জ্বলদর্চি

বন টেপারি /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ১৮
বন টেপারি

ভাস্করব্রত পতি

বন টেপারি বা ফটকা হল অত্যন্ত নমনীয় কাণ্ডযুক্ত বর্ষজীবী লোমশ ক্ষুপ। ৬ - ১২ ইঞ্চি দীর্ঘ। চৈত্র বৈশাখ মাসে ধান চাষের জমিতে এটিকে জন্মাতে দেখা যায়। কোনও রকম যত্ন ছাড়াই আপনাআপনিই জন্মায়। এটি প্যানট্রপিক্যাল বাৎসরিক আগাছা। পাতাগুলো ডিম্বাকৃতি। এর ধারগুলি করাতের মত কাটা। ফুলের রং হলুদ। ফলের বহিরাবরণ ফাঁপা। অদ্ভুত গড়ন। ফুলের বহিচ্ছেদে ফল আবৃত থাকে। চারদিকে কাগজমতো আবরণ থাকে যা পাকলে বাদামি বর্ণের হয়। দেখতে অনেকটা দেওয়ালির ফানুসের মত। আকৃতিগত সাদৃশ্যের কারণে একে নাম 'চাইনিজ ল্যান্টার্ন' বলে। এই ফানুসাকৃতি ফলের বহিরাবরনের মধ্যে ছোট কুলের মতো একটি ফল থাকে। কাঁচা অবস্থায় মুখে নেওয়া যায়না, বেশ তেতো। কিন্তু পাকলে মিস্টি। তখন লাল রঙের হয়। তার মধ্যেই ছোট ছোট বীজ দেখতে পাওয়া যায়। 

টেপারিকে ইংরেজিতে বলে Cutleaf Ground Cherry, Strawberry, Pygmy Groundcherry, Camapu, Balloon Cherry, Angular Winter Cherry, Native Gooseberry, Wild Cape Gooseberry, Wild Tomato, Cape Gooseberry এবং Hogweed। স্প্যানিশ ভাষায় বলে Bolsa Mullaca, মালয়লাম ভাষায় Notinotta, Mottaampuli এবং Njottanjodiyan, কন্নড়ে Gadde Hannu, গুজরাটিতে পোপটি, পিপাট, হিন, অসমীয়াতে পোকমোউ, মারাঠীতে Chirboti, Ran popti, Nanvachivel, হিন্দিতে বন টিপারিয়া, চিরপাটি, রসভরি ইরুলা, থোলথাখালি, তামিলে Kupanti, Sodakku thakkaali, Tholtakkali, তেলুগুতেও Kupanti বলে। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়াতে Ciplukan এবং Ceplukan, মিশরে Hrankash, সুরিনামে Batoto Wiwiri, মিরুতে Nkabakabu, , গুয়ারানিতে Kamambu, ইয়োরুবাতে Koropo নামেও উচ্চারিত হয়। 

Solanaceae পরিবারভুক্ত টেপারির বিজ্ঞানসম্মত নাম Physalis minima Linn। আমেরিকার পেরু দেশে এর আদি বাসস্থান। তাই বিজ্ঞানসম্মত নাম Physalis peruviana। তবে সারা পৃথিবীতে এই গণের মোট ৫০ টি প্রজাতি বর্তমান। এর মধ্যে ভারতেই ৫ টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যায়। এই গণের বেশ কয়েকটি প্রজাতি খাওয়ার জন্য রীতিমতো চাষ করা হয় জমিতে। 

ভৈষজ্য নির্ঘণ্টকাররা একে 'টঙ্কারী' নাম দিয়েছে। সংস্কৃতে 'টঙ্কার' অর্থ বলতে বোঝায় ধনুকে গুণটানার সময় যে টং করে আওয়াজ হয়, সেটাই। এটি ধ্বন্যাত্মক ভাষা। তেমনি ধুনুরিরা শীতকালে তুলো ধোনার সময় তাঁর যন্ত্রটিতে যে 'টং টং' ক'রে শব্দ হয়, তাও এই ধ্বন্যাত্মক ভাষা। এটিই কোন মুদ্রা অর্থাৎ টাকায় আছে বলেই তা থেকে হ'য়েছে টঙ্কা। পরে তা টাকায় পরিনত হয়েছে। তবে সংস্কৃত পণ্ডিত দের মতে এই 'টঙ্কার' শব্দটি হল অশুভ ধ্বনি। টেপারি ফুল একটা ছোট বেলুনের মত দেখতে। এর মধ্যে  থাকা বীজকোষটি তুলে হাতে বা কপালে চাপলেই একটা  অদ্ভুত ফট্ শব্দ করে ফেটে যায়। এইরকম শব্দ হয় ব'লেই এর নাম 'টংকারী'। 

এই 'ট্যাপা' শব্দটা বাংলাদেশে মাছের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতিতে একপ্রকার মাছ রয়েছে যাঁদের পেটে হাওয়া ভর্তি থাকে। একটু জোরে চাপ দিলেই সশব্দে ফেটে যায়। এই মাছগুলি নদীতে জোয়ার আসার আগেই ভেসে ওঠে। তাই লোকজনকে বলতে শোনা যায় 'ট্যাপা ভাসে, জোয়ার এলো'। নদীর কর্কট মাছের মুখে ফুঁ দিলেও পেটটা ফুলে ওঠে। তখন পেটে চাপ দিলে ফট করে ফেটে যায়। 

ষোড়শ শতকের সংগ্রহ করা একটি ভাবপ্রকাশ গ্রন্থতে টেপারি সম্পর্কে লেখা হয়েছে --- 
'টংকারী বাতজিৎ তিক্তা শ্লেষ্ময়ী দীপনী লঘুঃ। 
শোথোদর ব্যথা হন্ত্রী হিতা পীঠবিসর্পির্ণাম্'॥
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য এটির অর্থ করেছেন, 'টংকারী বা টেপারি, এটির দ্রব্যশক্তি এমনি যে, এর দ্বারা বাতবিকার দূর হয়, এটির ডাঁটা পাতার রস তিক্ত, কিন্তু শ্লেষ্ম বিকার দূর করে, পাচকানিকে দীপ্ত করে, পাকে লঘু, এর রোগ নিরাময়শক্তি শোথ, উদর ও উদরে এবং শরীরের অন্যত্র বাতবিকারে যে ব্যথা যন্ত্রণা সেটা দূর হয়। বিশেষ ক'রে পীঠবিসর্পজনিত ব্যথা দূর হয়। এই পীঠবিসর্প সংজ্ঞাটি তখনই প্রযুক্ত হবে যখন কোন কারণে পীঠ অর্থাৎ পা যদি বিসর্পিত হয়, এর প্রধান উপসর্গ' হ'লো চলতে গেলেই পায়ে বল না পেয়ে সেটা যেন নেতিয়ে বা লটুকে পড়ে। এবং ক্রমশ সরু, হ'য়ে যায়, আবার চ'লতে গেলে মাঝে মাঝে ব্যথাও হয়। এই দুটি অবস্থাকে প্রচলিত ভাষায় খঞ্জ ও পঙ্গু বলা হ'য়ে থাকে; আবার এক কথায় বললে ওই দুটির একত্র পারিভাষিক নাম পীঠবিসর্প'। 

ক্ষুধা বাড়াতে ও অজীর্ণ দূর করতে, উদর রোগে, অগ্নিমান্দ্য হ'লে, শোথে, মূত্রকৃচ্ছ ও মূত্রসাদের উপশমে টেপারি গাছের নানা অংশ ব্যবহৃত হয়। ছোটনাগপুরের মুন্ডা উপজাতির মানুষেরা টেপারি পাতার রস তেলে মিশিয়ে কানে ফোঁটা দিয়ে থাকে। এতে নাকি কানের ব্যথা কমে যায়। গ্রামের দিকে আরও একটি প্রথা মেনে চলা হয়। একটা গোটা টেপারি গাছ চাল ধোওয়া জলে বেটে অল্প গরম করে নারীদের শিথিল স্তনে প্রলেপ দিলে স্তনের শিথিলতা নষ্ট করে স্তনকে সুডৌল করে তোলে।

🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. ভাস্করব্রত পতি র লেখা বন টেপারি খুব ভালো লাগলো।

    ReplyDelete