তৃতীয় ভাগ - দ্বারকা পর্ব
৩৬তম পর্ব
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী
রুক্মিণী সাধারণত ধীর, সংযমী। তাকে এতখানি আবেগতাড়িত হতে দেখে শ্রীকৃষ্ণের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তাঁর অজান্তে হয়তো মহাপ্রলয় ঘটে গেছে। কৃষ্ণ স্তব্ধ থেকে আবার সচল হলেন। তিনি দ্রুত রাজ সভাগৃহে উপস্থিত হলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন বলরাম, সাত্যকি, কৃতবর্মা এবং অন্যান্যরা অবনতমস্তকে বসে আছেন। কৃষ্ণ জিজ্ঞেস করলেন "অগ্রজ, যজ্ঞের অগ্নি কি এখনো পর্যন্ত প্রজ্জ্বলিত হয়নি? সামগানের কোন ঋক মন্ত্র ধ্বনিত হচ্ছে না?"
সাত্যকি অবনতমস্তকে বললেন "এক নিদারুণ দুর্ঘটনা ঘটে গেছে যা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। দ্বারকা ঋষিদের অভিশাপগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল সায়াহ্নে মুনি-ঋষিরা দ্বারকা ত্যাগ করে চিরকালের জন্য প্রস্থান করেছেন। এমনকি তারা যাবার সময় এই কথা বলে গেছেন যে ভবিষ্যতে আর কখনো তাঁরা দ্বারকাতে উপস্থিত হবেন না"।
সাত্যকির মুখনিঃসৃত এই কয়েকটি বাক্য শুনে কৃষ্ণ আর্তনাদ করে উঠলেন। তিনি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। এতদিনের পরিশ্রমে তিল তিল করে যে বিশাল দ্বারকা নগরী গড়ে তুলেছিলেন আজ সেই নগরী ঋষিদের অভিশাপগ্রস্থ হয়েছে। কৃষ্ণ উত্তেজিত হয়ে জানতে চাইলেন "আপনারা সত্যি কথা বলুন, ঋষিরা কেন এই অভিশাপ দিয়ে গেলেন"।
কৃষ্ণের উত্তেজনা প্রশমন করে বলরাম স্থিতধী কণ্ঠস্বরে বললেন "গতকাল যদু বংশের কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক এক যুবককে তার পেটের উপরে একটি মুষল বেঁধে অন্তসত্বা নারীর সাজে সজ্জিত করে আগত মুণি-ঋষিদের কাছে যেয়ে প্রশ্ন করেছিল 'আপনারা তো ত্রিকালজ্ঞ, সকলের ভূত ভবিষ্যৎ সব বলতে পারেন। আপনারা বলুন তো এই নারীর গর্ভস্থ সন্তান কি এবং কখন প্রসব করবে'? মুণিঋষিরা যোগধ্যানে জানতে পারলেন এই তঞ্চকতা। তাঁরা অগ্নিশর্মা হয়ে বলেছেন এই নারী কোন সন্তান প্রসব করবে না, তার পরিবর্তে একখানি মুষল প্রসব করবে যে মুষলের সাহায্যে সমগ্র যদুবংশ ধ্বংস হবে।"
সমগ্র ঘটনা শুনে কৃষ্ণ উত্তেজনা প্রশমন করে জিজ্ঞেস করলেন "অগ্রজ, বলুন সেই দূর্বিনীত পুরুষটি কে বা তার সাথে কারা ছিল? তাদেরকে চরম শাস্তি দিতে হবে।" কৃষ্ণের সেই কথা শুনে বলরাম বললেন রাজসভার প্রবীণেরা তাদের এই প্রগলভতা ও হঠকারিতাকে ক্ষমার চক্ষে বিবেচনা করেছেন। কারণ মুণিঋষিদের অভিশাপ তো ব্যর্থ হবার নয়। এক্ষেত্রে অহেতুক তাদের শাস্তি দিয়ে কোন লাভ হবে না"।
🍂
অবশেষে কৃষ্ণের পীড়াপীড়িতে বলরাম বললেন "সেই দূর্বিনীত যুবকটি তোমার পুত্র শাম্ব। চরম শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিলেও ঋষিদের এই অভিশাপ বাণী ব্যর্থ হবে না। এখন তুমি বলো কিভাবে এই যদুবংশকে নিশ্চিহ্ন হবার হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে? তিনি বিষন্ন স্বরে বললেন আমি জানিনা এই অবক্ষয় কেমন করে দূর করা সম্ভব। একটি জাতি যখন নৈতিকতার দিক থেকে ক্রমশ পঙ্কিল আবর্তে নেমে যায় তখনই সেই জাতির জীবনে অন্ধকার উপস্থিত হয়। দ্বারকাবাসীদের কাছে আজ সেই ভয়ংকর মুহূর্তটি উপস্থিত হয়েছে"।
এদিকে ঋষিদের অভিশাপ বাণী শুনে উচ্ছৃঙ্খল যুবকেরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রাজসভায় ফিরে এসে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করার পরে মহারাজ উগ্রসেন প্রবীণ যাদব নেতাদের সাথে আলোচনা করে তাদেরকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই মুষলটিকে সমুদ্রে তীরে নিয়ে যেয়ে ধ্বংস করতে হবে। মুষলটিকে সম্পূর্ণ ঘর্ষন করে সমুদ্রের জলে বিসর্জন দিলে হয়তো বা ঋষিদের অভিশাপকে এড়ানো যাবে। তাঁদের উপদেশমত উচ্ছৃংখল যুবকেরা সেই মুষলটিকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে যেয়ে ঘর্ষণ করে যখন প্রায় অতি ক্ষুদ্র অংশে পরিণত করেছিল তখন তাকে সাগরের জলে ভাসিয়ে দেয়। তারা জানতো না যে এই অতি ক্ষুদ্রাংশ থেকেই যাদব বংশ ধ্বংস হবে। বাস্তবে সেই ঘটনাই ঘটেছিল। মুষলের সেই ক্ষুদ্রাংশ একটি মাছের পেটে ধরা পড়ে এক ধীবরের জালে। সেই ক্ষুদ্রাংশটি এক ব্যাধ নিয়ে যেয়ে তীরের ফলা তৈরি করে। আর মুষলের ঘর্ষণজনিত গুঁড়ো থেকে সমুদ্রের জলে নলখাগড়ার উৎপত্তি হয়। পরবর্তীকালে যাদবেরা পরস্পর আত্মকলহে লিপ্ত হয়ে
কৃষ্ণ হতাশাগ্রস্ত হয়ে বললেন "অগ্রজ, ভুলে যাবেন না এই দ্বারকাপুরী এবং যাদবদের এই নব্য যুবকেরা আমাদের দ্বারাই সৃষ্ট। এই দ্বারকা চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে গেলে কিভাবে আমি তা প্রত্যক্ষ করব? আমি চাই সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা দেখার আগেই যেন আমি ইহলোক ত্যাগ করতে পারি। সমগ্র ঘটনাবলী আমার হাতের বাইরে চলে গেছে। আমি যদি গতকাল পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রামের জন্য না যেতাম তাহলে হয়তো বা এই ভয়ংকর অভিশাপ থেকে দ্বারকাবাসীদের রক্ষা করতে পারতাম"। শেষ চেষ্টা হিসেবে শ্রীকৃষ্ণ স্থির করলেন তিনি ছদ্মবেশে দারকার পথে পথে ঘুরে লক্ষ্য করবেন কিভাবে এই অবক্ষয় শুরু হয়েছে।
তিনি একাকী সুষুপ্তিমগ্ন দ্বারকার পথে পদব্রজে যেতে যেতে লক্ষ্য করলেন দ্বারকার উচ্ছৃংখল যুবকেরা রাজপথে বিপথগামী নারীদের সাথে অশালীন আচরণে মত্ত। সুরার বিপনিগুলিতে মদ্যপ ব্যক্তিরা রসালো ভাষায় শাম্বের কাহিনী নিয়ে আলোচনা করছে। তিনি চিন্তা করলেন কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যে সকল যাদব সেনারা নিহত হয়েছিল তাদের যৌবনবতী স্ত্রী, কন্যাদের অনেকেই ব্যভিচারিনী হয়ে উঠেছিল। প্রশাসন তাদের দিকে দৃকপাত করেনি। তাদের জারজ সন্তানের আজ দ্বারকার পথেপ্রান্তরে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে বেড়াচ্ছে। এই প্রথম কৃষ্ণের মনে হল জীবন যুদ্ধে তিনি হেরে গেছেন।
কৃষ্ণ কেমন করে এই সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের হাত থেকে যাদবকুলকে রক্ষা করবেন এই চিন্তা করতে লাগলেন। অবশেষে তিনি বলরাম, সাত্যকি, কৃতবর্মা প্রমুখ যাদব নায়কদের সাথে শলা পরামর্শ করে রাজসভায় যেয়ে সমস্ত প্রবীণ যাদব নেতাদের মধ্যে বললেন "আমি জানি জন্ম হলে মৃত্যু অনিবার্য। এটি এমন এক ধ্রুব সত্য যাকে আমরা কখনো লঙ্ঘন করতে পারব না। জাতির ক্ষেত্রেও তারই পুনরাবৃত্তি ঘটে। মৃত্যু পথযাত্রী মানুষকে আমরা যেমন সেবা শুশ্রুষা দ্বারা বাঁচিয়ে তোলার চেষ্টা করি অধঃপতিত জাতিকেও সেই ভাবে সারিয়ে তোলা দরকার। দ্বারকার জনমানসে এক ভয়ঙ্কর অবক্ষয়ের ভিত্তি দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়েছে। গতরাত্রে আমি তা প্রত্যক্ষ করেছি"।
তাঁর এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সমবেত সভাসদগন কৃষ্ণকে বললেন "কৃষ্ণ, আপনি বলুন কিভাবে এই অসম যুদ্ধে আমরা জয় লাভ করব। দ্বারকাতে যখনই কোন বিপদের সূচনা হয়েছে আপনিই তখন আমাদের রক্ষা করেছেন"। শ্রীকৃষ্ণ বললেন "অবিলম্বে দ্বারকার সমস্ত সুরার বিপনী গুলি বন্ধ করে দিতে হবে। মদ্যপ যুবকেরা এই সুরার বিপনী থেকে সুরা গ্রহণ করে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছে এবং তারই ফলস্বরূপ এই উচ্ছৃঙ্খলতা ও ব্যাভিচার এক চরমসীমায় পৌঁছে গেছে।" কৃষ্ণের প্রস্তাবে সভাসদগন স্থির করলেন অবিলম্বে সুরার বিপনীগুলিকে বন্ধ করে দেওয়া দরকার এবং নির্দেশনামা জারি করা হবে আজ থেকে দ্বারকায় কেউ সুরা পান করলে তাকে কঠোর শাস্তি গ্রহণ করতে হবে”। সূরার বিপনীগুলি বন্ধ হয়ে গেছে, কুঞ্জবন গুলিতে বসেছে কঠিন পাহারা। যুবক যুবতীরা আর অবৈধ সংসদে মত্ত থাকতে পারছে না ফলে তাদের মধ্যে বিক্ষুব্ধতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু কৃষ্ণের ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতে পারছে না।
পরবর্তী অংশ ৩৭তম পর্বে..............
0 Comments