জ্বলদর্চি

দিন সুমারি /পুলককান্তি কর

দিন সুমারি
পুলককান্তি  কর

ক্যালেণ্ডারের দিকে চোখ পড়তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল সুদর্শনবাবুর। আরও দু'হাজার সাতশো ছিয়াশি দিন অফিস যেতে হবে তাঁকে। রেলের চাকরি। সকাল সাতটায় বাড়ি থেকে বের হতে হয়। ফিরতে ফিরতে রাত আটটা। রোজ রোজ সেই একঘেয়ে কাজ। ন’টা সওয়া ন’টায় অফিস পৌঁছে একটু টিফিন খাওয়া, আধঘণ্টা মতো চেয়ারে বসে একটু ঝিমোনো, তারপর অন্যান্য কলিগেরা এলে একটু এটা ওটা গল্প। কয়েকটা ফাইল এপাশ-ওপাশ করতে না করতেই লাঞ্চ-আওয়ার। তারপর আবার বাড়ি ফেরার তাড়া। এভাবে দিনের পর দিন মানুষ কাটাতে পারে? কোনও ক্রিয়েটিভ কিছু নেই। বহুবার ভেবেছেন এবার ভি.আর.এস নিয়ে নেবেন। কিছু প্রতিবার পে-কমিশনে মাইনে যে ভাবে বাড়ছে -- কিছুতেই মনস্থির করে উঠতে পারছেন না তিনি৷ প্রতি রবিবার সকাল হলেই ক্যালেণ্ডারের উপর লিখে রাখেন আরও কতদিন এরকম দিনগত পাপক্ষয় করতে হবে তাঁকে। আজ মনে মনে ভাবলেন সামনের বছরেই ভি.আর.এসের জন্য আবেদন করবেন তিনি৷ হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ যেতেই টনক নড়ল তাঁর। প্রায় পৌনে এগারোটা বাজে। কই, মামের সাড়াশব্দ নেই তো ! ঘুমিয়ে পড়ল নাকি? উঠে দাঁড়ালেন তিনি৷ পাশের ঘরে গিয়ে দেখলেন, মাম চুপটি করে খাটে শুয়ে আছে৷ জিজ্ঞেস করলেন, কী রে শুয়ে আছিস কেন ? 
-- পেটটা খুব ব্যথা করছে বাপি। আর বসতে পারছিলাম না। 
সুদর্শনবাবু গত মাসের ডেটটা মনে করলেন। এবার প্রায় সাতদিন পরে হল। বললেন, আমাকে ডাকলি না কেন, একটু গরম জল করে দিতাম। 
-- ভাবলাম একেবারে শোওয়ার সময়েই হট ওয়াটার ব্যাগটা নিয়ে শোব। কিন্তু এখন দেখছি ব্যথাটা বেশ ভালোই হচ্ছে৷ 
-- পেইনকিলার কিছু খেয়েছিস ? 
-- না৷ 
-- দাঁড়া, আগে বরং হট ওয়াটার ব্যাগটা নিয়ে আসি। 
মিনিট পাঁচেক বাদে ব্যাগটা একটা মোটা তোয়ালেতে জড়াতে জড়াতে ফিরে এলেন সুদর্শনবাবু। বললেন, ওষুধ কি কিছু দেব এখন? তবে আমার মনে হয় দুটো কিছু খেয়ে ওষুধটা খাওয়া ভালো। 
-- আমার এখন উঠে গিয়ে খাওয়ার ক্ষমতা নেই বাপি। বমি বমি পাচ্ছে। 
-- তাহলে একটু সেঁকটা নে। ব্যথাটা একটু কম বোধ হলে তখন উঠে খাবি না হয়। 
-- বাপি, তুমি খেয়ে নাও। আজ রাতে আমি কিছু খাব না। 
-- তা বললে কী করে হবে ? ডাক্তারবাবু অশোকারিষ্টটা তো খাওয়ার পরেই খেতে বলেছেন। 
-- তাহলে ওটা আর আজকে খাবো না। 
-- ওষুধ কি তোর খেয়াল খুশি মতো খাস না কি? ডাক্তারবাবু বলেছেন না ওটা টানা তিনটে সাইকেল খেতে? বলি, দিনের বেলা ওষুধগুলো কি নিয়ম করে খাচ্ছিস? না কি কলেজের তাড়ায় অর্ধেক দিন বাদ পড়ছে? 
-- ওই রাতের বেলাটাই নিয়ম করে হয়। 
-- সে তো আমি নিয়ম করে দিই বলে। কিন্তু আমি তো নমিতাকে বলে দিয়েছি, ও যেন মনে করে তোর বেরোবার আগে ওষুধটা দেয়। আর তুইও তো বড় হয়েছিস মাম, একটু মনে করে নিতে পারিস না ? 
-- মনে থাকে বাপি, সময় হয় না। 
-- একটা ঢোক গিলতে কত সময় লাগে মাম ? এগুলো সিম্পলি নেগলিজেন্সি। এত কষ্ট পাচ্ছিস। একটু নিয়ম করে তিনটে মাস খেয়ে দ্যাখ না ! নইলে ডাক্তারবাবুকেই বা কী রিপোর্ট করব ? কাল সকাল থেকে না হয় আমিই রেডি করে রেখে যাব। মনে করে খাস। 
-- দ্যাখো বাপি, ছেলেদের কত মজা! এসব কষ্ট নেই। প্রতি মাসে এই সময় এলে মনে হয়, ভগবান ব্যাটা নির্ঘাত এক পুরুষ মানুষ! মেয়েদেরই যত কষ্ট, যত ঝক্কি। 
-- পুরুষের হয়তো এই কষ্ট নেই, অন্য কষ্ট আছে। ভগবানের সব কিছু নিক্তি মাপা বুঝলি? আমাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বিচার না করাই ভালো। আর সব মেয়েদের তো এই কষ্ট হয় না৷ তোর পিসি আর আমি তো একঘরে বড় হয়েছি। এরকম কিছু যে হয়, বিয়ের আগে পর্যন্ত তো আমি টেরই পাইনি। তবে তোর মা খুব কষ্ট পেত। 
-- ও, আমি তবে এটা ইনহেরিট করেছি বলো ? মহিলা দেখছি মনে রাখার মতো ভালো কিছুই দিয়ে যেতে পারেনি। 
প্রসঙ্গটা না তুললেই ভালো হতো। তরে বেখেয়ালে যখন এসেই গেছে, বিষয়টা লঘু করার জন্য সুদর্শন বললেন, দেখবি বিয়ের পর তোর আর এই ব্যথা থাকবে না। বাচ্চা-কাচ্চা হলে অনেকেরই এই ব্যথা চলে যায়। তুই হওয়ার পর তোর মায়ের আর এই কষ্ট একদম হতো না। 
-- তবে ওই মহিলার জীবনে আমি অভিশাপ মুক্তি ঘটিয়েছিলাম বলো ? 
সুদর্শন চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ পরে মাম আবার বলল, এই কষ্ট আমি সারা জীবন পাই তাও ভালো, বিয়ে আমি করব না। 
-- সে কী, কেন ? 
--দূর! ভদ্রলোকে বিয়ে করে?
-- যারা বিয়ে করছে তারা সব অভদ্রলোক ? 
-- মানুষ নির্লজ্জতার শেষ সীমায় পৌঁছলে তবেই বিয়ে করে বাপি। আর তাছাড়া বিয়ে করে কী লাভ বলতে পারো ? 
-- লাভ-ক্ষতি দেখে কেউ বিয়ে করে না মাম। ওটা জীবনের একটা অঙ্গ। 
-- তুমি বিয়ে করে আফসোস করো না ? 
-- না৷ 
-- কেন করো না? তুমি তো বিয়ে করে সুখি হওনি ! 
-- আমি বিয়েতে সুখি হইনি বলে সব বিয়ে কি অসুখের হয় মাম? তোর পিসির কথাই ধর না। ওদের বাড়ি গেলে কখনও কি তোর মনে হয়, ওখানে কোনও অশান্তি আছে? সুখের কোনও খামতি আছে ? 
-- সে তুমি যাই বলো বাপি, বিয়ে আমি করব না। 
-- আচ্ছা, সে পরে ভাবা যাবে’খন৷ চল, একটু কিছু খেয়ে নিবি। আমি খাবারগুলো গরম করে টেবিলে লাগাচ্ছি।
 
মামের হল পাখির আহার। বিশেষ করে আজকে তো কেবল বাসন এঁটো করার জন্যই তার খেতে বসা। খাবার-দাবার সব গুছিয়ে ফ্রিজে তুলে দিলেন সুদর্শনবাবু। বাসন-টাসন সব সিঙ্কেই রাখা থাকবে৷ নমিতা সকাল আটটা নাগাদ এসে ধোবে। সে কামাই বড় একটা করে না। নেহাত কোনও কারণে না এলে বাসন রাখা থাকে। অফিস থেকে ফিরে তিনি মেজে নেন৷ সেই দিনগুলোয় মামের অবশ্য খাওয়ার কষ্ট হয়। আগে থেকে জানলে তিনিই সকালে কিছু রেঁধে রেখে যান। নইলে অগত্যা কলেজ ক্যান্টিন। মুখটুখ ধুয়ে অফিসের ব্যাগ গোছাতে বসলেন সুদর্শনবাবু। এই কাজটা তিনি রাতেই সেরে রাখেন। নইলে সকালে তাড়াহুড়োয় কিছু না কিছু ভুলে চলে যান তিনি। জিনিস বলতে অবশ্য জলের বোতল, ছাতা, মোবাইল, ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি আর কয়েকটা বিস্কিট। এর কোনও একটা ভুললে বিস্তর সমস্যা হয় তাঁর। ঘড়িতে অ্যালার্ম লাগানোই থাকে। সকাল সাড়ে চারটেয় ওঠেন তিনি৷ একঘণ্টা মর্নিং ওয়াক। বছর ছয়েক আগে হঠাৎ করে সুগার আর কোলেস্টেরল ধরা পড়েছিল তাঁর। শুধু মর্নিং ওয়াক আর সকালে বিশ গ্রাম করে রসুন খেয়ে সব সমস্যা কন্ট্রোল করে ফেলেছেন তিনি৷ কোনও ওষুধ খান না। শুধু ডায়েটটা মেনটেন করেন আর হাঁটায় কামাই দেন না কোনওদিন। আজ অ্যালার্মটা পনেরো মিনিট এগিয়ে দিলেন। উঠে প্রথমেই মামের জলটা বদলে দেওয়ার দরকার। ততক্ষণে নিশ্চয়ই ঠান্ডা হয়ে যাবে। হঠাৎ মনে হল, আজ তো মামের সাথেই শোওয়া যেতে পারে। ভাবতেই মনটা খুশি হয়ে গেল তাঁর। ছোটবেলা থেকে ক্লাস টুয়েলভ পর্যন্ত মেয়ের সাথেই শুতেন তিনি৷ ও একা শুতে ভয় পেত। কলেজে যাওয়ার পর থেকে প্রায় জোর করেই ওকে পাশের ঘরে শোওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। ও মোবাইল বা কম্পিউটার নিয়ে খুটখু্ট করে, ওঁর ওতে ঘুম আসে না৷ শুধুই যে এটা কারণ – তা নয়; মেয়ে বড় হয়েছে-- ওর আলাদা স্পেস দরকার, এটাও মাথায় ছিল তাঁর। মেয়ের ঘরে নিজের বালিশটা নিয়ে বললেন, মাম আজ বরং তোর সাথেই শুয়ে যাই। রাতে কখন কী দরকার হয়। 
-- না না বাপি। তুমি তোমার ঘরেই শোও। আমার কিছু নোটস করার আছে। তোমার ঘুমের ডিস্টার্ব হবে। 
-- আজ তোর শরীরটা ভালো নেই। রাতে না হয় নাই জাগলি। 
-- ও কিছু হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে শোও। দরকার হলে তোমায় ডাকব। 

বালিশ নিয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে এলেন সুদর্শনবাবু। হঠাৎ পাওয়া খুশিটা যেন এক ফুঁ এ নিভে গেল তাঁর। মনটা একটু ভারি হয়ে গেল। বিছানায় মশারি-টশারি লাগিয়ে বারান্দায় এসে বসলেন তিনি। এই বারান্দা থেকে আকাশটা ভালো দেখা যায়। স্ট্রিট ল্যাম্প না থাকায় রাতটাকে বেশ ছোঁওয়া যায় এখানে। তাঁর বারান্দা থেকে শ'দেড়েক ফুট দুরে একটা নারকেল গাছ আছে। তার ঠিক মাথার উপরের তারাটির দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। এই তারাটির তিনি মনে মনে নাম রেখেছেন “সাথী”। বড় নিস্প্রভ, তবু মিটিমিটি চোখে তাঁর দিকে চেয়ে সমবেদনা জানাল সেও। মাম যখন ছোট ছিল, মাঝে মাঝেই অবুঝ হয়ে মাকে খুঁজতো। একদিন কোনও ভাবে তাকে সামলাতে না পেরে এই তারাটিকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ওই তো তোর মা। মাম তখন কচি হাতে তারাটিকে হাতছানি দিয়ে বলতো, মা আয় আয়। অবশ্য বেশিদিন এই জারিজুরি চলল না৷ মামের যখন বছর চার বয়েস, একদিন জিজ্ঞেস করল, বাপি, মা কি মরে গেছে ? 
-- কেন মা ? 
-- তুমি যে সেদিন গল্প বলছিলে- ওই একজন মরে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে গেছে ! না মরলে কেউ বুঝি তারা হয় ? 

বড় বিব্রত বোধ করলেন সুদর্শন। এই প্রয়োগটি এত পুরোনো আর বহু ব্যবহৃত যে বলার সময় তাঁর খেয়াল ছিল না। শরীরে আর মনে পরিণত হওয়ার অনেক আগেই মাম জেনে গেল যে ওর মা ওদের ছেড়ে চলে গেছে। তারপর অবশ্য সে কখনও মায়ের প্রসঙ্গ তুলত না। কথাচ্ছলে সুদর্শন কখনও বললে মাম এমন জবাব দিত যে তিনি নিজে বড় অস্বস্তি বোধ করতেন। কই সুলেখার উপর তিনি তো কোনও রাগ পুষে রাখেননি। মেয়ের মনেও মায়ের প্রতি কোনও বিদ্বেষ পুঁতে দেননি। সত্যি কথা বলতে কি, সুলেখার চলে যাওয়া নিয়ে মামের সাথে তিনি কখনও কোনও আলোচনা সযত্নে এড়িয়ে যেতেন। এই বছর দুই আগে মাম একদিন খাবার টেবিলে বলল, জানো তো বাপি, স্বর্ণালির বাবা আবার বিয়ে করল। 
-- কেন ? 
-- একা একা অফিস-ঘর সামলানো কি সোজা কথা ? 
-- করলই যখন, দশ বছর আগে করতে পারতো। মেয়েটাকে মানুষ করতে সুবিধে হতো। 
-- তুমিও তো করতে পারতে বাপি ? 
-- আমার তো কোনও দরকার পড়েনি মাম। 
-- আসল কথা বলো, তুমি আমার জন্য স্যাক্রিফাইস করেছ। 
-- এভাবে বলছিস কেন ? 
-- সবাই তো তাই বলবে। 
-- সবার ভাবনা তো এক রকম নয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সুদর্শন। সত্যি, দ্বিতীয় বার বিয়ে করার কথা তাঁর মাথাতেই কখনও আসেনি। সুলেখা যখন চলে গেল, মামের বয়স তখন বছর দুই। তারপর মেয়ে মানুষ করা আর অফিস-- এই দুইয়ের ফাঁকে সময় যে কখন এতটা পার হয়ে গেছে, খেয়ালও হয়নি তাঁর। 
-- আচ্ছা বাপি, এই যে আমি বেঁচে আছি, মাধ্যমিক পাশ করেছি, এসব খবর তোমার স্ত্রী জানে? 
-- আমি কী করে বলব বল? আমার সাথে তো কোনও যোগাযোগ নেই। হয়তো পিসির থেকে খবর নেয়। 
-- পিসির সাথে যোগাযোগ থাকলে তুমি জানতে না? পিসি নিশ্চয়ই বলতো। 
-- হয়তো বলতো। 
-- আচ্ছা, ওই মহিলার কি দ্বিতীয় বার বিয়ে হয়েছে? 
-- না বোধহয়। তাহলে তো ডিভোর্সের মামলা করতে হতো। 
-- সে কী ! তোমাদের ডিভোর্স হয়নি ? 
-- না৷ কোনও পক্ষই আদালতে যায়নি। 
-- তুমি যাওনি কেন? 
-- গিয়ে কী করব? আমি কি দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে যাব যে আমার ডিভোর্সির সার্টিফিকেট দরকার ? মিছিমিছি এত হ্যাপা কে পোয়াতো বল? তাছাড়া অত দৌড়ঝাঁপ করার সময়ও ছিল না। 
-- আমাকে তাহলে তুমি এমনিই পেয়েছ? কোনও কাস্টোডি ক্লেম করতে হয়নি? ঈষৎ যেন আশাহতের বেদনা ছুঁয়ে গেল মামের গলায়। 

সুদর্শন বুঝলেন। একটু গাঢ় গলায় বললেন, ভাগ্যিস, সুলেখা তোকে নিয়ে যায়নি। তাহলে আমি কীভাবে থাকতাম বল ? 

কোথাও যেন একটা পাখি কর্কশ ভাবে ডেকে উঠল। সুদর্শন দেখলেন মেয়ের ঘরে এখনও আলো জ্বলছে। মোবাইলটা জ্বেলে দেখলেন, রাত আড়াইটা বাজে। আজ অনেকদিন বাদে ঘুম আসছে না তাঁর। খানিকটা জোর করেই বিছানায় গিয়ে শুলেন তিনি৷ অ্যালার্মটা যখন বাজল, তখন চোখে তন্দ্রার ঘোর। উঠে মেয়ের জন্য গরম জল করলেন৷ আজ আর মর্নিং ওয়াকে যাওয়ার ইচ্ছা হল না তাঁর। আবার গিয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি। যখন চোখ খুলল, তখন সাড়ে ছ'টা। অনেকখানি লেট। পরের ট্রেনে যখন অফিস পৌঁছলেন, সুবিমল বলল, ‘কী ব্যাপার, আজ লেট যে বড় ! শরীর-টরীর খারাপ না কি ? ‘
-- না, না৷ আসলে কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি। মেয়েটারও শরীরটা ভালো ছিল না বলে রাতে কিছু খায়নি। তাই সকালে উঠে ওর জন্য একটু জলখাবার করে রেখে এলাম। নমিতা আসতে আসতে তো আটটা, সাড়ে আটটা। যদি সকালে খিদে পায় ! 
-- এই জন্য জীবনে বউ এর দরকার বুঝলি। যখন বয়েস ছিল, তখন শুনলি না। 
সুদর্শন একটু হাসলেন। 
-- কীরে, হাসলি যে বড় ? 
-- যদি বউ এর টিফিনটাও করে রাখতে হতো? এখন আর আগেকার দিন নেই বুঝলি। পতিসেবাকে কেউ আর পূণ্য বলে মনে করে না। 
-- বউকে হ্যান্ডেল করা জানতে হবে। আমি তো অফিস থেকে ফিরে এমন ভাব করি যেন যুদ্ধ জয় করে ফিরছি। খানিকক্ষণ পাখা চালিয়ে চোখ বন্ধ করে বসি। তারপর চা-টা খেয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ি। বউ ভাবে সারাদিন প্রচুর খাটাখাটনি করে স্বামী ভীষণ টায়ার্ড। ছেলের পড়া নিয়েও আমাকে বসতে হয় না, এটা করে দাও, ওটা এনে দাও - এসবও শুনতে হয় না। 
-- আপনি বিয়ে করে বউ এনেছেন, নাকি দাসী এনেছেন সুবিমলবাবু ? পাশ থেকে ফোঁস করে উঠলেন মিসেস চ্যাটার্জী। ‘আপনি ভাবুন তো, সারাদিন বাড়ির সব কাজ সামলাতে আপনার মিসেসের কত কষ্ট হয়! আপনার ছুটিছাটা আছে, বাড়িতে এটাওটা হাতের কাছে জুগিয়ে দেওয়ার লোক আছে, আর বাড়ির বউদের?’
--কেন, আমরা যারা সারাদিন ট্রেনে-বাসে গুঁতো খেতে খেতে অফিস আসি, এখানে কাজ  করি, আবার ভিড় ঠেলে বাড়ি ফিরি - এতে শ্রম হয় না? আর ছুটিছাটা বলছেন, ওসব দিনে বাড়ির হাজারটা কাজ সেজে থাকে। বাজার করা, মিস্ত্রি লাগানো, আজ ওয়াশিং মেশিন খারাপ, কাল কলে জল আসছে না, ইলেক্ট্রিক বিল, টেলিফোন বিল -- এসব কে করে শুনি ? 
-- আমাদের কথা ভাবুন তো ! সকালে চা করে এসেছি। বাড়ি ফিরে আবার আমাকেই চা করতে হবে। 
-- আপনার কথা আলাদা। যে সব বউরা চাকরি করে না, বিষয়টা তাদের নিয়েই। পুরুষ মানুষ যদি বাইরেরটা সামলায়, বউদের বাড়িঘর সামলাতে অসুবিধেটা কোথায়? নাহলে সংসারটাই বা টিকবে কী করে ? 
-- সংসার টেকানোর দায়টা কেবল মেয়েদের ঘাড়েই বা কেন ফেলে দেন সুবিমলবাবু ? 
-- এতে তো ফেলাফেলির কিছু নেই৷ ছেলেরা বাইরে গিয়ে যে রোজগার করে আনছে, সেটাও তো সংসারের জন্যই। মেয়েরা যদি বেকার ছেলে বিয়ে করে নিজেরা রোজগার করতে যায়, তবে বাড়িঘর সামলানোর দায়িত্ব তাদের বরকেই নিতে হবে। তাতে তো আমার আপত্তি নেই। মূল কথা হল ঘরে-বাইরে কাজের দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নেওয়া। 
-- কাজের ভাগাভাগির কথা যদি বলো, তবে শোন৷ পাশ থেকে মিস্টার ঘোষ বললেন। আমাদের পাড়ায় এক দম্পতি আছে, বেশি দিনের বিয়ে নয় -- এই তিন-চার বছর হবে বোধহয়। বউটি নারীবাদি না কী বলে আজকাল, তাই। বরের সঙ্গে চুক্তি -- ও বাসন ধোবে, বরকে হাঁড়ি-কড়া, প্রেসার কুকার মাজতে হবে। বিছানার চাদর বউটি পাতবে আর মশারি টাঙানো, গোঁজা ছেলেটির কাজ। দিনের বেলা রান্নার লোক আসে। রাতের ভাতটুকু শুধু নিজেদেরকে করতে হয়। তা বউটি ভাত বসায়। ভাতের ফেন গালা আর ফ্রিজে রাখা দিনের বেলাকার তরকারি গরম করা ওই ছেলেটি করে৷ 
-- তবে ওরা বাসন মাজার লোক রাখে না কেন ? মিসেস চ্যাটার্জী বললেন। 
-- টেকে না। রান্নার লোকও মাসে মাসে বদলায়। 
-- মেয়েটি চাকরি করে নাকি ? 
-- না না৷ পুরোপুরি হাউস-ওয়াইফ। 
-- দেখুন মিস্টার ঘোষ, এর মধ্যে নারীবাদ, পুরুষবাদ কিছু নেই। এই শ্রেণীর মেয়েদের মধ্যে সিম্পলি সেলফ রেসপেক্ট নেই। প্রতিটি মানুষকেই কিছু না কিছু কাজ করতে হয়, করা উচিৎ। এদের বোঝা উচিৎ, মানুষ কেবল একসাথে শোওয়ার জন্য বিয়ে করে না। দিব্যেন্দুদা মত দিলেন। 
-- না হে না, এসব কিছু নয়। দোষ যত সব হাতের। দ্যাখো, এই মেয়েরা সব ফিলোজফিক্যাল হ্যান্ড। সব সময় আমি আমি ভাব। প্রবীর বলল। জ্যোতিষ চর্চার নেশা তার। সুতরাং সবকিছুকেই এই অ্যাঙ্গেলে বিচার করে সে। 
-- গ্রহ-রত্ন ধারণ করলে কোনও লাভ হবে? ছেলেটিকে দেবো তোমার নম্বর? মজা করলেন মিস্টার ঘোষ।। 
-- না না, এর প্রতিকার নেই। কনজেনিটাল। ডিভোর্স পেলে তবেই প্রতিকার। হাসল প্রবীর। আচ্ছা সুদর্শন, তোকে নিয়েই এত ক্যাচর-ম্যাচর, তুইই চুপ মেরে গেলি কেন? তোর কোনও মত নেই ? 
এতক্ষণ শুনছিলেন সুদর্শন। সত্যি তো, তিনি তো কখনও মেয়েদের কাজ, ছেলেদের কাজ বলে কোনওদিন কিছু দেখেন না। যতক্ষণ তিনি পারেন, তার মতো করে সংসারের সমস্ত কাজই তিনি করেন৷ যে কাজ করে না, নিজেকেই ফাঁকি দেয় সে। হাজার রকমের রোগ এসে বাসা বাঁধে তার দেহে। সুলেখা যখন ছিল, তখনও তিনি অফিস থেকে ফিরে এটাওটা করে দিতেন। মাম হওয়ার পর মেয়ের বোতল ফোটানো, জল ফুটিয়ে ছেঁকে রাখা, দুধ গরম করে দেওয়া, রাতে মেয়ের কাঁথা বদলানো, ঘুম পাড়ানো -- সব তিনি করতেন। দিনের বেলা যখন অফিস যেতেন, তখন অবশ্য সুলেখাই সামলাতো। প্রথম দিকে আয়া রাখা ছিল। নমিতা তখন শুধু ঘরমোছা আর বাসন ধোওয়ার কাজ করত। সুলেখার আরামের কথা ভেবে সুদর্শন নমিতার অন্যান্য সব বাড়ির কাজ ছাড়িয়ে তাঁর বাড়িতেই দশ ঘণ্টা থাকার ব্যবস্থ করে দিলেন৷ নমিতা খুবই বিশ্বস্ত। মামও ছোটবেলা থেকেই ওকে খুব পছন্দ করে। সুলেখার সাথে সুদর্শনের কোনও প্রকার মিলই ছিল না। তবু তিনি সুলেখাকে ভালোই বাসতেন। মানসিকতায় বা চিন্তাধারায় যত অমিলই হোক, তিনি তাঁর সব সময়েই যত্ন নিতেন বা তাঁর কষ্ট লাঘবের জন্য সবসময়েই সচেষ্ট থাকতেন। সুবিমল যাই বলুক না কেন, তার মতো নিজের ক্লান্তি দেখানোর নাটক তিনি কখনওই করার কথা ভাবতে পারতেন না। তাছাড়া ভালোবাসার মানুষের সাথে কি কাজের হিসেব চলে? যেখানেই হিসেব আসে, সেখানে আর ভালোবাসা থাকে না, সমঝোতা থাকে। তবে কিনা মানুষের মন। সুদর্শনও খেয়াল করলেন, যে কাজ তিনি আগ বাড়িয়ে করা শুরু করেন, সেটাই তাঁর বরাদ্দ কাজ হয়ে দাঁড়াল। কোনওদিন ট্রেন লেট করলে বা অন্য কোনও কারণে বাড়ি ফিরতে দেরি হলেও তিনি দেখলেন না বোতলটা কেউ ধুয়ে রেখেছে বা জলটা ফোটানো রয়েছে। ভালোবাসার এই এক দোষ।৷ অবচেতনেই কখন প্রত্যাশা তৈরি হয়। সুদর্শন হয়তো আমল দিতেন না। কিন্তু সারাদিন খাটাখাটনির পর মানুষ ভালোবেসে যে কাজ করে তাতে যদি কেউ ত্রুটি ধরতে শুরু করে তবে মুখ দিয়ে সব সময় সুবাক্য বের হয় না। আর কোনও পক্ষই বাক্যবাণ হজম করার মতো ধৈর্যশীল ছিলেন না। সাধারণ কোনও কাজ যা অনায়াসে সুলেখা বা নমিতাও করে ফেলতে পারে, তার জন্যও যখন সুদর্শন অভিযুক্ত হতে শুরু করলেন, তখন শুধু ভালোবাসা আর ক্ষত মেরামত করতে পারল না। শেষ দিকটায় এমনই হয়েছিল যে তাঁরা ভালো কথা বললেও মনে হত যেন ঝগড়া চলছে। সুদর্শন বেশ কিছু দিন ধরে লক্ষ্য করছিলেন, তাঁর ফেরার কাছাকাছি সময়ে যদি মাম পটি করত, তবে সুলেখা চুপ করে অপেক্ষা করতেন কখন তিনি এসে তা সাফ করবেন৷ একদিন ট্রেন থেকে নেমে বাজার করে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে গেল তাঁর। এসে দেখলেন, মামের প্যান্টে পটি লেগে শুকিয়ে গেছে। আর পেছনে লাল লাল র‍্যাশ। ক্রোধ চড়ে গেল মাথায়। দু'একটা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হতে হতে যখন শুনলেন ‘কী এমন রাজকার্য করে এসেছ’ ইত্যাদি ইত্যাদি, সংযম আর বাগ মানল না তাঁর। জীবনে প্রথমবার গায়ে হাত তুললেন তিনি৷ ব্যস। পরের দিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখলেন নমিতার কাছে মামকে রেখে সুলেখা বাপের বাড়ি চলে গেছেন। তখনও শ্বশ্তর-শাশুড়ি বেঁচে। একদিন শ্যালক এসে সুলেখার ব্যবহারের সব জিনিসপত্র নিয়ে গেল। লকারের চাবি সুলেখার কাছেই থাকত। ওর নামেই লকার। দাবী-দাওয়া নিয়ে খটাখটি কিংবা আদালত, কোনও কিছুই হল না। শ্বশুর-শাশুড়ি মেটাবার উদ্যোগ নিতেই পারতেন। নেননি। একদিকে হয়তো ভালোই হয়েছে। কোনওদিন কোনও কাজের জন্য তো আর তাঁকে কারোর কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না ! প্রবীরের কথার কী জবাব দেবেন তিনি? তাঁর মতো ঠাণ্ডা মাথার মানুষও যে কারো গায়ে হাত তুলতে পারে কেউ বিশ্বাস করবে? তিনি নিজেও কি বিশ্বাস করতে পারছিলেন? 
দিন তিনেক হল শরীরটা ভালো নেই সুদর্শনের। ঠাণ্ডা লাগা জ্বর। সঙ্গে খুসখুসে কাশি। তিনদিন অফিসও যাচ্ছেন না তিনি এই জন্য৷ তার উপর নমিতাও গত দু'দিন ধরে আসছে না। ওর মেয়েকে দেখতে আসবে আজ। সুতরাং বলারও কিছু নেই৷ সকালে উঠে বাসন-টাসন মেজে চায়ের জল চাপালেন তিনি। প্রায় পৌনে আটটা বাজে। মাম এখনও ঘুমোচ্ছে। ওর ঘরে গিয়ে দেখলেন, বিছানায় সব বইপত্র ছড়ানো। তার মধ্যেই কেমন গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে মেয়েটা। রাতে মশারিটাও টাঙায়নি। হাজার বার বলেছেন, রাতের খাবার খেয়েই মশারিটা লাগিয়ে রাখতে, যাতে ঘুম পেলে টুক করে ঢুকে পড়তে পারে৷ পাশের বাড়ির লালনের বউটা তো গত বছর ম্যালেরিয়ায় মরেই গেল। ভেবেই বুকটা ছাঁত করে উঠল সুদর্শনের। আস্তে করে মামের কপালে হাত রাখলেন। মেয়েটার শোওয়াটা ভালো নয়। কেমন “দ' এর মতো শোয়। একা শোয় বলে নাইটি টাইটি উঠে যায়, হুঁশ থাকে না। নাইটিটা গোড়ালি পর্যন্ত টেনে মৃদু ঠেলা দিলেন মেয়েকে, ‘ওঠ মাম, কলেজ যাবি না ?’ 
-- যাব তো। 
-- ওঠ তাহলে। চায়ের পাতা ভিজিয়ে এসেছি। 
-- এই তো উঠছি বাপি। বলেই পাশ ফিরে আবার শুয়ে গেল মাম। 
আবার ঠেলা দিলেন সুদর্শন। ‘ওঠ, চা খাবি কখন আর খাবারই বা খাবি কখন? ‘
চোখ ডলতে ডলতে মেয়ে উঠে বসতেই আলতো করে তাকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। এই গত বছর পর্যন্তও প্রায়ই তিনি মেয়েকে কোলে নিতেন৷। এখন কালেভদ্রে যদিও মাম কোলে বসে, তবে ইদানীং কেমন যেন আড়ষ্ট ভাব তার। মেয়েদের এক বিশেষ বয়সে বোধহয় এমনটা হয়। আজকাল অবশ্য সুদর্শন ওসব চেষ্টা বিশেষ করেন না। বললেন, ‘আজ বিকেলে একটু তাড়াতাড়ি ফিরবি তো? তাহলে একসাথে চা খাব।‘ 
-- না বাপি। আজ একটু দেরি হবে। 
-- কেন রে? আজ তো শনিবার। আজ তো কোনও টিউশান নেই? 
-- ওই বন্ধুরা সব সিনেমা যাবার টিকিট কেটেছে বাপি। অবশ্য তুমি যদি বলো …. 
-- না না, ঠিক আছে, দেখে আয়। 
-- আমার জন্য রাতের খাবার কোরো না বাপি। আমরা আজ সবাই বাইরে খাব। 
ইদানীং সুদর্শন খেয়াল করেছেন মামের বাড়ি ফিরতে প্রায়ই দেরি হয়। উনি বাড়ি ফেরার পর ফেরে। সবদিন কি টিউশন থাকে ? কি জানি! তিনি এসব নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্নও হন না৷ মেয়েকে সুশিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ যতটা পেরেছেন বন্ধুর মতো মিশেছেন। ও প্রেমেট্রেমে পড়লে নিশ্চয়ই তাঁকে বলবে। এই তো স্কুলে পড়ার সময়ে ছেলেরা প্রেমপত্র দিলে মাম তাঁকে দিয়েই পড়াতো। বাঙালি ছেলেপুলেরা প্রেমপত্রটা বেশ ভাষা দিয়ে, কবিতাফবিতা দিয়ে লেখে। মাম ইংলিশ মিডিয়ামের মেয়ে। বাবাকে দিয়ে সে ব্যাপারটা বুঝে নিত। দু'জনে এই নিয়ে হাসাহাসিও করতেন খুব। ইদানীং অবশ্য আর দেখায় না৷ এসব পড়তে পড়তে ভাষাটাও রপ্ত করে নিয়েছে বোধহয়। 
দুপুরে খাওয়ার পর মামের খাটে শুয়ে অনেকদিন পর পেপারটা বেশ মন দিয়ে পড়লেন সুদর্শন। আজকাল আর পেপারটেপার পড়তে ভালো লাগে না তাঁর। খুনখারাপি, সংঘর্ষ কত আর পড়বেন! আর পেপারগুলোও হয়েছে তেমনি! যত খুনোখুনি, রক্তারক্তির ছবি সব ফ্রন্ট পেজেই ছাপবে। খানিকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে বসলেন তিনি। মামের বইপত্রগুলো গুছিয়ে রাখলে হয়। বড় ছিত্তিরহান হয়ে পড়ে আছে জায়গাটা। মেয়েটা হয়েছে ওর মায়ের মতন। বড় অগোছালো। আজকালকার মেয়ে। কী করে সংসার করবে কে জানে? 
খাটের উপর থেকে বইগুলো নিয়ে র‍্যাকে তুলে দিলেন তিনি৷ র‍্যাকটাও বড় নোংরা হয়েছে। একেবারে ধুলোয় ভরা। সব বই নামিয়ে কাপড় দিয়ে মুছে রাখা দরকার। নাকে একটা কাপড় জড়িয়ে বইগুলো নামিয়ে ফেললেন তিনি৷ র‍্যাকের কোনাখুঁজিতে নানান বিষ্ময় যেন অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য। অন্তত ষাট-সত্তরটা চিঠি। চিঠিগুলো পড়া উচিত হবে কিনা চিন্তা করতে লাগলেন তিনি৷ তিনি মেয়ের বাবা সুতরাং গার্জেন হওয়ার নৈতিক দায় তাঁকে চিঠিগুলোর প্রতি আকৃষ্ট করে তুলল। অধিকাংশই উড়ো চিঠি। কাব্য করে লেখা। মাম নিশ্চয়ই পড়ে খুব হাসাহাসি করে থাকবে। এবার আরও কৌতুহলী হয়ে উঠলেন তিনি৷ মামের ব্যাগ, ড্রয়ারেও চোখ বুলোতে শুরু করলেন৷। এবার কিন্তু চক্ষু চড়কগাছ। একটি বাক্সে তিন চারটি ছেলের সিরিয়াল করে গোছানো কয়েক তাড়া চিঠি হাতে এল। ছেলেগুলির নামও তিনি মামের মুখে শুনেছেন। কেউ কলেজে একসাথে পড়ে, কেউ টিউশনে। চিঠির ভাষা যে সব নিরামিষ তা নয়। শেষের দিকের চিঠিগুলো বেশ ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত দেয়। নমিতা তো সাড়ে তিনটে-চারটেয় চলে যায়। তবে কি মাম ছেলেগুলোকে বাড়ি নিয়ে আসে? রাগে, দুঃখে, অভিমানে চোখ দুটো জলে ভরে গেল তাঁর৷। নিজের মেয়ের চোখে কীভাবে চোখ মেলাবেন তিনি৷ কোনও ক্রমে বইগুলোকে আগের মতো র‍্যাকে তুলে দিয়ে নিজের ঘরের বিছানায় এসে বসলেন কিছুটা বিহ্বল হয়ে। ক্যালেন্ডারের দিকে চোখ গেল তাঁর। এখনও দুঃহাজার সাতশো পঞ্চান্ন দিন অফিস যেতে হবে তাঁকে। না, সোমবারেই ভি.আর.এস এর দরখাস্ত দেবেন তিনি৷ পরক্ষণেই মনে হল, বাড়িতে বসেই বা কী করবেন? মেয়ের উপর গোয়েন্দাগিরি? কলকাতায় কি বখে যাবার জায়গার অভাব? এরকম নানান চিন্তা আর সংশয় এসে ভিড় করল তাঁর মনে৷ হঠাৎ বুকের বাঁদিকে একটু চিনচিন করে উঠল তাঁর। ক্রমে তীব্র এক বেদনা জাপটে ধরল তাঁকে। বাঁ হাত দিয়ে তার চোরা স্রোত যেন নামতে লাগল নীচে। দরদর করে ঘামতে লাগলেন তিনি৷ পাখাটা চালানো দরকার৷। উঠে গিয়ে পাখার সুইচটা চালু করলেন কোনওক্রমে। তবে আর খাটে ফিরতে পারলেন না। ওখানেই মেঝেতে পড়ে গেলেন তিনি৷ চারপাশের সব নিস্তব্ধতা ভেঙে ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো কেবল পাখার হাওয়ায় দুলে দুলে উড়তে লাগল।

🍂

Post a Comment

0 Comments