জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদপর্ব- ১২/স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ১২

স্বপন কুমার দে

অফিসের এর ওর মুখ থেকে কিছু কিছু কথা শুনে এবং রূপসার কথাবার্তার ধরনে সম্পূরক বুঝতে পারল, রূপসা আর অসীম অনেকদিনের পুরানো বন্ধু। মাঝখানে অনেকদিন তাদের দেখা হয়নি, কোনো যোগাযোগও ছিল না। অসীম মাস্টার ডিগ্রি করতে রাজ্যের বাইরে গিয়েছিল, তারপর ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি এবং উত্তরবঙ্গে টানা পাঁচ বছর পোস্টিং। অসীমকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল রূপসা। এখন আবার হঠাৎই তারা পাশাপাশি এসে পড়েছে।

রূপসার কাছ থেকে সম্পূরক শুনেছে যে,তাদের দুই পরিবারও খুব পরিচিত এবং পারস্পরিক যাতায়াত ছিল। কাজেই এতদিন দেখা না হওয়াটাই আশ্চর্যের ছিল। সেই অভাবটা দু'জনে পুষিয়ে নিচ্ছে। টিফিন টাইমে সকলে একসঙ্গে টিফিন খাওয়াটাই রেওয়াজ,  এখন দেখা যাচ্ছে প্রায় দিনই টিফিনের সময় অসীম রূপসাকে নিজের কেবিনে ডেকে নিচ্ছে। বাড়ি ফেরার সময়ও বেশিরভাগ দিনই তাই।

ব্যাপারটা সম্পূরকের কাছে ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে। কাউকে কিছু বলতে পারছে না, তার মনে হচ্ছে অন্য সকলে ব্যাপারটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। কেউ উপভোগ করছে, কেউ বা দয়া দেখাতে চাইছে। অযাচিতভাবে তার সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে চাইছে। ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহে ফেটে পড়ে কিন্তু তার ভীরু মন ভদ্রতার আড়াল খোঁজে। তথাপি কখনও কখনও সাহসী হতে ইচ্ছা করে। তার অপমানিত সত্তা অধিকার রক্ষার জন্য মরিয়া হয়। আজ কাজের ফাঁকে রূপসার টেবিলে গেল সম্পূরক। ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে সম্পূরককে দেখল, কয়েক সেকেন্ডের জন্য একদৃষ্টে চেয়ে রইল, তারপর মৃদু হেসে বলল," কী ব্যাপার?"
" আজ আমরা একসঙ্গে বাড়ি ফিরবো রূপসা।তোমার সাথে কথা আছে।" কিছুটা নীচুস্বরে কথাটা বলে সেখান থেকে নিজের টেবিলে ফিরে গেল সম্পূরক।

ছুটির পর অসীম যথারীতি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে রূপসার কাছে হাজির। একসঙ্গে যাবার জন্য তাড়া দেয়। রূপসা জানিয়ে দেয়, আজ তার সঙ্গে যাওয়া হবে না। আজ তার অন্য কাজ আছে।
" ছুটির পরে কী এত কাজ থাকে রে তোর? কারও সঙ্গে অ্যাফেয়ার ট্যাফেয়ার আছে নাকি?"
" থাকতেই পারে। সেটা জেনে অন্যের কী লাভ?"
" না থাকতে পারে না।" কথাটা বলেই সংযত হয় অসীম। পরে বলে, " ঠিক আছে, আজ আমি একাই যাচ্ছি, কিন্তু অন্যদিন একসঙ্গেই ফিরবো।"

🍂

কফি খেতে খেতে সম্পূরক সেই অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটাই করে বসল রূপসাকে, " অসীম কি তোমার শুধুমাত্র বন্ধু, না আরও কিছু?"
প্রশ্নের আঘাতে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল রূপসা। কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। তবে সে কোনো কপটতা করল না।সোজা সাপটা উত্তর দিল," এই প্রশ্নটা আমার মধ্যেও জেগেছে। আমি ঠিক উত্তর পাইনি। তুমি তো আমার খুব ভালো বন্ধু, তুমিই বলে দাও না।'
একটু থেমে বলল," সবদিনই আমি আর অসীম ভালো বন্ধু ছিলাম। এর বাইরে সে কোনদিনই কোনও কিছু দাবী করেনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে যেন পুরানো হিসাব নিতে এসেছে। কাল তার কথা শুনে মনে হয়েছিল, সে যেন কিছু বলতে চায়। তার চোখ মুখ হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল, যেটা তার চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নয়। তবে সে কিছু বলতে পারেনি। "

রূপসার হাত ধরল সম্পূরক, কম্পিত স্বরে মুখ থেকে কথা বেরিয়ে এল," আমি যে তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছি রূপসা! সেই স্বপ্ন ভেঙে গেলে তার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাব আমি। এখন যে আর পিছিয়ে আসার রাস্তা নেই। কেন তুমি বলতে পারছ না যে, তুমি আমাকে ভালোবাসো? সেটাই বলে দাও। এই দোটানার মধ্যে আমি যে পারছি না।" মুখের ভাষা আর মুখমন্ডলের অস্বাভাবিকতা দেখে চমকে গেল রূপসা। সে সম্পূরকের কাঁধে তার ডান হাতটা রেখে বলল," আমাকে কিছুটা সময় দাও সম্পূরক।"

                         * * *
সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে সম্পূরক জানতে পারল যে, অন্যান্য দিনের মত তাকে আর মন্টিকে পড়াতে হবে না, টিউটর পাওয়া গেছে। ইউনিভার্সিটির কারেন্ট স্টুডেন্ট, ম্যাথে এম এস সি করছে। নেহাৎই অর্থের প্রয়োজন, তাই টিউশন পড়াতে হচ্ছে। এদের পারিবারিক বন্ধু মণীশবাবুই খোঁজ খবর নিয়ে তাকে পাঠিয়েছেন। শহরের সম্ভ্রান্ত স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে মন্টি। সেইরকম স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখে একজন ভালো টিউটর খুঁজে পাওয়ার জন্য এ বাড়ির লোকজন অনেককে বলেছিল, তাই। মেয়েটি আজ বিকেলে এসেছিল। নাম, চন্দ্রমল্লিকা সামন্ত। সপ্তাহে তিন দিন দু'ঘণ্টা করে পড়াবে, মাসে  তিন হাজার টাকা।
মা বললেন, " মেয়েটা খুব মিষ্টি রে। যেমন কথাবার্তা তেমনি মধুর স্বভাব। মন্টিকে নিয়ে আধ ঘণ্টা বসেছিল। মন্টিরও খুব পছন্দ হয়েছে।"

সবেমাত্র অফিসের পোশাক ছেড়ে বাড়ির পোশাক পরে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসল সম্পূরক। গরম গরম পাঁপড় ভাজা আর মুড়ি চিবোতে চিবোতে টিভির সুইচটা অন করে দিল। বৌদি গরম চা নিয়ে এসে সম্পূরকের পাশে বসল। বলল," কী ব্যাপার ভাই, আজ কেমন যেন আনমনা দেখাচ্ছে।"
" না, তেমন কিছু নয়। মন্টির নতুন ম্যাডাম সম্পর্কে মা যে কথাগুলো বলে গেল সেটাই ভাবছি। বলছি, এতটা মাতামাতি করার কিছু নেই। আর কিছুদিন যেতে দাও, তারপর বলবে।"
" কেন, তুই একথা বলছিস কেন? বড় বৌমাকে জিজ্ঞেস কর্ না, দেখ কী বলে? কী বলো বৌমা?"
" হ্যাঁ মা, আমার তো ভালোই মনে হল।" বড় বৌমা শাশুড়িকে সাপোর্ট করে।
টিভির সাউন্ডটা একটু কমিয়ে সম্পূরক বলল," আগের বারের টিউটর নিয়েও তোমরা অনেক কথা বলেছিলে। এখন কী মনে হয়? প্রথম প্রথম সবাই ওরকম একটা গুড উইল তৈরি করতে চায়। আর তাছাড়া, আমরা যতক্ষণ না মন্টির রেজাল্ট দেখতে পাচ্ছি, ততক্ষণ কিছু বলা উচিত নয়।"

অনেক কিছু কথাই আগে থেকে বলা উচিত নয়। তবুও আমরা বলে ফেলি, অনুমান করি, আবার কখনও বিজ্ঞের মত পরামর্শ দিই। কিন্তু আমরা কে বা কাকে চিনতে পারি? হয়তো সারাজীবন ধরে কাছে থেকেও সেই মানুষটা আমাদের কাছে অচেনা রয়ে যায়। আজ যে কথা সম্পূরক বা তার মা মল্লিকা সম্পর্কে বলছে, কে বলেছে এরাই একদিন এর বিপরীত কথা বলবে না। অমরেশবাবুর মূল্যায়ন অন্যরকম। তাঁর মত, "সব সময় তাৎক্ষণিক রেজাল্ট দিয়ে সব কিছুর বিচার হয় না, তার সুদূরপ্রসারী দিকটা দেখতে হয়। এই মেয়েটি যদি সত্যিই মন্টির অংকের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে পারে তাহলে বুঝব, সে ঠিক পথেই এগোচ্ছে।"
সম্পূরক বলল," আমি এমন কী আর ভুল বললাম, বাবা? ঘুরেফিরে তুমিও তো সেই মন্টির পারফরম্যান্সের উপরই জোর দিলে।"
সম্পূরকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মা বললেন," ঠিক আছে, তোকে আর বিচার করতে হবে না। সবকিছু বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা যায় না রে বাবা,  এরজন্য আরও কিছু থেকে যায়। সেগুলো বোঝার মত অনুভূতি শক্তি থাকা দরকার। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তোর মধ্যেও এগুলো জন্মাবে। এগুলোই জীবনের অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতাই আমাদের শেখায় জীবনের ভালোমন্দ-- কোনটাকে গ্রহণ করবো, কোনটাকে বর্জন। পথের বাঁক বদল ঘটলে মানুষকেও তার সাথে মানিয়ে নিতে হয়।"

সম্পূরকের টিফিন খাওয়া হয়ে গেছল, মায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে মায়ের দিকে চেয়ে রইল। তার মনে হল, মা কি কিছু আন্দাজ করে কথাগুলো বলল, না এমনই বলা। যুক্তি খন্ডন করার কথা সে ভুলে গেল।অবোধ শিশুর মত মায়ের মুখ থেকে আরও অনেক কথা শুনতে চাইল।
মা বলে চলেছেন, " সব সময় একই পথে একই মতে আমরা চলতে পারি না।অনেক সময় পরে আমরা হয়তো বুঝতে পারি যে,ভুল রাস্তায় চলে এসেছি, তখন পথ বদল করতে হয়। প্রাচীন যুগ থেকে আজ অবধি মানুষের সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই সময়ের সাপেক্ষে মানুষের শুধু খাদ্যাভ্যাসই বদলায় নি,তার সঙ্গে বদলেছে তার চাহিদা, চিন্তা,রুচি,শিক্ষা কৃষ্টি সবকিছু। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। "

ইতিহাসের শিক্ষা আর বর্তমানের পর্যবেক্ষণ নিয়ে সম্পূরক যখন ঘুমোতে গেল তখনও তার মনে একটা প্রশ্নই বারবার আঘাত করতে লাগল সে কি ঠিক পথে এগোচ্ছে। মানুষের ভাবনার সাথে বাস্তব যদি মিলে যেত তাহলে পৃথিবীতে এত জটিলতা থাকত না। ঘুমের মাসি কী মনে করে আজ সম্পূরকের কাছে অনেক দেরিতে পৌঁছাল।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments