উদয়ের পথে
পঞ্চদশ পর্ব
মলয় সরকার
ধীরে ধীরে একসময় তাই বেরোনোর দিকে এগোতেই হল। ফেরার রাস্তায় রাজবাড়ির মধেই দেখি জাপানী মেয়ে পুরুষ কিছু অস্থায়ী , গুটিয়ে নেওয়ার মত ,হাতে তৈরী জিনিস বা ছোট খাবারের দোকান করেছে, পর্যটকদের জন্য। আমরা এক জায়গায় মোমো ধরণের একটা খাবার খেলাম। মোটামুটি। খুব আহামরি কিছু লাগে নি। এখান থেকে এগিয়েই আমরা দেখলাম, সরকারী একটি মেমেন্টোর দোকান। চালাচ্ছেন কিছু মহিলা।
একটা জিনিস, জাপানে বেশীর ভাগ দোকান বা প্রতিষ্ঠান চালান মেয়েরা। আর একটি কথা জাপানী মেয়েদের ব্যাপারে ছেলেদের কোন তফাত বা উন্নাসিকতা কোথাও নেই কোন কাজেই।মেয়েরাও নিজেদের ছেলেদের থেকে কোন ব্যাপারেই আলাদা মনে করেন না।তাঁদের কোন ছুৎমার্গও নেই। বেশবাসেও নেই কোন মোহময়ী করে তোলার বা পুরুষের কাছে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার প্রচেষ্টা।এটাই , আমার মনে হয় ওদের দেশের ,এগিয়ে যাওয়ার আর একটি কারণ।
দোকানে নানা ধরণের জিনিসে ভর্তি । মন টেনে নেয়। তবে খুঁটিয়ে দেখলাম, এখানেও চীনের আধিপত্য কম নয়। অনেক মেমেন্টোই চীনে তৈরী, কিন্তু জাপানী রীতিতে। ফলে এখানে জাপান হেরেছে চীনের কাছে। এই মেমেন্টোর বাজারটা সারা পৃথিবীতেই বোধ হয় চীনের দখলে। আমরা রোমেও দেখেছি, মেক্সিকোতেও দেখেছি, প্যারিসেও দেখেছি, যা কিনেছি সব চীনের তৈরী মেমেন্টো।
সে যাক, আমরা বেশ কিছু স্মারক নিলাম, নিজেদের আর পরিচিজনদের জন্যেও, যাদের জন্য, মনে আলোর বাল্ব জ্বলে ওঠে কোথাও কিছু কিনলে বা ভাল জিনিস পেলেই।দাম বেশি লাগছিল যদিও , তবুও নিলাম, কি জানি আর কোথাও এরকম জিনিস যদি না কিনতে পারি।
এখানে দেখা হল দুই ইস্রায়েলী পর্যটক ভদ্রমহিলার সঙ্গে। তাঁরা তো আমাদের দেখে আদর করে ডেকে বসালেন পাশেই। বুঝলাম,ওনাদেরও পা ধরে গেছে আমাদের মতই। আর বিদেশে এসে গল্প না করতে পেরে পেট ফুলছে, তাই যাকে পাওয়া যায়, তাকেই টানছেন। আমরাও স্বচ্ছন্দে বসে গল্প জুড়লাম। দুজনেই মধ্যবয়সী বন্ধু। স্কুলের শিক্ষিকা, স্কুলের ছুটিতে বেরিয়েছেন। আমরা ভারতীয় ,শুনে গল্প আরো জমে উঠল। কিন্তু গল্প হল ওই এক ব্যাপারেই, ওনারাও আশ্চর্য হয়ে গেছেন, জাপানীদের আশ্চর্য রকম পরিচ্ছন্নতা দেখে। এটা সত্যিই বোধ হয় সারা পৃথিবীর পরিচ্ছন্নতার পাঠশালা।যারাই আসে এখানে তাদের মধ্যে এই ধাক্কা লাগবেই ,এটা গ্যারান্টি দেওয়া যায়। ওনারা ভারতেও এসেছেন।দেখেছেন দিল্লী মুম্বাই ইত্যাদি। বলছিলেন, আপনাদের দেশ বেশ নোংরা, আমাদের দেশও যে খুব পরিষ্কার তা নয়।তবে এরা যত সুন্দর, আমরা বুঝতে পারছি না, সেটা এরা সারা দেশে ‘মেন্টেন’ করে কি ভাবে।সত্যিই এদের কাছে সারা পৃথিবীর শিক্ষা নেওয়ার আছে। (মনে মনে ভাবলাম, তাও তো ওনারা ভাগ্যিস ‘ভারতের লণ্ডন’ কোলকাতায় আসেন নি)
এখান থেকে আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য এখানকার আর একটি বাজার। বাজার দেখলে একটা দেশের সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়, এটা আমার বিশ্বাস। আর জাপান যেহেতু সারা পৃথিবীর কাছে মাছের বাজারের জন্য বিখ্যাত, তাই তাদের একটা বাজারে (টোকিওতে) ঢুকতে না পারলেও আরেকটা বাজারে অবশ্যই যাব, এই ইচ্ছাতেই যাওয়া। তবে সেটা ছিল শুকিজির কাঁচা মাছের বাজার, আর এটা রান্না মাছের বাজার। তবে এটা শুধু মাছের বাজার নয়, আরও অনেক কিছুই পাওয়া যায়। উবেরেই গেলাম এখানে। আবার বলতে হয়, এই ট্যাক্সি ড্রাইভারদের কথা। খুব ভদ্র ও পরিচ্ছন্ন ‘স্যুটেড বুটেড’। সারা দেশে আসলে এত ভদ্রতা আর পরিচ্ছন্নতার ছাপ, যে দৈন্য থাকলেও তা কখনওই প্রকটিত হবে না। আমাদের দেশের ড্রাইভাররাও এটা করতেই পারে। প্রত্যেকটা গাড়ির যত্ন এমনই যে, মনে হয় অল্প দিনের কেনা। বেশ সুন্দর ‘মেন্টেনেন্স’। গাড়িতে সমস্ত ব্যবস্থাই সুন্দর, মন কেড়ে নেবেই। সবাই নিয়ম মানে, যাত্রীকে সম্মান করে , নিজে গেট খুলে দেয়, আর একটি পয়সা টিপ্স বা বাড়তি নেবে না।
মার্কেটে সাজানো মাছের পদ
আর একটা নিয়ম বলে রাখি । ভুলে যাব। জাপানে হাঁটতে হাঁটতে খাওয়া নিষিদ্ধ। যার জন্য চীনে প্রচলন থাকলেও ‘স্ট্রীট ফুড’ বা ওই ধরণের ‘ফুড কার্টে’র চল জাপানে নেই। তাই আমাদের প্রথম দেখা
আসাকুশা শ্রাইনে আমরা দেখেছিলাম, অনেক খাওয়ার দোকান, কিন্তু সব দোকানেই লেখা আছে ,খাওয়া নিষেধ। যদিও অনেকেই খাচ্ছিল , তবে আইনতঃ নিষেধ।
নিশিকি মার্কেটে লোভ না সামলাতে পেরে মেয়ে---
যাক, আসা গেল নিশিকি বাজরে। বাজারে যদিও অনেক গেট আছে, আমরা প্রধান গেট দিয়েই ঢুকলাম। উপরে বড় বড় করে লেখা আছে নিশিকি মারকেট। এটি কিন্তু অন্যান্য বাজারে যেমন বেশ বড় চত্বরের উপর বাজার হয়, তা নয় । বেশ সরু এই বাজারে ঢোকার মুখ। শুধু তাই নয়, এই বাজারটি বেশ কয়েকটি সরু লেনের উপর অনেক উঁচুতে ঢাকা বাজার। লেনের দুপাশে দোকান আছে একেবারে গায়ে গায়ে সব ছোট দোকান রয়েছে অবশ্য কিছু দ্বিতল দোকানও আছে।মাঝে রাস্তার ক্রসিং রয়েছে, তারও দুদিকে দোকান রয়েছে। এখানে মোটামুটি নানা ধরণের রান্না করা মাছ, নানা ধরণের সীফুড,আচার, শুকনো মাছ, ফল সব্জী বিক্রী হয়। এ ছাড়াও নানা রান্না করার সরঞ্জাম, কাটলারি , জাপানী মিষ্টি, কিছু গিফট শপ। এত বেশি খাবার পাওয়া যায়, একে লোকে ‘ কিয়োটোর রান্না ঘর’ বলে।এখানে দেশী বিদেশী পর্যটক মিলিয়ে প্রচুর ভিড় হয়।খাদ্যরসিক কেউ জাপান গেছে আর এই বাজারে ঢোকেনি এটা হওয়া অসম্ভব।
এখানে এলে আসল জাপানী খাবারের সাথে পরিচয় হবেই।
🍂
বাজারে প্রায় ১৩০ টির মত দোকান আছে।সবাই উচ্চস্বরে ডাকাডাকি করছে। উপরে ছাদটা লাল, নীল হলুদ ইত্যাদি রঙীন কাঁচে ঢেউ খেলানো ধরণের ঢাকা।বাজারে বেশ ভিড়। তবে এত খাবার দোকান থাকলেও কিনে ,খেতে খেতে যাওয়াটা অভদ্রতা। খেতে হলে দোকানে দাঁড়িয়ে খেতে হবে। কারোর ফুড স্ট্যাণ্ড আছে, কারোর বা বসার চেয়ার আছে।তবে সবাই যে সবসময় এই নিয়ম মানে তা নয়, অন্ততঃ এখানে।
এই বাজার প্রথম শুরু হয় ১৩১০ সালে। লোকে বংশানুক্রমে এখানে ব্যবসা করছে।আগে থেকে মাছ বিক্রী এখানে চালু হলেও ১৬১৫ সালেই প্রথম এখানে সরকারী ভাবে মাছ বিক্রীর অনুমোদন পায়।অনেক চড়াই উৎরাইয়ের পর শেষে ১৯৮৪ তে বাজারকে সুন্দর করে সাজানো হয়। তারপর ২০০৫ এ জাপানের একটা প্রধান দ্রষ্টব্য হিসাবে এটি চিহ্নিত হয়।
এখানে কিন্তু আবার ঐ একই কথা বলতে হয়। এত বড় বাজার ,এত লোক, এত খাওয়াদাওয়া, তা সত্বেও নোংরা কিন্তু কোথাও নেই। চারিদিক আলোয় ঝলমল করছে। বেশি লাল রঙের ঔজ্বল্য।এখানে সব কিছুই যে সকলের খাওয়া উচিত, তা হয়ত’ নয়, তবে দেখতে বড় সুন্দর লাগে। বিশেষ করে কিছু কিছু জিনিস এত সুন্দর দক্ষতায় ওরা তৈরী করে , তা নজর টানবেই। আমরাই বা পিছিয়ে থাকি কেন, লোকে অভদ্র ভাববে। তাই আমরাও খেলাম এখানে স্কুইড, শ্রিম্প, ট্যাকো ইয়াকি। ভালই লাগল বেশ। বিক্রি হচ্ছে বড় বড় ক্র্যাব, বড় স্কুইড, অক্টোপাস।এছাড়াও খেলাম দাইফুকু (daifuku)। নতুন জিনিস। ভালই লাগল। এটি আসলে, এক ধরণের মোচি আইসক্রীম, যার ভিতরে রয়েছে কাঁচা স্ট্র বেরী। কোথাও রেড বিন পেস্টও থাকতে পারে।অর্থাৎ এটি এক ধরণের আইসক্রিম।
জাপানী আইসক্রীম দাইফুকু
আর একটা জিনিস এখানে লক্ষ্য করলাম। কোথাও এখানে কার্ড নেয় না , সবই ক্যাশ দিয়ে কিনতে হবে।
তবু বেশি কিছু কিনি আর নাই কিনি এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা কোথা দিয়ে যে কেটে যায় বোঝাই যায় না। নানা উইণ্ডো শপিং করেই বেলা যায়। তবে এখানে অনেকেই ফ্রী স্যামপ্ল দিচ্ছেন খেয়ে দেখার জন্য। সেগুলো খেয়েও মোটামুটি জাপানী খাবার সম্বন্ধে ধারণা করা যায়।
কেমন লাগছে বন্ধুরা? ভাল মন্দ যা লাগে একটু জানান প্লিজ। ঘুরতে থাকি জাপানের আনাচে কানাচে। তবেই তো একটা দেশকে সত্যিকারের চেনা যায়। তাই নিয়ে চলেছি আপনাদের ঘুরে ঘুরে জাপান দেখাতে–
ক্রমশঃ–
1 Comments
খুব ভালো লাগছে প্রতি পর্ব। মতামত তো সবসময়ে জানাই কারণ ভালো লেখায় মন্তব্য করতে ভালো লাগে।
ReplyDelete