জ্বলদর্চি

পত্র পত্রিকার সম্পাদনা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিদ্যাসাগর /প্রসূন কাঞ্জিলাল

পত্র পত্রিকার সম্পাদনা ও পৃষ্ঠপোষকতায়  বিদ্যাসাগর

প্রসূন কাঞ্জিলাল


দ্বিশতবর্ষে বিদ্যাসাগর স্মরণ এবং শ্রদ্ধা এ প্রজন্মের বাঙালিকে করেছে ঋদ্ধ। উৎসাহিত করছে এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুগপুরুষকে জানতে এবং আত্মস্থ করতে। রক্ত-মাংসের এই ঈশ্বরের সামগ্রিক কর্মকান্ডের ক'য়েক শতাংশও যদি থাকত অনুপস্থিত, তবে জাতি হিসেবে বাঙালি যে আজ কতটা দীন থেকে যেত তা কল্পনায় আনলেই শিউরে উঠতে হয়। বিদ্যাসাগরের মতো মহামানবের জন্মের  জন্য যেমন অপেক্ষা করতে হয় ক'য়েক শতাব্দী, তেমনই যে জাতির একজন বিদ্যাসাগর থাকেন সে জাতিকে কখনই অন্ধকারের অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে হয় না।বিদ্যাসাগরের মতো ঈশ্বররা কোনো একটি বিশেষ কাজের জন্যও জন্মান না। এক জীবনে বহু কাজের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে উন্নত করার দায়িত্ব তুলে নেন কাঁধে। 

বিদ্যাসাগরের কর্মময় জীবনের অজস্র ধারার অন্যতম ছিল  তৎকালীন বিভিন্ন পত্র পত্রিকার পৃষ্ঠেপোষকতাও । পেশা নয়, তাঁর বহুমুখী কর্মকাণ্ডকে পূর্ণতা দিতেই হাতে তুলে নিতে হয়েছিল ক্ষুরোধার কলম। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বেশ ক'য়েকটি সাময়িক পত্রের দায়িত্ব তাঁকে সামলাতে হয়েছে দীর্ঘদিন। 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা', 'সর্ব্বশুভকরী পত্রিকা', 'সোমপ্রকাশ' ও 'হিন্দু পেট্রিয়ট' ছিল তাঁর এই পর্বের কর্মকান্ডের বিচরণ ক্ষেত্র। তত্ত্ববোধিনী ও সোমপ্রকাশ ছিল সেই সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী দুটি বাংলা পত্রিকা। শিক্ষিত বাঙালি সমাজে অত্যধিক প্রভাবশালী ইংরেজি পত্রিকা ছিল হিন্দু পেট্রিয়ট ।

ব্রাহ্ম সমাজের নিজস্ব সংগঠন তত্ত্ববোধিনী সভা  গঠিত হয় ১৮৩৯ সালে। ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার এবং ব্রাহ্ম সমাজের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে ১৮৪৩ সালে জন্ম হয় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। পত্রিকার সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। পত্রিকার জন্য রীতিমতো পরীক্ষা নিয়ে সম্পাদক হিসেবে অক্ষয় কুমার দত্ত মহাশয়কে নিযুক্ত করেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর । সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ,ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু ও রাজেন্দ্রলাল মিত্র। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার জন্মলগ্ন থেকে জীবনের প্রায় শেষ লগ্ন পর্যন্ত বিদ্যাসাগর ছিলেন এই পত্রিকার সাথে ওতপ্রোতভাবে ভাবে জড়িত। 
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সংক্রান্ত
কিছু মনোজ্ঞ তথ্য এবং শ্রী অক্ষয় কুমার দত্ত মহাশয়ের সাথে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের হৃদ্যতার সূচনা ও গভীরতা নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা থেকে জানা যায়-
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় যিনি যাই লিখতেন, আনন্দকৃষ্ণ বাবু প্রমুখ কৃতবিদ্য ব্যক্তিদের তা দেখে আবশ্যকমত, সংশোধনাদি করে দিতে হত। এক দিন বিদ্যাসাগর মহাশয় আনন্দ বাবুর বাড়ীতে বসেছিলেন, এমন সময় অক্ষয়কুমার বাবুর একটা লেখা সেখানে উপস্থিত হয়। আনন্দ বাবু বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অক্ষয়কুমার বাবুর লেখাটা পড়ে শুনিয়ে দেন। অক্ষয়কুমার বাবু পূর্ব্বে যে সব অনুবাদ করতেন, তাতে কিছুটা ইংরেজি ভাব থাকত। বিদ্যাসাগর মহাশয় অক্ষয়কুমার বাবুর লেখা দেখে বলে ছিলেন ,—“লেখা বেশ বটে; কিন্তু অনুবাদের স্থানে স্থানে ইংরেজী ভাব আছে।” আনন্দকৃষ্ণ বাবু, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে তা সংশোধন করে দিতে বলেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সংশোধন করে দেন। এইরূপ তিনি বার কতক সংশোধন করে দিয়েছিলেন। অক্ষয় বাবু সেই সুন্দর সংশোধন দেখে বড়ই আনন্দিত হতেন। তখনও কিন্তু তিনি বিদ্যাসাগর মহাশয়কে জানতেন না। লোক দ্বারা প্রবন্ধ পাঠানো হত এবং লোক দ্বারাই ফিরে আসত। তিনি সংশোধিত অংশের বিশুদ্ধ-প্রাঞ্জল বাঙ্গালা দেখে ভাবতেন,— এমন বাঙ্গালা কে লেখে? কৌতুহল নিবারণের জন্য তিনি এক দিন স্বয়ং আনন্দ বাবুর নিকট উপস্থিত হন এবং তাঁর নিকট বিদ্যাসাগর মহাশয়ের পরিচয় পান। আনন্দকৃষ্ণ বাবুর পরিচয়ে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সঙ্গে পরে তাঁর আলাপ-পরিচয় হয়। এর পর অক্ষয় বাবু যাহা কিছু লিখতেন, তা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দেখিয়ে নিতেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সংশোধন করে দিতেন। পরস্পরের প্রগাঢ় সৌহার্দ্য সংগঠিত হয়।
   অক্ষয়কুমার বাবুর প্রস্তাবে এবং তত্ত্ববোধিনী সভার অন্যান্য সভ্যগণের সমর্থনে, বিদ্যাসাগর মহাশয় তত্ত্ববোধিনী সভার অন্তর্গত “পেপার-কমিটীর” অন্যতম সদস্য পদে প্রতিষ্ঠিত হন। এই সূত্রে তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও সংযুক্ত হয়েছিলেন। তবে ব্রাহ্ম-সমাজের সঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোন সম্বন্ধ ছিল না। “পেপার কমিটী” বা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে সম্বন্ধ ছিল, কেবল সাহিত্যের সংস্রবে, ধর্ম্মের টানে নয় । তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করবার পূর্বে , অক্ষয় বাবুকে ও সেই সম্বন্ধে “পেপার-কমিটী”র সভ্যদিগের মতামত নিতে হত। তার একটা প্রমাণ দেওয়া হলো, “কবিপন্থীদিগের বৃত্তান্ত-বিষয়ক পাণ্ডুলেখ্য প্রেরণ করিতেছি, যথাবিহিত অনুমতি করিবেন।” তত্ত্ববোধিনী সভা,
 শ্ৰী অক্ষয়কুমার দত্ত,
১৭৭০ শক, ১৪ই আষাঢ় । “গ্রন্থ-সম্পাদক"।
“প্রেরিত প্রস্তাব পাঠে পরিতোষ পাইলাম। ইহা অতি সহজ ও সরল ভাষায় সুচারুরূপে রচিত ও সঙ্কলিত হইয়াছে। অতএব পত্রিকায় প্রকাশ বিষয়ে আমি সন্তুষ্ট চিত্তে সম্মতি প্রদান করিলাম। ইতি— “শ্ৰীঈশ্বরচন্দ্ৰ শর্মা ” “শ্ৰীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর উক্ত  পাণ্ডুলেখ্যর স্থানে স্থানে যে সকল পরিবর্তন করিয়াছেন, তাহা অতি উত্তম হইয়াছে।”
-'তারাচরণ মুখোপাধ্যায়'।
যদিও পত্রিকার পথ চলা শুরু হয় মূলত ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচার ও বেদান্ত সাহিত্য চর্চার উদ্দেশ্যে। কিন্তু অচিরেই এই পত্রিকায় ইতিহাস, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ নির্ভর বিভিন্ন লেখা প্রকাশ হতে থাকে। 

🍂

সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্তের ইচ্ছা এবং বিদ্যাসাগরের প্রেরণায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার এই পরিবর্তন সম্ভব হয়। একটা পর্যায়ে এসে সম্পাদক অক্ষয়কুমারের সাথে নিয়োগকর্তা দেবেন্দ্রনাথের নিয়মিত তর্ক-বিতর্ক ও মতান্তর ঘটেছে মূলতঃ বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ নির্ভর বিভিন্ন লেখাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিদ্যাসাগরের সমর্থন ছিল অক্ষয়কুমারের পক্ষে। এই সময় বিদ্যাসাগর এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তত্ত্ববোধিনীর পথ নির্নয় এবং গুনমান নির্ধারণে। বিভিন্ন বিষয়ে মূল্যবান প্রবন্ধ এমনকি কখনো কখনো সম্পাদকীয় ও লিখতে হতো বিদ্যাসাগরকে। ক্রমশ বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, সমাজতত্ত্বের আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশে সেই সময় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার অবদান যেমন অস্বীকার করা যাবে না, তেমনই তত্ত্ববোধিনীকে ওই উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়ার নেপথ্যে বিদ্যাসাগরের অবদানকেও স্বীকার না করার স্পর্ধাও করা যায় না।
   সাহিত্যের সঙ্গে ধর্ম্মভাব বিজড়িত দেখে এবং কোন কোন বিষয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর ঠিক মতমিল হচ্ছে না বুঝে , অক্ষয়কুমার দত্তের কিছু কাল পরেই বিদ্যাসাগর মহাশয় তত্ত্ববোধিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। দুই জন স্বাধীন-চেতা ও তেজস্বী পুরুষের মতসংঘর্ষে পরিণাম এরূপ হওয়া বিচিত্র নয়।চক্‌মকী পাথরের সঙ্গে ইস্পাতের সংঘর্ষণে অগ্নিফুলিঙ্গ নিঃসৃত হয়ই ।
  বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দত্তের সুদৃঢ় বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য উদাহরণযোগ্য।বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সমমননের এক সম্পাদককের পৃষ্ঠপোষকতাও অনিবার্য। 

 বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘তাঁহার প্রধান কীর্তি বঙ্গভাষা’। কথাটি অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পর্কেও সমানভাবে সত্য। তিনি বিদ্যসাগরের পরম বন্ধুও ছিলেন। তাঁরা দুজনই যুগপৎভাবে বাংলা ভাষা গদ্যের মজবুত ও আধুনিক ভিত্তি নির্মাণ করে গেছেন। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষা বিকশিত হয়েছে। তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ, একজন উৎকৃষ্ট চিন্তাবিদ এবং প্রথম বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী।অক্ষয়কুমার দত্ত ‘বিদ্যাদর্শন’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা বের করেছিলেন কিছুদিন।1855 সালের 17 জুলাই বিদ্যাসাগরের তত্ত্বাবধানে সংস্কৃত কলেজে একটি নর্মাল স্কুল খোলা হল। উদ্দেশ্য - বিভিন্ন জেলায় যে সমস্ত আদর্শ স্কুল স্হাপন করেছেন বিদ্যাসাগর সেই সমস্ত স্কুলের জন্য আদর্শ ও উপযুক্ত শিক্ষক তৈরি করা। নর্মাল স্কুলটি দুটি ভাগে বিভক্ত। উচ্চ শ্রেণির ভার নিলেন প্রধানশিক্ষক শ্রী অক্ষয়কুমার দত্ত। অক্ষয়কুমার দত্তকে শ্রদ্ধা করতেন বিদ্যাসাগর। দুজনেই সমবয়সী। কয়েক মাসের বড় অক্ষয় দত্ত। স্কুল প্রতিষ্ঠার আগে শিক্ষা বিভাগের অধ্যক্ষকে তাই বিদ্যাসাগর চিঠিতে লিখলেন - " For the post of Head Master of the Normal classes, I would recommend Babu Akshay Kumar Dutt, the well known editor of the 'Tatwabodhini Patrika'. He is one of the very few of the best Bengali writers of the time. His knowledge of the English language is very respectable and he is well informed in the elements of general knowledge, and well acquainted with the art of teaching." 

  দীর্ঘদিন অক্ষয়কুমার দত্ত তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। শারীরিক কারণে যখন পত্রিকার কাজ থেকে বিরতি চাইছিলেন তখনি বিদ্যাসাগর তাঁকে নর্মাল স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদটি দান করেন। শুধুই কি শারীরিক কারণ? সে সময় দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্যও সর্বজনবিদিত। কারণ।দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এক চিঠিতে লিখছেন--

  " কতকগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে। ইহাদিগকে এই পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের সুবিধা নাই।" এর পর পরই অক্ষয়কুমার তত্ত্ববোধিনী ছেড়ে দেন। কেউ বলে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। অক্ষয়কুমার দত্তর অন্যতম জীবনীকার, নকুড়চন্দ্র বিশ্বাস তাঁর "অক্ষয় চরিত" (1887) বইতে লিখেছেন নর্মাল  স্কুলের কাজ পেয়ে অক্ষয়কুমার বিদ্যাসাগরকে বলেছিলেন "তাহলে বাঁচি।"  যদিও দ্বিমত রয়েছে। শ্রদ্ধেয় শ্রী আশীষ লাহিড়ী মহাশয় তাঁর "আঁধার রাতে একলা পথিক" বইতে অক্ষয়কুমারের এই মতামতকে খণ্ডন করে অক্ষয়কুমারের আরেক জীবনীকার মহেন্দ্র রায়ের বিবরণকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অক্ষয়কুমার জীবিত থাকা কালেই প্রকাশিত হয় মহেন্দ্র রায়ের "বাবু অক্ষয়কুমার দত্তের জীবনবৃত্তান্ত"(1887)। সেখানে মহেন্দ্র রায় লিখেছেন তাঁর পড়াশুনার ব্যাঘাত হবে বলে মাসিক তিনশ টাকা মাইনের এই পদ নিতে অস্বীকার করেছিলেন অক্ষয়কুমার। কিন্তু বিদ্যাসাগর যেহেতু আগেই চিঠি লিখে শিক্ষাধ্যক্ষের অনুমতি আদায় করেছিলেন, বিদ্যাসাগরের মর্যাদার কথা ভেবে কিছুটা নিমরাজি হয়েই অক্ষয়কুমার এই পদে যোগদান করেন। তবে বেশিদিন এই কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করতে পারেননি তাঁর শিরঃপীড়ার জন্য। বারবার অজ্ঞান হয়ে যেতেন। 1858 সালে তাই ছেড়েও দেন শিক্ষক-শিক্ষণ স্কুলের অধ্যক্ষের পদ। নিজের পড়াশোনা, লেখালিখির প্রতি মনোযোগী হন তিনি।
 
১৮৫০ সালে পন্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় বিদ্যাসাগর শুরু করেন এক সাময়িকী - 'সর্ব্বশুভকরী' পত্রিকা। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন মোতিলাল চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু আসলে পত্রিকার কান্ডারী ছিলেন দুই পন্ডিত - ঈশ্বরচন্দ্র এবং মদনমোহন। এ পত্রিকা মূলত বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার সম্পর্কিত ভাবনা চিন্তা প্রতিফলনের মাধ্যম ছিল। যদিও মাত্র ক'য়েকটি সংখ্যার পর পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় অজানা কারণেই । কিন্তু অল্প ক'য়েকটি সংখ্যাতেই বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার বিষয়ক অসংখ্য লেখা শিক্ষিত বাঙালি সমাজকে করেছিল যথেষ্ট প্রভাবিত। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালি সমাজের পাশাপাশি প্রাচীনপন্থী গোঁড়া সমাজপতিদেরও আলোড়িত করেছিল এই পত্রিকা।

১৮৫৮ সালে বিদ্যাসাগর শুরু করলেন সোমপ্রকাশ পত্রিকা। তাঁর বন্ধু ও সহকর্মী দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ ছিলেন পত্রিকার সম্পাদক। কিন্তু পত্রিকা প্রকাশের প্রাথমিক পরিকল্পনা এবং আত্মপ্রকাশ - সবটাই বিদ্যাসাগরের হাত ধরে। একটি সূত্রে জানা যায় যে, এ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার সমস্ত লেখাই নাকি  বিদ্যাসাগর নিজে লেখেন। পরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সম্পাদনার দায়িত্ব অর্পণ করেন দ্বারকানাথকে। দ্বারকানাথের সম্পাদনা ও বিদ্যাসাগরের সক্রিয় সহযোগিতায় সোমপ্রকাশ হয়ে ওঠে বাংলার প্রথম শ্রেণীর সংবাদ সাময়িকী। বিদ্যাসাগরের সাথেই সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা করতেন দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ। দ্বারকানাথের গ্রামের বাড়ি চব্বিশ পরগনার চাংড়িপোতায় (অধুনা সুভাষগ্রাম) একটি মুদ্রণযন্ত্র বসিয়ে ছিলেন তাঁর পিতা। তাই ১৮৬২ সালে মাতলা রেল ( শিয়ালদহ-ক্যানিং ) চালু হবার পর সোমপ্রকাশ প্রকাশিত হতে থাকে চাংড়িপোতা থেকেই। বিদ্যাসাগরের প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনা এবং উদ্যোম আর দ্বারকানাথের মুদ্রণযন্ত্র ,আর্থিক সঙ্গতি ও স্বচ্ছ সামাজিক, রাজনৈতিক চেতনা সোমপ্রকাশকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যে, বিভিন্ন বিষয়ে জনমত গঠনে অতি প্রভাবশালী ভূমিকা গ্রহণ করে এই পত্রিকা। ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকার জারি করল ভার্নাকুলার প্রেস আক্ট । এই আইনের বিরোধিতা করে বিদ্যাসাগরের সম্মতিতেই এক বছর পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ রাখেন দ্বারকানাথ। বাল্য বিবাহ ও কৌলিন্য প্রথার বিরোধীতা করে এবং নারী-শিক্ষা ও বিধবা বিবাহের পক্ষে অজস্র লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হতো সোমপ্রকাশে।

বিদ্যাসাগরের সাথে আর যে সাময়িক পত্রের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল সেটা হিন্দু পেট্রিয়ট। ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চ ও মধ্যবিত্ত বাঙালির নিজস্ব পত্রিকা ছিল এই সাময়িকী। পত্রিকার সত্ত্বাধিকারী ও সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ক্ষুরধার লেখনী নীল বিদ্রোহের সময় যে ভাবে কৃষকদের পক্ষে দাঁড়িয়ে বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিল তাতে অজস্র দেশবাসীর শ্রদ্ধা ও সমর্থন পেয়েছিল পত্রিকা। যদিও ব্রিটিশ শাসনের সার্বিক বিরোধিতার পরিবর্তে বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা এবং ওদশের পার্লামেন্টে আবেদন-নিবেদনের পক্ষেই সাধারণ অবস্থান ছিল এ পত্রিকার। তথাপি বিরাট অংশের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে প্রভাব ছিল হিন্দু পেট্রিয়টের। ১৮৬১ সালে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর পত্রিকার মালিকানা কিনে নিয়ে হিন্দু পেট্রিয়ট চালাতে শুরু করেন কালিপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় । ক'য়েক মাস পরে তিনি পত্রিকার দায়িত্ব সমর্পন করেন বিদ্যাসাগরকে। পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে বিদ্যাসাগর নিয়োগ করেন কৃষ্টদাস পালকে। পরে ১৮৬২ সালে এক ট্রাস্টি গঠন করে পত্রিকার নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব তাদের ওপর সমর্পন করেন বিদ্যাসাগর। সেই সময় পত্রিকার প্রভাব প্রতিপত্তি ও পাঠক সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। পরে এ পত্রিকা দৈনিকেও রূপান্তরিত হয়।  যদিও দৈনিক হিন্দু পেট্রিয়ট স্থায়ী হয়নি বেশি দিন।

সামন্ততন্ত্রের নিগড়ে বাঁধা মধ্যযুগীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন এক জাতিকে অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে টেনে তুলে আধুনিক সভ্যতার আলোয় পৌঁছে দিতে সমস্ত জীবন নিয়োগ করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আর সেই কাজ সম্পূর্ণ করতেই তাঁকে পালন করতে হয় বিভিন্ন ভূমিকা। পত্র পত্রিকার মাধ্যমে জন সচেতনতা সেই কর্মকান্ডেরই অংশ। আর সে ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অস্বীকার করার স্পর্ধা কোনো বঙ্গভাষীর অন্তত নেই।

তথ্যসহায়ক গ্রন্থাবলী:---

১- বিদ্যাসাগর, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
২- বিদ্যাসাগর, বিহারিলাল সরকার।
৩- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, সুবলচন্দ্র মিত্র।
৪- বিদ্যাসাগর জীবনচরিত ও ভ্রমনিরাশ, শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন।
৫- করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, ইন্দ্রমিত্র।
৬- বিদ্যাসাগর ও বাঙালীসমাজ, বিনয় ঘোষ।
৭- ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অ্যান্ড হিজ এলুসিভ মাইলস্টোনস, অশোক সেন।
৮- নাইন্টিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল, প্রদীপ সিংহ।
৯- সংকোচের বিহ্বলতা, গোলাম মুরশিদ।
১০- উনিশ শতকে পূর্ববঙ্গের সমাজ, মুনতাসীর মামুন।
১১- নব্যভারত (পত্রিকা), ১২৯৮ বঙ্গাব্দ।
১২- অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৮৬৮-৭০ সালের সংস্করণ..

Post a Comment

0 Comments