সারাতভের দিকে। এবার দেখি এক লোক ঘোড়ায় চড়ে এক পাল গরু তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সাথে কয়েকটি কুকুর। অনেকটা রুশ দেশের গল্পের মত। আমাদের খুবই ইচ্ছে ছিল ওর ছবি তোলার। তবে ও ধীরে ধীরে মাঠের ভেতরে চলে গেল। এক সময় আবার হাইওয়ের দিকে আসতে শুরু করলে দিলীপকে নিয়ে আমি নামলাম। বেশ কিছু ছবিও তুললাম। দেখলাম এদের সেচের ব্যবস্থা। কিন্তু দিলীপের ইচ্ছে ঐ লোকের ছবি তোলা। কী করা? আমি ওর দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। বললাম ওকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই, ছবি তুলতে চাই। কিন্তু কিছুতেই রাজি করানো গেল না। এদিক থেকে আমাদের দেশের কৃষকেরা মনে হয় অনেক স্মার্ট। তবে দূর থেকে ছবি তুলতে তো সমস্যা নেই। আমরা সেটাই করলাম। যদিও দিলীপ এগিয়ে ছবি তুলতে গেছিল কাজ হয়নি, কুকুরগুলো ধেয়ে এসেছিল। মানুষ কাজে ফাঁকি দিতে পারে, কুকুররা ফাঁকিবাজ নয়। এই স্তেপ দেখে আমার মনে পড়ে গেল কাজাখস্তানের কথা। ১৯৮৪ সালের সামারে সেখানে কাজ করতে গিয়েছিলাম। থাকতাম এক গ্রামে। কখনও বিকেলে যেতাম স্তেপে। অস্তগামী সূর্যের আলোয় মনে হত দূরে যেন জলাশয় দেখা যাচ্ছে। আমি আর আহসান বলতাম ওগুলো মরীচিকা – ঠিক মরুভূমিতে যেমন। কখনও কখনও আমাদের সাথে ওয়াজেদও থাকত। আহসান এখন দেশে, নামকরা শিশু বিশেষজ্ঞ। ওয়াজেদ আমাদের ছাত্রজীবনেই মারা যায় ক্যান্সারে।     

পুগাচভ – ভিডিও বার্তা 

https://www.youtube.com/watch?v=8v8IMGjLYjw&t=6s

ছবিতে পুগাচেভ  

http://bijansaha.ru/album.php?tag=258

 

   

Post a Comment

0 Comments