উদয়ের পথে
ষষ্ঠদশ পর্ব
মলয় সরকার
তবে এখানে এই নিশিকি বাজারে খাবার ব্যাপারে মোটামুটি যা সমীক্ষার অভিমত, তা জানাচ্ছি। কেউ ইচ্ছা করলে চেখে অবশ্যই দেখতে পারেন। সেগুলি হল,১) Takotomago, এটি আসলে কুইল পাখীর ডিমের সঙ্গে ছোট অক্টোপাসের মিশ্রণ,২) grilled mackerel , ম্যাকারেল মাছ সেকা একটু মশলা দিয়ে, ৩) Tsukemono, এটি আসলে নানা ধরণের সব্জীর আচার, যা ভাতের সঙ্গে বা অন্য খাবারের সঙ্গে খাওয়া যায়, ৪)Satsuma age এটি হল শুকনো মাছের একটি পদ ,যা বিভিন্ন স্বাদের ও মাছের হয়, ৫)Gomafukudo এটি হল তিলের একটি পদ যা, বিভিন্ন স্যালাড ড্রেসিং,মিষ্টি ও ডাম্পলিং এর সাথে খাওয়া যায়.৬) এ ছাড়া Senbei, যা আসলে চাল থেকে তৈরী এক ধরণের ক্র্যাকার, বা স্ন্যাক্স।আমরা এগুলো কোনটাই খাই নি।এছাড়াও যা পাওয়া যায় , তা হল Sesame dumplings, Yuzu honey ice cream, Japanese omelets, Wagashi (traditional sweets), এবং Soy powder-coated peanuts।আমাদের তো আসলে ওদের ওই ধরণের নানা মাছেই তো অভক্তি। তবুও যা খেয়েছি তাই অনেক।
এর পর আমরা বাজারের পূব দিকে একটি শিন্টো শ্রাইন দেখতে পেলাম, যেটি Teramachi এবং Shinkyogoku শপিং আর্কেডের মধ্যে।এখানে মন্দিরের নাম Nishiki Tenmangu। দেবতার নাম Tenjin.ছোট্টর মধ্যে কিন্তু বেশ সুন্দর মন ভাল করে দেওয়া মন্দির।মন্দিরে ঢোকার মুখেই রয়েছে জাপানী রীতির সেই লাল রঙের বড় বেলুনের মত ল্যাণ্টার্ণ ।এখানে একটি প্রাকৃতিক ফোয়ারাও আছে, আর আছে একটি গরুর ধাতব মূর্তি। যাঁকে এঁরা খুব মানেন। আমাদের শিবের ষাঁড়ের মত আর কি!
আরাশিয়ামা মন্দিরের পিছনে মাউন্ট আরাশিয়ামা
এখানে মনে হল এত উন্নতি সত্বেও সাধারণ মানুষ বোধ হয় ভাগ্যবাদী এবং ঈশ্বরে বিশ্বাসী, বারবার যা দেখছি। তার কারণ এখানেও দেখলাম, সেই দেবতার সামনে কাঠের প্লেটে নিজের প্রার্থনা জানানোর ব্যাপার। কেউ কেউ কাগজেও লিখছে।কেউ ইংরাজী, কেউ জাপানী বা অন্যভাষায়।মনে হয় দেবতা বহু ভাষাভাষী। যে যা ভাষায় লিখতে চাইবে বলবে, দেবতা সব বুঝতে পারেন।এই তেঞ্জিন দেবতা হলেন আসলে, প্রধানতঃ পরীক্ষায় সাফল্যের দেবতা । কাজেই পরীক্ষার সময় এনার কাছে ভীড় বাড়ে।একেবারে ঠিক আমাদের দেশের মতই ব্যাপার। ছেলেমেয়েদের পরীক্ষার আগে অনেক মন্দিরেই মায়েদের ভিড় বাড়ে।তাই ছোট জায়গায় হলেও এনার ভাগ্য ভালই।যাঁরা যাঁরা নিশিকির বাজারে আসেন, তাঁরা সবাই এঁর দর্শন করেই যান।
এখানে আলাপ হল এক জাপানী ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার সঙ্গে। ওনারা এখানে প্রায়ই আসেন। এখানে মানত করা থেকে নাকি ওনাদের অনেক প্রার্থনা পূরণ হয়েছে। দেবতা যে খুব জাগ্রত সেটা ওঁরা বোঝাচ্ছিলেন। আসলে বুঝলাম দেবতারা মানুষের ভক্তি আর বিশ্বাস দিয়েই তৈরী। সারা পৃথিবীতেই তাই।
🍂
পরদিন সকালে ঝকঝকে রোদ।আমরা সকালে কিয়োটো স্টেশন থেকে JR Lineএর ট্রেনে মাত্র কুড়ি মিনিটের সুন্দর এক ট্রেন যাত্রায় এলাম আরাশিয়ামা স্টেশনে।
একটা ব্যাপার, সারা জাপানে ইংরাজী অচ্ছ্যুৎ হলেও, স্টেশনে অনেক জায়গাতেই ইংরাজী আছে। কোন কোন জায়গায় তাও নেই, অবশ্য এমনও আছে। তখন জিজ্ঞাসা করা ছাড়া গতি নেই।সরকারী ব্যাপারে তো ৯০% জাপানী ব্যবহার হয়।এমনকি মোবাইল বা গুগলও জাপানীতেই দেখায়। ফলে ম্যাপ দেখার বা হঠাৎ কিছু দেখারও অসুবিধা হয়।আমাদের মত পর্যটকদের জন্য দর্শনীয় স্থান, মন্দির, মিউজিয়াম ইত্যাদিতেও ইংরাজী দিলে ভাল হত। তাও নয়- শুধু “জাপানীজ’।তবে স্টেশনে ব্যবস্থা ওদের খুব ভাল। ধূমপান নেই, চলমান হকার নেই , ভিখারী নেই।ধুমপানের জন্য ওদের রাস্তায় আলাদা ক্ষেত্র করা আছে দেখেছি। সেখানে সবাই এসে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়ে চলে যায়। বড় বড় এস্ট্রে রাখা আছে। সেগুলো পরিষ্কারও হচ্ছে, ঠিকমত।
তবে চীন আর জাপানে আমাদের মত ইংরাজী প্রীতি যাদের, তাদের বেশ অসুবিধা এটা বুঝেছি। সবচেয়ে বড় কথা ওরা তো অনেক সাধারণ কথা যেগুলো আমরা ভাবি, এগুলো তো সারা পৃথিবীই হয়ত বোঝে, সেগুলোও ওরা বোঝে না। সেগুলোরও ওদের জাপানী প্রতিশব্দ আছে।ওরা tsukue বলে টেবল কে আর Jōyō বলে চেয়ারকে; তা ওরা আমাদের কথা কি বুঝবে!
আরাশিয়ামা, স্টেশন হিসাবে খুব বড় নয়। বাইরে বেরোলাম। বেশ রোদ। চারিদিক দুপুরের ফাঁকা শূন্যতায় ভরে আছে। লোকজন বেশি নেই। অনেকটা খোলা চত্বর। ডাকা হল ট্যাক্সি। কাছেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম তেন্রুজি মন্দিরে। তেন্রুজি (Tenryuji) মন্দির আসলে একটি Zen মতের মন্দির। এই জেন হল মহাজান বৌদ্ধদের একটি চর্চা। এই মতাবলম্বীরা বেশি পূজা আচ্চার থেকে ধ্যান(Meditation) এবং মনঃসংযোগ ইত্যাদির উপর বেশি জোর দেন।তাই এনাদের মন্দিরে মূর্তির আধিক্য থাকে না।
আরাশিয়ামা মন্দিরের প্রবেশপথ
এই মন্দিরটি পশ্চিম কিয়োটর আরাশিয়ামা অঞ্চলের জেন মতাবলম্বীদের সবচেয়ে বিখ্যাত বা শ্রেষ্ঠ মন্দির।এটি নাকি জাপানের প্রথম জেন মন্দির।
মন্দিরে প্রবেশপথ থেকে বেশ কিছুটা ভিতরে মন্দির। আর মন্দিরটা একটি ব্যস্ত রাস্তার উপরে। তবে ব্যস্ততাটা বেশি এই দর্শনার্থীদেরই ভিড়ের জন্য। রাস্তার পাশে বেশ কিছু খাবার ও অন্যান্য জিনিসের দোকান রয়েছে।ভিতরে ঢুকতে গেলে অনেকটা দূরত্ব, সুন্দর পরিচ্ছন্ন পাথরে বাঁধানো রাস্তা দিয়ে পেরোতে হয়।রাস্তার দুপাশে পাথর ছড়ানো বেশ ছবির মত দেখতে।তার পাশে রয়েছে দু দিকেই সবুজ গাছের সমারোহ।পিছনে দেখতে পাচ্ছি সুউচ্চ সবুজ মাউন্ট আরাসিয়ামা।
এর পর এগোতে গেলে টিকিট কাটতে হয়। বেশ চড়া দামের টিকিট। আর এই টিকিট গুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্যাশে কিনতে হয়। এটাই সমস্যা।
এখান রয়েছে সম্রাট Go Saga (রাজত্বকাল 1242-46) Kameyama (রাজত্বকাল1260-74) এর সমাধি।
মন্দিরে যা দেখতে পাচ্ছি ,সমস্তটাই কাঠের। এর ফলে এই সমস্ত জায়গা গুলোতে , সে মন্দির বা সম্রাটদের রাজপ্রাসাদ যাই হোক না কেন , বার বারই আগুন লেগেছে, এবং ভস্মীভূত হয়ে গেছে।
আমরা জুতো খুলে প্রবেশ করলাম মন্দিরে। তবে মন্দিরে যেতে গেলে আমাদের লম্বা এক ঘোরানো করিডোর পথের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুটা যেতে হল। গিয়ে দেখি একটি বিশাল ফাঁকা ঘর।ঘরের চার পাশ দিয়ে প্রদক্ষিণ করার মত কাঠের বারান্দা রয়েছে। করিডোরের পাশে ও চারিদিকে সুন্দর সাজানো বাগান রয়েছে।করিডোরের হাঁটার জায়গায় সুন্দর মাদুর বিছানো আছে। তার উপর দিয়েই হাঁটতে হয়। এখানে সব জায়গাতেই বাগান এবং তাতে সুন্দর সুন্দর গাছের সমারোহ যে কোন দর্শনার্থীর মন কেড়ে নেবেই।
চলুন এগোই মন্দিরের পথে। সঙ্গে থাকুন আপনারা।
ক্রমশঃ-
0 Comments