জ্বলদর্চি

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে /তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব /দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী /৩২তম পর্ব

বাঁশী ছেড়ে দণ্ড হাতে              
তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব               
 দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী      
৩২তম পর্ব

সত্রাজিত নামে এক যাদব দ্বারকায় বাস করতেন। তিনি স্যামন্তক নামে একটি অত্যন্ত উজ্জ্বল মূল্যবান মণি পেয়েছিলেন। সেই মণি দেখে শ্রীকৃষ্ণ বিবেচনা করলেন এই মণি উগ্রসেনকে মানায়। শ্রীকৃষ্ণের মনের কথা কিছুটা আন্দাজ করে সত্রাজিত ভয় পেয়ে সেই মণিটি তার ভাই প্রসেনকে গচ্ছিত রাখতে দিয়েছিলেন। একদিন প্রসেন মণিটি নিয়ে জঙ্গলে মৃগয়াতে যাওয়ার পরে এক সিংহের হাতে তার মৃত্যু হয়। স্যামন্তক মণি হারিয়ে যাওয়ায় এবং প্রসেনের মৃত্যুতে দ্বারকাবাসী যাদবগন শ্রীকৃষ্ণকে সন্দেহ করলেন। তারা ভাবলেন তিনি প্রসেনকে মেরে স্যামন্তক মণি নিজের কাছে রেখেছেন। এই অপবাদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য শ্রীকৃষ্ণ সেই মনির সন্ধানে কয়েকজন যাদবকে সঙ্গে নিয়ে মণির সন্ধানে বেরোলেন। জঙ্গলে যেখানে প্রসেনের মৃতদেহ পড়েছিল সেখানে শ্রীকৃষ্ণ দেখলেন সিংহের পায়ের ছাপ এবং সেই সিংহের পায়ের ছাপ অনুসরণ করে দেখলেন ভল্লুকের পায়ের ছাপ। তার দ্বারা তারা নিঃসন্দেহে হলেন মণিটি কোন ভল্লুকের হস্তগত হয়েছে। পরে অনুসন্ধানে দেখা গেল ভল্লুক জাম্বুবানের পুত্রের এক ধাত্রীর হাতে সেই স্যামন্তক মণি। শ্রীকৃষ্ণ জাম্বুবানকে পরাজিত করে মণি উদ্ধার করলেন। জাম্বুবান নিজের ভুল বুঝতে পেরে শ্রীকৃষ্ণের কাছে এসে ক্ষমা চেয়ে তার কন্যা জাম্ববতীকে বিবাহ করার অনুরোধ করলেন। এই জাম্বুবান ত্রেতা যুগের শ্রীরামচন্দ্রের সুহৃদ সুগ্রিবের দোসর ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ জাম্বুবানের কন্যা জাম্ববতীকে বিবাহ করে অনার্যদের সাথে মিত্রতার বন্ধন দৃঢ় করলেন। শ্রীকৃষ্ণ স্যামন্তক মণি নিয়ে দ্বারকায় ফিরে এসে সত্রাজিতকে সেটি প্রত্যর্পন করলেন। সত্রাজিৎ ভয় পেয়ে ভেবেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ তাকে এসে ভৎর্সনা করবেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের চরিত্র অন্যরকম। ক্ষমার মাধ্যমে তিনি সকলকে আপন করে নিতে চেয়েছিলেন। সত্রাজিত নিজের ভুল বুঝে নিজের অপরূপা সুন্দরী কন্যা সত্যভামাকে কৃষ্ণের হাতে অর্পণ করে ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটালেন। শ্রীকৃষ্ণ খুশি মনে সত্যভামাকে গ্রহণ করলেন। সত্যভামা অত্যন্ত রূপবতী ছিলেন যার জন্য তিন যাদব তাকে বিবাহ করতে আগ্রহী ছিল। এরা হলেন শতধন্বা, কৃতবর্মা এবং কৃষ্ণের পরম ভক্ত ও সুহৃদ অক্রুর। সত্রাজিত যখন শ্রীকৃষ্ণের হাতে সত্যভামাকে তুলে দিলেন এরা তখন চক্রান্ত করে কৃতবর্মা এবং অক্রুরের পরিকল্পনা মত শতধন্বা সত্রাজিতকে নিদ্রিত অবস্থায় হত্যা করে স্যামন্তক মণি চুরি করলেন। এই সময় শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় ছিলেন না। তিনি তখন বারনাবতে গিয়েছিলেন পান্ডবদের খবর নিতে। দ্বারকায় ফিরে আসার পরে কৃষ্ণ সত্যভামার নিকটে তার পিতৃবধের ঘটনা শুনে অগ্রজ বলরামকে সঙ্গে নিয়ে শতধন্বার খোঁজ করলেন। শতধন্বা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণ তার পশ্চাদ্ধাবন করে তাকে পরাজিত করে 'দুষ্ট গরুর থেকে শূন্য গোয়াল ভাল' এই প্রবচনে বিশ্বাস করে তাকে হত্যা করলেন। হরিবংশপুরানে উল্লেখ আছে সত্রাজিতের আরো যে দুটি কন্যা ছিল - প্রস্বাপিনী এবং ব্রতিনী তাদেরকেও সত্রাজিত কৃষ্ণের হাতে অর্পণ করেছিলেন। সংক্ষেপে এই হল স্যামন্তক মণি চুরির ঘটনা, শ্রীকৃষ্ণের প্রতি যাদবগনের অবিশ্বাস এবং তার মুলোচ্ছেদ করা।
শ্রীকৃষ্ণের প্রথম ভার্যা ছিলেন বিদর্ভরাজ ভীষ্মকের কন্যা রুক্মিনী। রুক্মিনী অসামান্যা রূপবতী ও গুণবতী ছিলেন। বিদর্ভরাজ ভীষ্মক পুত্র রুক্মির ইচ্ছায় শ্রীকৃষ্ণের প্রবল শত্রু জরাসন্ধের প্ররোচনায় চেদিরাজ শিশুপালের সাথে রুক্মিনীর বিবাহের জন্য স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেছিলেন। এই স্বয়ম্বর সভায় দ্বারকাধিপতি শ্রীকৃষ্ণকে কোন আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। যদিও সমকালীন ভারতবর্ষে শ্রীকৃষ্ণের সমকক্ষ একক রণকুশলী, রাজনীতিবিদ আর কেউ ছিলেন না। ইতিমধ্যে গুপ্তচর মারফত একটি মারাত্মক খবর শ্রীকৃষ্ণের কানে এসে পৌঁছেছিল। বিদর্ভ থেকে রাজপুরোহিত শতানন্দ এসেছিলেন শ্রী কৃষ্ণের দর্শন প্রার্থী হয়ে। সেই পুরোহিতের কাছ থেকে শ্রীকৃষ্ণ জানতে পারলেন যে বিদর্ভ রাজকন্যা রুক্মিণী এই বিপদের মুখে তাকে পাঠিয়েছেন। তাঁর হাতে রুক্মিণী একটি গোপন চিঠি পাঠিয়ে লিখেছেন "হে আর্য, আমি দীর্ঘকাল স্বামী হিসেবে মনে মনে আপনাকে নির্বাচন করে এসেছি।

🍂

 আজ আমাকে দ্বিচারিণী হতে বাধ্য করা হচ্ছে। আপনি জানেন একজন নারী হিসেবে আমি এই অপমান কিছুতেই সহ্য করতে পারবো না। আমার ভ্রাতা রুক্মি তার স্বীয়বুদ্ধি বলে চেদিরাজ শিশুপালকে আমার পতি হিসেবে নির্বাচন করেছে। কিন্তু আমি এই নির্বাচন মেনে নিতে পারছি না। আমি প্রার্থনা করছি আপনি এসে আমার ধর্মরক্ষার ব্যবস্থা করুন। আর যদি আপনি তা করতে রাজি না হন তাহলে সর্বজন সমুখে আমি আত্মঘাতী হব এবং আমার এই কাজের জন্য আপনাকে সারা জীবন অনুশোচনা করতে হবে।" এইরকম একটি অপ্রত্যাশিত চিঠি পড়ে একদিকে যেমন যুবক কৃষ্ণ রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলেন কিভাবে তিনি এক অসহায় মহিলার ধর্মকে রক্ষা করবেন। রুক্মিণী যে মনে মনে তাঁকেই পতি হিসেবে বরণ করেছেন। এই সংবাদ শুনে তার সমস্ত শরীরে যেমন আনন্দের শিহরণ জেগে উঠেছিল কিন্তু পরক্ষনেই চিন্তা করলেন তারা তো ওই স্বয়ংবর সভায় নিমন্ত্রিত নন। তাই শ্রীকৃষ্ণ চিন্তা করলেন এই পত্র রাজসভার প্রবীণদের সামনে প্রকাশ করা জরুরী কারণ তিনি নিজে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পারবেন না। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যাদব বংশের মর্যাদা নির্ভর করছে। পত্র হাতে রাজসভার দিকে তিনি এগিয়ে গেলেন। শ্রীকৃষ্ণকে এইভাবে রাজসভায় প্রবেশ করতে দেখে মহারাজ উগ্রসেন থেকে সকলেই অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। কৃষ্ণ তো সচরাচর এমন আচরণ করেন না। তিনি আবেগকে কখনো প্রশ্রয় দেন না, তিনি চরম বাস্তববাদী। বলরাম তাঁকে প্রশ্ন করলেন 'কি সংবাদ কৃষ্ণ, তোমাকে এমন চিন্তাচ্ছন্ন দেখাচ্ছে কেন? তুমি কি গোপন সূত্রে কোন সংবাদ পেয়েছো?' শ্রীকৃষ্ণ নিঃশব্দে রুক্মিনীর লেখা পত্রখানি বলরামের হাতে সমর্পন করলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এখন এই গোপন পত্রটিকে সর্ব জনসমক্ষে প্রকাশ করতে না পারলে তার ভবিষ্যৎ কর্তব্য তিনি নির্ধারণ করতে পারবেন না। বলরাম পত্রপাঠ করে গর্জন করে উঠলেন। তিনি বরাবরই একরোখা স্বভাবের, তাঁর চরিত্রের মধ্যে সহনশীলতা বলতে কিছু নেই। তিনি সভাসদদের সামনে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন 'মহারাজ ভীষ্মক যাদবদের এই স্বয়ম্বর সভায় আমন্ত্রণ না জানিয়ে অপমান করেছেন। আমার মনে হয় এখন কৃষ্ণের উচিৎ সমস্ত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে রুক্মিণীকে হরণ করে নিয়ে আসা। শাস্ত্রে অসুর বিবাহ বলে এক ধরনের বিবাহকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। আমি চাই কৃষ্ণ রুক্মিণীকে হরণ করে এইভাবে বিয়ে করে যাদবদের মুখ উজ্জ্বল করুক। দ্বারকার অপমানের প্রতিশোধ নিক'। সমস্ত ঘটনা শ্রবণ করে মহারাজ উগ্রসেন এবং বসুদেব, অক্রুর প্রমুখ যাদব প্রধানগন বলরামের এই প্রস্তাবকে সমর্থন করলেন। রাজসভায় উপস্থিত সাত্যকি, কৃতবর্মা প্রভৃতি বীরেরাও বলরামকে সমর্থন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে গোপন পরিকল্পনা রচিত হল। আনন্দিত বিদর্ভ রাজপুরোহিত শতানন্দ গোপন সংবাদ বহন করে নিজের রাজ্যে ফিরে গেলেন।                     

শ্রীকৃষ্ণ চিন্তা করলেন বিদর্ভ থেকে রুক্মিনীকে নিয়ে আসা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। আবার তিনি এই ব্যাপারে কোন সংঘর্ষের মধ্যেও যেতে চাইছেন না। তিনি রাজ পুরোহিত শতানন্দর হাতে একখানা চিঠি দিলেন রুক্মিনীকে দেওয়ার জন্য যাতে কিভাবে রুক্মিনীকে তিনি নিয়ে আসবেন জানতে চাইলেন। তার উত্তরে রুক্মিণী গোপন দূত মারফত জানালেন স্বয়ংবর সভার দিন তিনি সর্বাগ্রে দেবী মন্দিরে পূজা দিতে যাবেন। পুজো দেওয়ার পরে তিনি যখন মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে রাজ অন্তঃপুরের দিকে অগ্রসর হবেন সেই সময়ে তাকে যেন শ্রীকৃষ্ণ হরণ করে নিয়ে যান। পরিকল্পনা প্রস্তুত হয়ে গেল এখন শুধু সেটি কার্যকর করার অপেক্ষায়। একদিকে রুক্মিনী অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ উভয়েই প্রহর গুনে চলেছেন।                         
                                            পরবর্তী অংশ ৩৩তম পর্বে...............

Post a Comment

0 Comments