জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন /পর্ব -৩ /মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব -৩
                 
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

 || জলের শেকড় বেঁকে গেছে যতদূর ||

প্রত্যেক শনিবার রাতে ঝিনি খুবই চেষ্টা করে জেগে থাকতে। অথচ সন্ধের পরেই কে যে তার দু'চোখে আঠা লাগিয়ে দেয়, আর ঢুলতে ঢুলতে সে দু'এক গাল মার মাখা ভাতের গ্ৰাস গিলে নিয়ে কোনোরকমে মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ে। আবার ঘুমের মধ্যে সে উঠেও বসে বারবার। লাস্ট বাস কত রাতে আসে? আধো ঘুমেও চেনা গলা শুনতে পায় যেন।
       আর পরদিন সকালে― ঝিনি, ওঠ ওঠ, দেখ কে এসেছে। পাশ ফিরে শুলি যে? কাল তো কখন আসবে, কখন আসবে করে গলা শুকোচ্ছিলি। আচ্ছা সরো তো দেখি। বাবা এসে তার গালে গাল ঠেকিয়ে ঝিনুক মা, সকাল সকাল উঠে পড় তো। ওরে ব্বাবা, দেখেছ কাণ্ড, কত বড় সে কুমড়ো ফুল! তোমরা তো খেয়ালই করোনি, এ যে দেখছি ধামার চাইতেও বড়! ও বাবা, বাড়তে বাড়তে ফুলটা কি আমাদের বাড়িটাই ঢেকে ফেলবে নাকি গো! কই কই দেখি, কত বড় ফুল বলে সেও ঘুম ঠেলে উঠে বসে।
       এই তো ছিলো, কে নিলো বলো দিকিনি? ওই পটুদের বাড়ির পমপম ছাড়া আবার কে? এ তল্লাটে ওর মতো দুষ্টু কুকুর আর কে আছে? দেখেছ বিনু,যেই আমি মেয়েটাকে তুলতে এলাম, পমপমও ফুলটা মুখে করে হাওয়া। ধামার মতো ফুল দিয়ে সে কী করে? সে কি আর আস্ত আছে? খেলতে নিয়ে ছিঁড়ে এতক্ষণে কুটিকুটি। ওই তো তার কাজ।
      রোববার ছুটি আর সোমবার বাবার অফ ডে।অফ ডে মানে হলো― মা আর দাদারা যে যার স্কুলে যাবে। সে সকাল থেকে বাপির পিছু পিছু ঘুরবে। বাগানে মাটি খুঁড়বে। ইচ্ছে মতো নয়নতারা বা গাঁদার চারা বসিয়ে বলবে, আমার বাগান। এই গাছগুলো আমি পুষবো। হাত-পায়ে মাটি মাখলেও কিচ্ছু বলবে না তার বাবা। বরং, গাছ চেনাবে, ফুল চেনাবে। মঙ্গলবার ভোরে সে ওঠার আগেই রওনা দেবে বাপি‌। জেগে উঠে সে খিট-খিট করে, উল্টোপাল্টা বায়না করে, আর ধমক খায়। রুটিতে খেজুর গুড় মাখিয়ে বটে দেয় রুবিদি। 
        রুটিডা দুধে ভিজোয়ে খাইয়ে নে। না, খাবো না। তুই আমার রুটিতে গুড় দিলি কেন? এখন চোখ-নাক বানাব কীভাবে? রুটি কামড়ে দুটো চোখ আর নাক বানিয়ে সে তো রুটিখানা মুখে চাপা দিয়ে ঘুরবে খানিক‌ তাই সে ঠেলা দেয় রুবিদিকে, চেঁচাতে থাকে। দ্যাহোদিন ও মাসি, বুনডি ত্যাহোনের থে এইপিলে মারতিছে আর রুটিও কলাম নষ্ট করতিছে। কী মিথ্যুক এই রুবিদিটা। 
       রোজ খাবার নষ্ট, জানো কত লোক খেতে পর্যন্ত পায় না? কাল থেকে টুকরো করে দুধে মিশিয়ে দিবি। খেয়ে নাও, নাইলে ঘরের কোণে কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে কিন্তু। হ্যাঁ-হ্যাঁ ঝিনি, তুই বরং কানে ধরেই দাঁড়া। পড়ার ফাঁকে খুচরো মজার লোভে দাদামনি দাঁড়িয়ে যায়। বোনের পেছনে না লেগে স্কুলের পড়া শেষ করোগে যাও। নইলে তোমার কপালেও দুঃখ আছে। মার ধমকে দাদামনিও গুটি-গুটি সরে পড়ে। 
     একটু পরেই বই গুছিয়ে স্নান আর হাপুস-হুপুস খেয়েই বন্ধুদের সঙ্গে দল ধরে দুই দাদাই রওনা দেবে। ক্যালক্যাল করে কথা বলতে বলতে খুব জোর হাঁটবে সবাই। স্কুল খুব দূরে না হলেও প্রেয়ারের আগে এক পক্কড় খেলে নেওয়ার জন্য তাদের তাড়া থাকে খুব। দেরি হলে ওদের বন্ধুরা রাস্তা থেকেই ডাকা-ডাকি শুরু করে। ঝিনির কোনো বন্ধু নেই!
      বন্ধু যে কাকে বলে? যাদের সঙ্গে দাদারা খেলতে যায়? জ্বর হলে বইয়ের মধ্যে পেন্সিলে দাগ দিয়ে কোন অবধি পড়া দেখিয়ে দেয়? বন্ধু মানে দল বেঁধে চড়ুইভাতি? রাত জেগে ইস্কুলের সরস্বতী পুজোর জন্য রঙিন কাগজের শেকল আর খইয়ের মালা গাঁথা?কোচিং সেন্টারের চিরকুট? কলেজে হস্টেলের রুমমেট? মেট হয়তো ঠিকই হয়তো তারা   কি বুকের খুব কাছে আসে...আহা তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলার মতো ছায়া হয়ে মিশে যায় ছায়ার সাথে?
      কবে থেকে আবার বন্ধু নামের প্রিয় সব মুখ নিরুত্তাপ অচেনা হয়ে যায়, আর জবুথবু হয়ে মন একলা চশমার পাশে ঘুমিয়ে পড়ে? চশমা, আহা একজোড়া কাঁচ তবু নিরালা! চোখ দু'টিও তো খোঁজে স্রেফ নিঃসঙ্গ আরও দুই চোখ! শীতের দুপুরও তেমন, হাওয়ার জানলা পেতে রাখে। খুঁজতে বেরোয় নির্জন মানুষ। পোড়া মা তলার বাজারে যায়। কাটোয়া লাইনে যায়। গ্রামীণ বইমেলায় উল্টে দেখে চটি বই এক ফর্মা। দেখে খুদি খুদি অক্ষরে নাম লেখা আছে।
     মাজারের ধুপ থেকে, শীত লাগা কুকুরের কান্না থেকে লেখা তুলে আনে সে। সন্ধের ঠেকে চায়ের গেলাস হাতে দেখে রাতের ট্রাকগুলো শহর থেকে চলেছে আরও বড় শহরের দিকে। বাড়ি ফেরা অবধি ঠাণ্ডা রুটি তরকারি অবধি ঘুমের বড়ি অবধি মাথায় ঘুরে ঘুরে ওঠে শীতকাল...বইমেলা গনগনে পপি ফুলের খেত। শুধু ঘুমোনোর আগে বালিশের নিচে সে রেখে দেয় ফাঁকা বুক, ডটপেন, বাঁশি আর শীত লাগা কুকুরের কান্না।
      দূর থেকে ছুটে আসা ট্রেনের আওয়াজে ওভার ব্রিজ থেকে নামতে নামতে আমরা সবাই তো শুনে ফেলি ঘোড়ার ক্ষুরে লোহার ঝমঝম নালের শব্দ। পিঠে শঙ্কর মাছের চাবুকের দাগ নিয়ে মাথায় পোঁটলা-পুঁটলি সমেত, দল বেঁধে সময়ের কত কাঁটাতার পেরিয়ে সাবেকি তোরঙ্গ কাঁধে আমরা তো কেবল চলেছি! 
     আজ ঘুম ভাঙতেই বন্দরে ভেসে এল চতুর্দশ শতকের ধাতব পেটিকা।ভেতরে টাটকা মড়া উঠে বসেছে ততক্ষণে। ওষধি ও গোলমরিচের গন্ধে ভরপুর। হাতে বোতলবন্দি চিঠি।দেখি শবদেহটি জ্যান্ত তবে বোবা। দুই নিঃশ্বাসের মাঝখানে কাঠের ফলক বরাবর সে পারপার করে। হাতের নোনা জলে ধোওয়া চিঠি পড়া মুশকিল।
মৃত্যুর ওধারে কী আছে তাই জানা আর হয়ে ওঠেনি আমাদের। মমির খোলস আর কুষ্ঠ রোগীর ব্যান্ডেজ হাতে এ-ভাবেই ঘুরপাক খাচ্ছে ঘড়ি। আমরাও সবাই বটে খাচ্ছি-দাচ্ছি ঘুরে বেড়াচ্ছি দিব্যি তবে ঘুমের ভেতর কাত হওয়া মদের আ্যমফোরা ঘিরে বাদামি ঘোড়ার হ্রেষা ও চাবুকের হিসহিস কেউ কেউ আজও শুনতে পায়।
         দুপুরে সন্দেশ রসগোল্লা,চমচম নাম দিয়ে ঝোলভাত মেখে বড় বড় গোল্লা করে দেয় রুবি দিদি। তার আসল নাম রূপমালা। ডাকনাম রুপি থেকে মা দিয়েছে রুবি নাম, আর তাকে রুবি দিদি ডাকতে বলেছে। প্রত্যেক মাসে শুটিয়া থেকে রুবিদির মা এসে মার কাছ থেকে রুবিদিদির  মাইনে নিয়ে যায়।মাইনে মানে টাকা। তার মাকে দেখলেই রুবিদিদি ফুঁসে ওঠে।ওই যে আতিছে!
জনমভরি কিছু তো কততি আরলো না।আ্যহোন আমার মাইনে কডা খাতি আতিছে। মাইনে কিন্তু রুবিদির মা মোটেও খায় না। রুবিদির কথায় খালি খালি পান খাওয়া কালো দাঁত বার করে হাসে ।
       কী কতিছে দ্যাহো মাইয়ে আমাগের। মেলা টালি ভাইঙে গেইছে তো  ঘরডার। চালডা ছাতি হবে নানে?ট্যাহা না ওলি কোয়ানের থে কী অরবো ?পান খায় খুব মাসি তবে মাসির মনে হয়  খুব খিদেও পায়। তোমগের গুষ্টির ফিরিস্তি আর কতি অবে নানে আ্যহোন খাতি আসো।বকতে বকতে দিদি বড় কাঁসার থালায় অনেকটা ভাত বেড়ে দেয় তার মাকে। মাসি তাড়াতাড়ি ভাতের চুড়োয় গর্ত করে নেয় আর দিদি গরম ডাল তরকারি ঢেলে দেয় সেখানে। ভাত খেয়ে মাসি থলি থেকে পান দোক্তা বার করে খিলি বানায় । গালে পান ঠুসে জুৎ করে বসে মন দিয়ে টাকা গুনে ময়লা একটা রুমালে কষে গিঁট দিয়ে ব্লাউজের মধ্যে ভরে। তারপর দিদির সঙ্গে কথা বলে বাড়ির সামনে পাকা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়।বাসে উঠে মা চলে গেলে লম্বা শ্বাস ফেলে তার হাত ধরে বাড়ি ফেরে রুবিদি। 
      তাড়াতাড়ি খাইয়ে-নে বুনডি। থাল মাজতি হবে-নে। তাড়া দিলো রুবিদি। এত বড় বড় সন্দেশ মেখেছিস কেন? খেতে মোটে পারছি-নে। আদ্দেক করি খাইয়ে-নে। রুবিদি অন্যদিক তাকিয়ে হাসে। খাইয়ে উঠিই শুবি।কল্লামি অরবি নে। নইলে  ঝোল্লাবুড়ো আসপেনে।খালি রাত্তিরি আলো ফাজালিই না দিনিও কলাম আসে তারা।
        ওর'ম ভয় দেখাচ্ছিস কেন-রে? ঝোল্লা বুড়ো নেই বাপি বলেছে। না নেই! বেবাকের তা উনি  জানে আইছেন!মা ত্যাহোন কলো শুনতি পাওনি আমাগে ওদিক চল্লিশডে বাচ্চা তলাশ করিও পাতিছে না?আ্যন্নে সগগোলরি ওই বুড়ো ঝোলায় করি ক্যাম্বায় নে গেছে মানষি কচ্ছে, কোয়ানে বিরিজ হচ্ছে, সেহানে দেড়শো বাচ্চার বলি লাগবে নে।
     বলি কী রে দিদি, বিরিজ কী? গাঙের উপোর পাকা রাস্তা হলি তারে কয় বিরিজ।আর বলি জানিস নে? ছোট ছ্যামড়া ছেমড়িগে ধরি নিয়ে যাইয়ে পেথ্যমে ছ্যান করায়, তারপর কপালে সিন্দুরের ফোঁটা দিয়ি মা কালীর সামনে খ্যাচাং করে ছলডার মণ্ডু নামায় দেয়, তারে কয় গে বলি দেয়া! শুনশান দুপুরে বড় বড় চোখ কোঁকড়া চুলের ঝামর ঘেরা রুবিদিদির মুখ দেখে তার ভয় ভয় করতে থাকে!
    তারপর কতবার চাঁদ উঠল।নদীর বুকের ওপর পাকা সড়ক ধরে কত ব্রিজ তৈরি হলো, ব্রিজের রেলিং ধরে ঝুঁকে পড়ল মাঝরাতের একলা চাঁদের ধারালো আলোর ফালি।তবু মানুষের মনে জন্ম নেওয়া কাঁচা খেকো দেবতার রোষ কমলো না। যে লোভ কেবলই অরণ্যের দিকে টানে আমাদের।চিদাকাশ জুড়ে জেগে ওঠা সুন্দরকে এঁটো বাসনের মতো ছুঁড়ে দিই আমরা, কাঁটাঝোঁপে ছুঁড়ে দিই তিন বছরের ধর্ষিতা শিশু কন্যাকে, মা মা বলে হামাগুড়ি দিয়ে সে, চেপে ধরে অচেনা আঁচল আমাদের চোখের কুয়ো ফাঁকাই থাকে।অথচ মানত করে ঢিল বাঁধি কত পাথরের থানে! লোভের ভারি পা টানতে টানতে শিকারি জীবনের অন্ধকার গুহায় ঢুকে পড়ে পশুমানুষের দেবতা। নানা হাতে আয়ূধসজ্জা তার, হাড়ের  পাথরের, বারুদের,  পরমাণু বা জীবাণুর অস্ত্র! 
        জলের শেকড় কতদূর যায় গো? নিহিত পাতাল ছায়ার কতদূর গেলে সে নিবিয়ে দিতে পারে লোভ, হিংসা অনর্থক অবদমনের প্রবণতা?
             পোকামাকড় , গাছপালা,পাখপাখালি জীবজন্তুর মতো না-মানুষরা জেনে গেছে সকলেই  চরাচর উপচে পড়া করুণায় আমরা কেঁপে উঠিনি কোনোদিন। শুধু ভয় পেয়েছি! মৃত্যু এসে ফিরে যাবে এমন অপার ভালবাসতেও পাইনি কাউকে। ধুনোর করুণ গন্ধে শিউরে উঠে কাঁটা দেয়নি গায়ে। ঈর্ষায় কেবল পুড়ে গেছে তেলভর্তি দু'চোখের কালো প্রদীপ‌।দখলদারির লোভে অন্ধের মতো আমরা পাক খাই এই গ্ৰহের জল মাটি আকাশে যেভাবে মন্ত্রহীন দেবীর থানে জন্মান্ধ এক কালো গোক্ষুরা ঘুরে বেড়ায় মড়ার খুলি পেঁচিয়ে, ইদানিং হ্যাঁ !তাকেই আমরা ধর্ম বলে জানি!

🍂

Post a Comment

0 Comments