জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় /উনবিংশ পরিচ্ছেদ/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী


প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
উনবিংশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী

এমনি করেই একটা একটা করে কেটে যায় দিন, ফাগুন পেরিয়ে আসে জৈষ্ঠ্য। বাড়ির নতুন বৌটির সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে, পিসিমাও সুস্থতার পথে বেশ কয়েক কদম হাঁটেন। কাজে কর্মে তো নয়ই,বিছানা থেকে ওঠাও নয়,তবে ভালো বলতে চেতনা ফিরে পান আরও খানিকটা। 
পাড়ার মানুষজন, বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন দেখতে আসেন,তাঁদের প্রায় সবাইকেই চিনতে পারেন বৃদ্ধা, যদিও কথায় জড়তা থাকে জিভের সমস্যায়। 
প্রতিদিন সকালে বড় বৌমা সদর দাওয়ায় মাদুর বিছিয়ে তাঁকে বসিয়ে সংসারের কাজে নামে। কখনও মেজবৌদিদি,কখনও ছোটোবৌ,কখনও বা নতুন বৌমা পাশে এসে বসে,সঙ্গ দেয়,দেশকালের খবরাখবর শোনায়। 
সেবছর গাছে প্রচুর আম হয়েছিল,প্রতি বছরই যেমন হয়।ছেলে-ছোকরাদের দৌরাত্ম্যও ছিল ঢের।ঢিল ছোঁড়া আর কলকলানির চোটে জ্বালতনের একশেষ হতে হয় গ্রীষ্মকালীন দুপুরগুলোয়।
এসময় সকালে ইস্কুল বসে।তাঁদের বাখুল পেরিয়ে যে ধানজমি,তার আলপথ পেরোলেই ইস্কুল,প্রাইমারি,পাশে মাধ্যমিক।এলাকার ছেলেমেয়েরা ওখানেই পড়াশোনা করে,ইস্কুল-ফেরৎ ছেলে-ছোকরাদের দৌরাত্ম্যে গাছে একটিও আম থাকার জো নেই;সুস্থ থাকা অবস্থায় লাঠি হাতে তাড়াতেন তাদের,এখন তো সে উপায় নেই,তাই ঘোলা চোখে দেখেন,আনমনে হাসেন,হয়তো অতীত স্মৃতি ভেসে ওঠে মনের পর্দায়…

এমনিতেই গ্রামগঞ্জের দিনযাপন যেমন থাকে বড়ো নিস্তরঙ্গ,সেদিনও সকালবেলাটি ছিল তেমনই স্বাভাবিক। বেলার দিকে,বড় নাতিটি ইস্কুল থেকে ফেরৎ এসে বললে তার কাকীমাকে,
-'জানো কাকীমা,কে নাকি বিরাট বড়ো নেতা মারা গেছে কাল রাতে। বাস-গাড়ি সব বন্ধ'
পোয়াতি বৌটি তখন স্নান সেরে তাঁর পাশে বসে বসে মৌজ করে নুন-লঙ্কা মেখে কাঁচা আম খাচ্ছিল।
মেজবৌদিদির মুখে শুনেছেন বিরজা,কয়েকদিন পরেই তার সাধ,তারপরেই তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বাবার বাড়ি,সেখানেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে, কারণ হাসপাতাল সামনে,এখানকার মতো নদী পেরোনোর সমস্যা নেই।

🍂

মেয়েটি ছেলেমানুষ, তাঁকে ভালোও বাসে ঢের। 
তাই হয়তো মাঝেমধ্যেই তাঁর কাছে এসে বসে, এখনও তেমনই, বসে বসে আম খাচ্ছিল।
তো নাতির কথায় প্রথমে তেমন গুরুত্ব না দিলেও পরে সে একটু আগ্রহ দেখায়।
-'কে তোকে এসব বললে রে?'
-'ওগো,আমাদের নতুন মাষ্টারমশাই বললেন গো।তিনি মাধ‍্যমিক পরীক্ষার খাতা দেখে শহরের অফিসে জমা দিতে যাবেন বলে বাস ধরতে গিয়ে শুনেছেন,সব গাড়ি চলাচল বন্ধ।'
-'সে কি রে!তোর কাকুর আসার কথা আছে যে! বাস না চললে সে আসবে কিভাবে?'
বধূর উদ্বেগের ছায়া ঘনালো মায়ের চোখেও…
ইতিমধ্যে টিভিতে রেডিওতে খবর পড়া শুরু হয়েছে, সুদূর তামিলনাড়ুর পেরামপুদূরে ভোটের প্রচারে গিয়ে কংগ্রেস নেতা রাজীব গান্ধী এক আত্মঘাতী মানববোমার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন,একতোড়া ফুল গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ,ছেঁড়া জুতো,রক্তাক্ত পায়ের অংশ,কান্না…এইসব ছবি ভাসছে টিভির স্ক্রীনে।দেশ জুড়ে চরম সতর্কতা জারী হয়েছে।
ছোট থেকেই শহরে বড়ো হওয়া নতুন বৌটির মনে পড়ে যাচ্ছে আরও আরও কিছু দুর্যোগের কথা…
আবারও হত্যা!আবারও ভোটের প্রচারে বেরিয়েই! হে ভগবান!
ভাবতে ভাবতেই ওখান থেকে উঠে এসে খিড়কি ঘাটে  বসলে বধূ। ভীষণ দুশ্চিন্তা হচ্ছে, একটু নির্জনতা প্রয়োজন।এবাড়িতে তার সবচাইতে আপন মানুষটির প্রিয় জায়গাটি কবে থেকে যে উত্তরাধিকার সুত্রে তারও প্রিয় হয়ে গেছে, এসব ঝামেলায় লক্ষ্য করলে না সে।
আনমনে পৈঠায় বসে দূর আকাশের দিকে তাকালে,নিদাঘ দহনবেলার উজ্জ্বল রোদেলা আলোয় একা একা চিল চক্রাকারে উড়ছে, বাড়ির বেশ কয়েকটি মানুষ বাইরে,তারা সব কেমন আছে,কিভাবে আছে,সে চিন্তায় সবাই উদ্বিগ্ন…
রাজনীতির কথা তেমন বোঝেনা; তবে ঘটনাটি শোনা ইস্তক তার মন হয়ে উঠেছে ভীষণ বিষন্ন…
এমনিতেই শরীরটা ভালো নেই,এমন সব সময়ে স্বামী সঙ্গ পেতে মন চায়, তিনি কিভাবে ফিরবেন,কেমন আছেন,তা নিয়ে দুশ্চিন্তা তো আছেই।
তাছাড়াও এই মানুষটি;এই রাজীব গান্ধীর সঙ্গে তার কুমারীবেলার কিছু অবিশ্বাস্য মধুর স্মৃতি আছে যে,ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তারই স্মৃতিচারণ করছিল সে…

সালটা ১৯৮৪,দিনটি ত্রিশে অক্টোবর। সেবারও এমনই ভোটের প্রচারে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বড়ো ছেলে রাজীব গান্ধী এসেছিলেন মেদিনীপুর শহরের কলেজ গ্রাউন্ডে,এক জনসভায়।তাঁকে বরন করার জন্য ডাকা হয়েছিল স্হানীয় কয়েকটি কিশোরীকে,তারমধ্যে ছিলো সে,এবং সৌভাগ্যক্রমে সেই সুপুরুষ মানুষটিকে ফুল ও চন্দনফোঁটা পরিয়েছিল সেই। এখনও মনে পড়ে,ফুলটি নিয়ে প্রসন্ন হাসিতে করজোড়ে তাকেও অভ‍্যর্থনা জানিয়েছিলেন তিনি। 
কি সুন্দর! কী সুন্দর মানুষটি! কি সুন্দর তাঁর সৌম্য হাসি! কি সুন্দর তাঁর সৌজন্যবোধ! 
আজন্ম বালিকা বিদ্যালয়ে পড়েছে, বাবা ছাড়া পুরুষসঙ্গের সুযোগ ছিল না তার। হয়তো তাইই অবাক বিস্ময়ে তাকিয়েছিল তাঁর পদ্মসদৃশ দেহ ত্বকের দিকে, চিকন গৌর শরীরটির দিকে। পরে পরে মনে পড়েছিল তাঁর সম্ভ্রান্ত ব্যবহারের কথা… 
মনে আছে, সেদিন বাড়ি ফিরেও ঘোর কাটেনি, বাবার সঙ্গে কতো গল্প, কতো উচ্ছাস সেসব নিয়েই। ইন্দিরা গান্ধী, জওহরলাল নেহেরু… বাবা তাঁর আলমারি থেকে বের করে দিয়েছিলেন “ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া”  বাংলা অর্থে ভারত সন্ধান… 
পড়েছিল, জেনেছিল কতো কিছু; বাবার কাছ থেকে মেয়েটি যে পড়তে ভালোবাসার গুণটিও পেয়েছিল। এ বাড়ির পিসিমার সঙ্গে মনের টান তৈরি হওয়ার মূলও যে ঐ বইপ্রেম… 
বিভ্রান্ত মনে এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল সে, খেয়াল ছিল না মেয়েটির। ঘোর ভাঙলো ভাসুরের ছেলেটির ডাকে, 
-’ও কাকীমা! এই দুপুর রোদে এখানে বসে আছো কেন গো! জানো না, এমন সময়ে একা থাকতে নেই!’
-’একা থাকতে নেই! কেন?’
খানিক বিরক্ত হয়ে জানতে চেয়েছিল শহুরে কন্যা। ভেবেছিল, এদের কি কোন বোধ নেই! এইটুকু বাচ্চাকেও সব কথা বলে দেয়! 
তবে ভুল ভেঙেছিল একটু পরেই… 
বাচ্চাটি আদর করে ওর পাশে বসে জানিয়েছিল, মা বলেছে, মনখারাপ হলে একা থাকতে নেই। সবার সঙ্গে থাকতে হয়। আনন্দ নাকি ভাগ করলে বাড়ে, আর দুঃখ ভাগ করলে কমে। প্রিয় মানুষ মারা গেলে কষ্ট তো হবেই, তবে জীবন তো মরার চেয়ে অনেক বড়ো, তাই না! 
আমি জানি গো,খবরটা শুনে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে,তাইতো আমি তোমার কাছে এলাম… 
চমকে তাকালো মেয়ে! কি বললে ও! আনন্দ ভাগে বাড়ে, দুঃখ ভাগে কমে!
জীবন মৃত্যুর চেয়ে বড়ো! 
ওর মা শিখিয়েছে ওকে এসব কথা! 
যার প্রথাগত উচ্চশিক্ষা নেই বলে যাকে সে আন্ডার এস্টিমেট করে! খুব সাধারণ ভাবে! 
কী যেন এক পরম শ্রদ্ধায় নত হলো সে সাধারণ মানুষের এমন অসাধারণ জীবনবোধের চরণে…মনে পড়লো শিক্ষক পিতার উচ্চারণ, ওল্ড টেস্টামেন্ট থেকে,
EVEN THOUGH I WALK THROUGH THE VALLEY OF THE SHADOW OF DEATH, I WILL FEAR NO EVIL, FOR YOU ARE WITH ΜΕ; YOUR ROD AND YOUR STAFF, THEY COMFORT ME.(ক্রমশঃ)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments