জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ১৪ /স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ১৪


স্বপন কুমার দে

অমরেশবাবু আর মণিদীপা সোফায় বসে কথা বলছিলেন, বড় বৌমা দু'কাপ চা নিয়ে এল।বৌমার হাত থেকে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অমরেশ বললেন," বুঝলে বৌমা,মনে হচ্ছে, নতুন দিদিমণি  আমার মন্টি দিদিভাইকে ঠিক লাইনে নিয়ে আসতে পারবে। কয়েকদিন ধরেই আমি ওর পড়ানোর টেকনিক ফলো করছি, দেখছি একটু অন্যরকম। প্রথমে থিওরিটা খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়। কোন্ প্রবলেমের ক্ষেত্রে সেটাকে অ্যাপ্লাই করতে হবে, সেটা ধরিয়ে দিতে সাহায্য করে, কিন্তু কোনো অংকই নিজে করে দেয় না। এই পদ্ধতিটা আমার খুব ভালো লেগেছে। এতে করে আত্মনির্ভরতা বেড়ে যায়। আরে, অংক নিজে কষতে হয়, প্রবলেম ফেস করতে হয়, তবে না সে অংকের ভেতরে ঢুকতে পারবে। হ্যাঁ, প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে। মনে হবে এতক্ষণ ধরে এই কয়েকটা অংক মাত্র হয়েছে। সিলেবাস কবে শেষ হবে? কিন্তু একবার যখন লাইনটা ধরতে পারবে তখন তাকে আর আটকায় কে? আমি তোমাকে বলছি বৌমা, তোমার মেয়ে এবার অংকে স্ট্রং হবে।"
" তাই যেন হয় বাবা। আপনার ছেলে তো তার মেয়ের দিকে চাইবার সময় পর্যন্ত পায় না।"
এইসব কথা বলতে বলতেই কলিংবেল বেজে উঠল, মন্টির ম্যাডাম ঢুকলেন। মেয়েকে পড়ার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে তার মা রান্নাঘরে ঢুকে টিফিন করতে গেল। ঠিক তখনই মন্টি এসে হাজির। বলল," মা, ম্যাডাম বললেন, আজ টিফিন খাবেন না, খেয়ে এসেছেন।

মা এল মেয়ের সঙ্গে। " এটা কিন্তু আপনি ঠিক করেননি ম্যাডাম। আপনি এখন খাবেন না, ঠিক আছে কিন্তু ঘন্টাখানেক পরে খেতেই হবে। না, বলা যাবে না।"
" না না বৌদি ব্যস্ত হবেন না। আজ আমার খিদে নেই। এক বন্ধুর পীড়াপীড়িতে কিছু খাওয়া হয়ে গেল। আপনি নাহয়, পরে একটা বাটিতে করে সামান্য মুড়ি আনবেন, তাতেই হয়ে যাবে।"
" আচ্ছা ঠিক আছে। বলছি, ছাত্রীকে কেমন দেখছেন? এখন সব পারছে টারছে তো ?"
হ্যাঁ, আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। অংকে ভয় বা জড়তা কেটে গেছে। তবে, এখনও অনেক খাটতে হবে। মেয়ে আপনার খুব লক্ষ্মী। যা বলি তাই করে। আশা করছি, পরে পরে আরও ভালো হবে।"
" ঠিক আছে, আপনি পড়ান, আমি আসছি," বলে সুদেষ্ণা তখনকার মত বিদায় হল।

একটু পরেই উদ্দালক ঘরে ঢুকল। তার সাথে সাথেই ছোটছেলে সম্পূরক। এরপর বেশ কিছুক্ষণ বাবা আর দুই ছেলের মধ্যে রাজনীতি,অর্থনীতি,ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা চলবে। এসবের মধ্যে মণিদীপা আর থাকতে পারেন না। তিনি উঠে গিয়ে বড়বৌমার কাজে সাহায্য করেন।
🍂

দেশ, সমাজ নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ঢুকে পড়ে মন্টির পড়াশোনা। এ বিষয়ে উদ্দালক যে বিন্দুমাত্র বাবার দায়িত্ব পালন করছে না, এই অভিযোগ মন্টির দাদু এবং কাকুর মুখ থেকে শোনা যায়। উদ্দালকের কথায় মনস্তাপ ফুটে ওঠে," কী করি বলো দেখি বাবা,  সময় কোথা? কী কুক্ষণেই যে ব্যাঙ্কের চাকরিতে ঢুকেছিলাম? ভোর না হতেই ছোটা,আবার রাতের অন্ধকারে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরা।মেয়েটাকে যে দেখতে পারি না, এজন্য আমার কষ্ট হয় না?"
" আরে দাদাভাই, তুই কথাটাকে অতো সিরিয়াসলি নিচ্ছিস কেন? আমরা জাস্ট মজা করছিলাম। তুই সময় পাস না, তাই পারিস না। আমরা তো আছি। তাছাড়া শুনছি, ম্যাথের নতুন টিচার খুব এফিসিয়েন্ট। অংকেই ওর ঘাটতি ছিল। এখন সেটা অনেকটাই মিটে গেছে বলে বৌদি বলছিল। চল্ দেখি ক্যারাম খেলি। আজ তুই আর আমি পার্টনার, বাবা ডবল হ্যান্ড। বাবাকে হারাতেই হবে।"

এরপর খেলা চলবে কতক্ষণ। ওদিকে টিউশন শেষ মন্টির। ম্যাডামের চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাওয়া গেল। মন্টি এবার যোগ দিল ক্যারাম খেলায়।
" জানো বাবা, আজ ম্যাডামের সঙ্গে অনেক গল্প করেছি।"
" এই বুঝি তোমার ভালো পড়াশোনার লক্ষণ?" মন্টির বাবা বলল।
" বারে, আমার আজ সব টাস্ক আধঘন্টা আগেই হয়ে গেছল, তাই তো ম্যাডাম দেশ বিদেশের কত গল্প বলছিলেন। আফ্রিকার ভয়ংকর অরণ্য, ব্রাজিলের পিরানহা মাছ, অ্যানাকোন্ডা, বরফের দেশে এস্কিমোদের কথা আরও কত কী! ম্যাডাম বলছিলেন, এসব তিনি বইয়ে পড়েছেন। আমাকে বললেন, যত বেশি পড়বো তত বেশি জানবো।"
তিনজন বয়স্ক শ্রোতাই হাঁ করে মন্টির কথাগুলো শুনছিল। দাদু বললেন," একদম ঠিক কথাই বলেছেন ম্যাডাম। শেখার কোনও শেষ নেই। যত বেশি পড়বে তত বেশি শিখবে। নানান ধরনের বই পড়তে হবে। দাঁড়াও, কাল তোমাকে নিয়ে ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরিতে যাবো, তোমাকে মেম্বার করে দেবো। তাহলে যেটাই তোমার পড়তে ইচ্ছা করবে, সেটাই পড়তে পারবে।"
রাত দশটায় খেতে বসার ডাক পড়তেই সভা ভেঙে গেল।

                                 *****

ওদিকে বাড়ি পৌঁছেই মল্লিকা দেখল, বাবা বিছানায় শুয়ে রয়েছে। দরজাটা হালকা করে ভেজানো ছিল, তাই একটু ঠেলতেই খুলে গেল। জামাকাপড় না ছেড়েই মল্লিকা বাবার কাছে গেল। অন্যান্য দিন তার বাবা এইসময় মল্লিকার প্রাইজ পাওয়া পুরানো গল্পের বইগুলো পড়ত বা টুকটাক কাজ করত।আজ অন্যরকম দেখে মল্লিকার ভয় হল। ডাকল," বাবা! বাবা!" বাবা আধঘুমানো অবস্থায় ছিল। চোখলাগা ঘুমটা ভাঙতেই বাবা দেখল, মেয়ে কখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
" তুই চলে এসেছিস?"
" হ্যাঁ, তোমার কি শরীর খারাপ?"
" না,তেমন কিছু নয়। পেটটা একটু ব্যথা ব্যথা করছিল, তাই.."
" ওষুধগুলো ঠিক ঠাক মতো খাচ্ছো, না ভুলে যাচ্ছো?"
" না, আসলে তোকে বলা হয়নি, দু'দিন আগে ওষুধগুলো শেষ হয়ে গেছে। তোর কাছে কি এখন টাকা পয়সা আছে?"
মল্লিকা চুপ হয়ে যায়  বুঝতে পারে প্রকৃত অবস্থাটা। এই মাসের টাকা এখনও হাতে পায়নি। ভাবলো,কাল একটা বাড়িতে চাইবে। মাস শেষ হয়ে গেছে, তাই চাইতে আর লজ্জা নেই। সংসার চালানোর মতো সামান্য ক'টা টাকা হাতে আছে। এই দিয়ে ওষুধ কেনার যাবে না।তার চেয়ে বরং কোনো একটা স্টুডেন্টের বাড়িতে চাইবে। আজকের রাতটা যাই হোক করে বাবাকে ভালো থাকতে হবে।
" ঠিক আছে বাবা, কাল সকালে তোমার জন্য ওষুধ নিয়ে আসব।আজ বরং একটু বেশি নরম সেদ্ধ ভাত করছি,কম করে খেয়ে নাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।"
এতক্ষণ মল্লিকা বাবার পাশে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, এবার উঠতে হল। রান্না করতে হবে। বাবার স্নেহের ডাকে থামল।
" মা রে! তুই আমার এ জন্মের নয়, বহু জন্মের মা ছিলি। তোর হাতের ছোঁয়ায় আমার সব রোগ ভালো হয়ে যায়। একটা কথা বলি তোকে মা, তুই আমার জন্য ভাবিস না।এত রাত দিন খাটবি না। আর কত করবি বল্। মা মরা মেয়ে। কোথায় আমি তোকে আগলে রাখব, তা নয়, তুই আমাকে ভালো রাখবার জন্য নিজেকে নিংড়ে দিচ্ছিস্।" বাবার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। আর সযত্নে মেয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতে লাগল।
 

Post a Comment

0 Comments