বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ২১
অগ্নিশিখা
ভাস্করব্রত পতি
"অগ্নিশিখা, এসো এসো, আনো আনো আলো।
দুঃখে সুখে ঘরে ঘরে গৃহদীপ জ্বালো৷
আনো শক্তি, আনো দীপ্তি, আনো শান্তি, আনো তৃপ্তি, আনো স্নিগ্ধ ভালোবাসা, আনো নিত্য ভালো।"
-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামকরণ করেছিলেন 'অগ্নিশিখা' ফুলের। একে 'অগ্নিজিহ্বা'ও বলা হয়। আসলে এর ফুল ফুটলে অগ্নিজিহ্বার মতো দেখায়। তবে পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষ একে বলে 'কাকমারা ফুল' বা 'কাওয়ামারা ফুল'। আসলে এই জেলার কাকমারা সম্প্রদায় তথা তেলুগু শবর মানুষজন তাঁদের মাথার লাল ফেট্টি বা 'রুয়াকোটা'তে এই গাছের ফুল গুঁজে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করতে বের হয়। আজ নগর সভ্যতার বাড়বাড়ন্তে এবং ক্রমশঃ জঙ্গল কমে যাওয়ায় হারিয়ে যাওয়ার পথে এই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা অতিব সুন্দর ফুলগাছ ও ফুলটি। মানুষের অজ্ঞানতার দরুন এই ফুলের জীবনে আঁধার নেমে এসেছে।
রামায়ণ অনুসারে বৈদ্য সুষেনের নির্দেশে হনুমানকে যেসব ঔষধি গাছ সমূহ আনতে বলা হয়েছিল, তার মধ্যে এটি একটি। অগ্নিশিখা ফুল প্রথমে ফোটার সময় সকালে ক্রিম সাদা রঙের হয়। পরের দিন ফুলের পাঁচটি পাঁপড়ির মুক্ত প্রান্তের দিকে অর্ধেক অংশ হলুদাভ হয়ে ওঠে। এবং গোড়ার দিকে মলিন সাদা বা ক্রিম রঙের থাকে। তৃতীয় দিন পাঁপড়িগুলির একপ্রান্তের এক তৃতীয়াংশ উগ্র লাল, মাঝে হলুদাভ এবং গোড়ার দিকে ক্রিম রঙের দেখায়। চতুর্থ দিন প্রায় পুরোটাই লাল হয়ে যায়। কিন্তু মুক্ত প্রান্তের রং আরো গাঢ় লাল রঙের হয়। ভাদ্র আশ্বিন মাসে এই ফুল ফুটতে দেখা যায়।
বিশ্বে ৭৭ টি পরিবারের ফুল রয়েছে যাঁরা নিয়মিত রং বদলায়। তাঁদের মধ্যে একটি এই ওলটচণ্ডাল ফুল তথা অগ্নিশিখা ফুল। মূলতঃ অ্যান্থোসায়ানিনের জন্য এরকম ঘটনা ঘটে বলে উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য। একসময় ছোটবেলায় ছোট ছোট কচিকাঁচারা একে 'বিষফুল' বলে খেলতো।
পূর্ব মেদিনীপুরের ক্ষীরাই নদীর পাড়ে ঝোপজঙ্গলে বর্ষাকালে প্রচুর ফুটতো একসময়। কিন্তু সরকারি বনসৃজনের নামে অন্যান্য গাছকে প্রাধান দিতে অজান্তেই কেটে ফেলা হচ্ছে এই গাছগুলোকে। বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না এর ফলে। হলদিয়া শিল্পাঞ্চল এলাকার কোথাও কোথাও ফুটতে দেখা যাচ্ছে। তবে তা সংখ্যায় অনেক কম। গ্রামাঞ্চলে এদের প্রায় দেখাই যায়না আগের মতো। উদ্ভিদবিদ্যার দুই গবেষক মেদিনীপুর কলেজের অধ্যাপক ড. পার্থপ্রতিম মাইতি এবং শিক্ষক কৃশানু সিংহ বলেন, উদ্ভিদ গবেষনার স্বার্থে এই ফুলকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি। এ ধরনের গাছ সচরাচর দেখা যায়না। আমাদের রাজ্যের মতো ওড়িশাতেও কমে গিয়েছে এই গাছ।
এটির প্রকৃত নাম ওলটচণ্ডাল। বিজ্ঞানসম্মত নাম Gloriosa superba। এটি Colchicaceae পরিবারভুক্ত। জিম্বাবোয়ের জাতীয় ফুল এটি। ১৯৪৭ সালে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে তাঁর ২১ তম জন্মদিনে রোডেশিয়া (এখনকার জিম্বাবোয়ে) ভ্রমনকালে এই ফুলের আকারে একটি হিরে উপহার দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। বর্তমানে তামিলনাড়ু রাজ্যের রাজ্য ফুলের তকমা দেওয়া হয়েছে একে। তামিল ভাষায় একে কিঝাঙ্গু, সেঙ্গানথাল এবং কানভালি নামেও চেনে। ইংরেজিতে Flame Lily, Climbing Lily, Tiger Claw, Fire Lily, Glory Lily এবং Creeping Lily ও বলে।
উদ্ভিদবিদ্যার পরিভাষায় এর পুষ্পবিন্যাসকে বলে Lax Corymbose Inflorescence। অত্যন্ত বিরল ধরনের পুষ্পবিন্যাস। এঁদের প্রতিটি পাঁপড়ি ঢেউখেলানো। পাঁপড়িগুলির দৈর্ঘ্য ৭-৮ সেমি এবং প্রস্থ ১ সেমি হয়। কুঁড়ি অবস্থায় নিচের দিকে মুখ থাকলেও ফোটার সময় গর্ভাশয় ও গর্ভদণ্ডের থেকে অন্যান্য ফুলের পাঁপড়ি যেমন সাধারনভাবে ৯০ ডিগ্রি কোনে ঘুরে যায়, এঁদের ক্ষেত্রে কিন্তু পাঁপড়িগুলি পুনরায় ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে ঝিমিয়ে নিম্নমুখী হয়ে ঝুলে থাকে। আস্তে আস্তে শুকিয়ে যায় এভাবেই। যেন লজ্জা পেয়েছে তাঁর রূপ যৌবন হারিয়ে! তাই উপকূলীয় এলাকার লোকমুখে 'লজ্জাবতী ফুল'! ভেষজ গাছ হিসেবেই পরিচিত গ্রামাঞ্চলে। কাঁথির অধ্যাপক তথা বিশিষ্ট লেখক ড. অমলেন্দুবিকাশ জানা বলেন, এখানকার মানুষজনের মুখে এটি 'ল লাঙ্গুলিয়া' গাছ নামেই পরিচিত। আসলে বায়বীয় কাণ্ডের প্রতিটি গাঁট থেকে এর পাতা জন্মায়। সেই পাতাগুলো যেমন চওড়া, তেমনই লম্বা। পাতার ডোগা সরু হতে হতে আকর্ষে পরিনত হয়। যা অনেকটা হনুমানের লেজ বা লাঙ্গুলের মতো জড়িয়ে ঝোপঝাড়ের শীর্ষে পৌঁছে যায়।
Gloriosa superba ছাড়াও পৃথিবীতে মেলে G. Simplex, G. lutea, G. carsonii, G. Rothschild Jana, R. virescens, R. abyssinica এবং Methonica superba প্রজাতির ওলটচণ্ডাল। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় গাছ এটি। এর টিউবারাস রাইজোমতে মেলে বিষাক্ত অ্যালকালয়েড 'কলচিসিন' এবং 'গ্লোরিওসিন'। মানুষ সহ গরু, ঘোড়া, বেড়াল, কুকুরদের কাছে খুব বিষাক্ত এই গাছ। তবে সাধারণত এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ উদ্ভিদ। দেহের মধ্যে যদি অস্ত্রের কোনো খণ্ডাংশ রয়ে যায় তবে তা বের করতে কাজে লাগে অগ্নিশিখা ফুল। আগুনে পোড়া ঘা সেরে যায় এর কল্যাণে। এটি বীর্যবর্ধক বলেও স্বীকৃত। ভারতে এর রাইজোম ব্যবহৃত হয় সন্তান জন্মানোর সময় প্রসববেদনা লাঘবের জন্য। এছাড়া সাপে কামড়ানো, গাউট, বন্ধ্যাত্ব, কলেরা, কিডনি সমস্যা, আলসার, কাটাছেঁড়া, স্মলপক্স, ক্যানসার, যৌনরোগ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয় বহুলভাবে। গমহা পূর্ণিমার পূজায় ওলোটচণ্ডাল বা অগ্নিশিখা ফুল এবং শনপাট গাছের ফুল অবশ্যই লাগে। রামায়ণ অনুসারে বৈদ্য সুষেনের নির্দেশে হনুমানকে যেসব ঔষধি গাছ সমূহ আনতে বলা হয়েছিল, তার মধ্যে ওলোটচণ্ডাল একটি।
অষ্ট্রেলিয়ার উপকূল এলাকাতেও এখন দেখা যাচ্ছে একে। এছাড়া কুইন্সল্যান্ড ও নিউ সাউথ ওয়েলসের উপকূল এলাকায় মিলছে। সিঙ্গাপুর, কুক আইল্যান্ড, কিরিবাটি, ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়াতে এই গাছ এখন 'ইনভেসিভ স্পিসিস' হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আসলে এখন এক শ্রেনীর লোভী ব্যবসায়ীর লোভের শিকার এই গাছটি। বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাঁচানোর এবং বংশবৃদ্ধির কোনো উদ্যোগ নেই কারোর। ফলে ক্রমশঃ হারিয়ে যাওয়ার পথে ঔষধি গাছ 'ওলটচণ্ডাল' তথা রবি ঠাকুরের 'অগ্নিশিখা'।
🍂
0 Comments