জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৩ / সালেহা খাতুন

আমার বিয়ের কার্ড, বাবার নির্দেশে যেটা আমি কলেজ স্ট্রিট থেকে সংগ্রহ করে আনি।

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫৩ / সালেহা খাতুন 

সাতানব্বইয়ের চার নভেম্বর থেকে প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজে শুরু হলো আংশিক সময়ের অধ্যাপনা। যে কলেজে নিজে পড়েছি সেখানে পড়ানো যতটা আনন্দের ততটা চ্যালেঞ্জেরও। সরু লিকলিকে চেহারার ম্যাডামকে অনেকেই শিক্ষার্থী ভেবে বসে। আমারই ক্লাসে যাওয়ার জন্য আমার ডান বাহু ধরে ঘুরিয়ে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দুড়দাড় করে উঠে যায় আর বলে সর সর এস কে ম্যাডামের ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। ক্লাসে যেতে দুঃখ প্রকাশ করে, বলে ম্যাডাম চিনতে পারি নি। স্টাফ রুমে এসে স্যারদের বললাম ঘটনাটা। গণিতের অধ্যাপক হরিবাবু বললেন তুই চওড়া পাড়ের শাড়ি পর, তবেই ম্যাডাম মনে হবে। 

আসলে তখন ওজন ছিল বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ কেজির মতো। কলেজে পড়াকালীন রক্তদান শিবিরে কতবার ডিসকোয়ালিফাই হয়েছি আন্ডারওয়েটের জন্য আর এখন কলেজে পড়াচ্ছি যখন তখনো বাতিল। তবে কারণটা ওভারওয়েট আর রক্তাল্পতা। প্রায় তিরিশ পয়ত্রিশ কেজি ওজন বাড়িয়েছি। মানুষ কোনো কিছুতেই মনে হয় কোনোদিন খুশি থাকতে পারে না। তখন ছোটোখাটো রোগা চেহারার জন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা যোগার পরামর্শ দিতেন আর এখন রোগা হওয়ার জন্য যোগা করার শলা দেন লোকজন। কিন্তু আমি তো খুশি। মোটা হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে ব’লে। তার উপর হেভিওয়েট ম্যাডাম তকমা পাওয়া! এ কী কম লাভ? আর আমার সহকর্মীদের নজরে সে বিষও নেই যে নজর লেগে আমার ওজন কমে যাবে।
🍂

কিন্তু বডিশেমিংয়ের শিকার হয়েছি প্রচুর। বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে গেছে ‘রোগা এবং নাটা’ হওয়ার জন্য। সালাউদ্দিনের সঙ্গে বিয়ের পাকাকথা হচ্ছে যেদিন যাকে প্রচলিত কথায় বলে দিনধার্য সেদিন আমার ভাসুর আমাকে প্রথম দেখেন। বাড়িতে গিয়ে ছোটোদের বলেন ঝাঁটাকাঠিতে কাপড় জড়ানো বৌ আসছে। মেজো বৌ বড্ড রোগা। 
আমার বিয়ের কার্ডে বাবার বয়ান

আচ্ছা তিনি না হয় স্বল্পশিক্ষিত মানুষ কিন্তু বিখ্যাত ঐতিহ্যশালী কলেজের প্রিন্সিপাল কি করে বলেন যে এই ছোটোখাটো চেহারায় এতো বড়ো কলেজে তুমি পড়াবে কি করে? বাবার সঙ্গে মেদিনীপুর কলেজে জয়েন করতে এসে এই কথা শুনেছিলাম। ইতিহাসের মাস্টারমশাই আমার বাবা প্রিন্সিপাল স্যারকে বলেন সক্রেটিস,নেপোলিয়ন এঁরা সবাই বেঁটে এবং ছোটোখাটো চেহারার ছিলেন। তাঁরা কিন্তু ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। বাবার মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল আপনিও ছোটোখাটো মানুষ কিন্তু দাপট কম নয়। বহু কষ্টে আমার স্পষ্টবাদী বাবা মুখ সামলে নিয়েছিলেন। ওমা আমি ভেবেছিলাম এ যুগে সবাই খুব ভালো মনের হয়ে গেছে। আমার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। আমার থেকে জুনিয়র এক বিজ্ঞানের অধ্যাপকের কাছে আমি বেঁটে ম্যাডাম বলে পরিচিত।

বেঁটে হই আর খাটো হই যাই হই না কেন ম্যাডাম ডাক শোনার জন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করতে হয়েছে বন্ধু। আসলে পরিশ্রমের বিকল্প কিছু নেই। ঐ সাতানব্বইয়ের সবকটা দুপুর কেটেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরিতে। দশ টাকা দিয়ে কার্ড করে নেটের পুরোনো প্রশ্ন তুলে খাতায় লিখে নিয়েছি। উপকার্স গাইড ফলো করেছি। বিশেষ কোনো কোচিং নিইনি। কিন্তু ঐ যে উচ্চমাধ্যমিকে সায়েন্স পড়েছিলাম তার ফল হাতেনাতে  পেলাম। ফার্স্ট পেপারের জন্য আমাকে ভাবতে হয় নি তবে আমার আলোদা আক্রামুল হক দু-তিন দিন বিশেষ যত্ন নিয়ে ফার্স্ট পেপারের কিছু দুর্বোধ্য অংশ আমাকে বুঝিয়ে দেয়। আর মূল বিষয় বাংলার প্রশ্ন নিয়ে তখনকার সিলেবাস অনুযায়ী আমি এম.এ. পাশ করেই আশি থেকে নব্বই শতাংশ উত্তর করতে পারতাম। বাকিটার জন্য প্রচণ্ড প্র্যাকটিশ করি। থার্ড পেপারে কুড়ি আর তিরিশ নম্বরের উত্তর ছোটো একটি স্পেসে কীভাবে লিখবো সেটা শিখিয়ে দেন আমার স্যার অধ্যাপক শ্যামল সেনগুপ্ত।

শুধু সাহিত্য নয় ধর্ম সভ্যতা সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে আমার পড়াশোনার বিস্তার তাঁর বন্ধুদের কাছে তুলে ধরার জন্য একদিন তিনি আমাকে মুখোমুখি বসিয়ে দেন প্রভু জগদ্বন্ধু কলেজের গণিতের অধ্যাপক দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায় এবং অর্থনীতির অধ্যাপক সুশান্ত চক্রবর্তীর। এটা কি আমার ইন্টারভিউ ছিল? অথচ মনে হলো আড্ডা দিচ্ছি তিন প্রাজ্ঞ অধ্যাপকের সঙ্গে। তার পরে পরেই অবশ্য আংশিক সময়ের অধ্যাপনার ডাক পাই। দাদু তো ভীষণ খুশি। শ্যামলবাবুকে বার বার বাহবা দিতে লাগলেন। দাদুর স্বপ্ন খানিকটা পূরণ হলো। আমার বিয়ের আগে থেকেই আমি অধ্যাপনা করছি। হোক না তা আংশিক সময়ের। বিয়ের আগে এবং পরে বাবা মা সালাউদ্দিনকে একটা কথাই বলেন, “দেখো বাবা মণির পড়াশোনা যেন বন্ধ না হয়”। আর সালাউদ্দিনও প্রথম দিন দেখতে এসে আলাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় যে সমস্ত কথা বলেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল “তুমি পিএইচ ডি করবে তো?”

ওর বাড়ির পরিবেশ পড়াশোনার উপযোগী ছিল না। ইলেভেন থেকে বি টেক পুরোটাই ও নিজে বাড়ির বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছে। তাই জানতো বাড়ির বৌয়ের পড়াশোনা ঐ বাড়ি থেকে হওয়া অসম্ভব। এজন্য বিয়ের আগেই ও আমার বাবাকে বলে মণি যতদিন না স্বাবলম্বী হয় ততদিন ও আপনার বাড়ি থেকেই পড়াশোনা করবে। আপনার বাড়ির একটি ঘর ওকে নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। সালাউদ্দিনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা আমার পড়ার ঘরেই হয়। বাবা ভুল বোঝে। ভাবে ছেলে মনে হয় ঘরজামাই থাকতে চায় অথবা নিজের স্ত্রীকে কাছে রাখতে চায় না। শ্বশুরমশাই বলেন তাহলে বাড়ির কাজ করবে কে? দুজনেই ছি ছি করেন। এবং বলেন এটা সম্ভব না। ফলে সালাউদ্দিনও রেগেমেগে বলে তাহলে একাজ করা আমার পক্ষেও সম্ভব না। অভিশপ্ত আঠাশে মে বিয়ের কথা এগোনোর বদলে স্তব্ধ হয়ে যায়। কম্যুনিকেশন গ্যাপ, একে অন্যকে না বোঝা কত বিপত্তি যে সংসারে ডেকে আনে সে আমার জীবন দিয়ে বুঝেছি।
রক্তদান শিবিরে যখন ডিসকোয়ালিফাই হয়ে যাই।

এতোসব জটিলতায় নিজেকে না জড়িয়ে আমি নেট সেটের প্রস্তুতি নিতে থাকি। সাতানব্বইয়ের ষোলো নভেম্বর সেট আর আঠাশে ডিসেম্বর ছিল নেট পরীক্ষা। তাই সেদিন দিনধার্য বা পাকাদেখার অনুষ্ঠানে বাবা বলেন মেয়ের নেট সেট পরীক্ষা আছে ওর পরীক্ষায় যাতে কোনো বিঘ্ন না ঘটে সে দিকে খেয়াল রেখে বিয়ের দিন ধার্য করা হোক। শ্বশুরমশাই অশ্লীল ভঙ্গিতে বলেন ওসব স্লেট পেন্সিলের কথা বাদ দিন অগ্রহায়ণ মাসেই বিয়ে হবে। পড়াশোনায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে বিয়ের আচার সংস্কার সম্পর্কে বেশি তথ্য সংগ্রহ করতে পারি নি। বিয়েতে গ্রামখরচ কত ছিল, কতজন বরযাত্রী ছিল, গায়ে হলুদের কাপড় আসবে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই জানতাম না। তবে বাবা প্রথম সন্তানের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন হাজারের কাছাকাছি লোকজনকে। সমাজসেবা, রাজনীতি, কর্মক্ষেত্র, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সব মিলিয়ে এর কমে আর নামতে পারেন নি। 

(ক্রমশ)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments