জ্বলদর্চি

সিংহপুরের সুসীমা/পর্ব- ৪১ /গৌতম বাড়ই

চিত্র - মণিদীপা দাস 

সিংহপুরের সুসীমা
পর্ব- ৪১
গৌতম বাড়ই


ছোটোমহলের সভাঘরে

ছোটোমহলে অনুরের এই ছুটে চলার মধ্যেও রয়েছে অতিরিক্ত গতি,কারণ, তাকে ছোটোমহলে বসেই সিংহ নিধনের ভবিষ্যত ছক কষে ফেলতেই হবে, রাজনির্দেশ অমান্য করবার নয় এতকালের বিশ্বস্ত সেনাপতির । বহুদিনের এই অভিজ্ঞ সেনাপতিও জানেন, রাজার মনের কথা দু- চারটি বাক্যেই নিহিত থাকে। রাজার কথাতেই স্পষ্ট, এই সিংহের প্রতি আর দীর্ঘদিন রেয়াত করা নয়, অবিলম্বে তার নিধন চাই। তাকে বধ করতেই হবে। ঝোড়ো গতিতে চলেছে সে, হাওয়ার বেগে। পেছনে কিছু অশ্বারোহীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাজার পুরস্কার ঘোষণার। তবে অনুর এই অঞ্চলে বেশি অঞ্চলে ঘোষণার আয়োজন করতে চাইছেন না, সিংহরাজ এদিকে এখনও সেভাবে আক্রমণ শানায়নি। নিজের বিপদের কথা ভেবেই। ঘোষণা হবে ছোটোমহলের পর থেকে, ছোটো- ছোটো লোকালয়ও বাদ থাকবে না। চার- পাঁচটি পরিবার থাকলেও চলবে। তবে সামান্য পশুরাজ সংহারে সেনাপতি অনুর নিজেকে জড়িয়ে সেই সিংহকে বিরাট গুরুত্বও দিচ্ছেন না। এতে বঙ্গরাজের সম্মান বৃদ্ধি হবে না। প্রজারা বঙ্গরাজকে দূর্বল ভাববেন। 

আগামীকাল ছোটোমহলে সেনাপতি অনুর ওখানকার বাছাইকরা কিছু সৈন্যকে নিয়ে বসতে চান। যদুপতিনাথ আর রামমঙ্গলচাঁদ নামক তার দুজন বিশ্বাসী আর দূর্দ্ধর্ষযোদ্ধা আছেন,  তারা তাঁর সহকারী বা উপসেনাপতিও বটে । সেই যদু আর রামের কাছ থেকেও কিছু  প্রয়োজনীয় পরামর্শ চেয়ে নিতে হবে। কারোরই একা সেই ভয়ানক পশুরাজকে খতম অভিযানে নামা ঠিক হবে না। আর অন্তঃপুরে রাজকন্যা সুসীমার কাছ থেকেও গোপন শলা- পরামর্শ তার প্রয়োজন । তাই অনুর ছুটে চলেছেন উত্তর রাঢ়ের ছোটোমহলের দিকে যতটা পারে গতি বাড়িয়ে। সন্ধ্যার মুখে পৌঁছোবেন আশা করেছিলেন তিনি। তাই সৈন্যদল নিয়ে এই ছুটে চলার মধ্যে কোনও বিরাম রাখতে চাইছেন না। বঙ্গদেশের সীমানা থেকে ঘোড়দলের ভূমি থেকে ছলকে ওঠা ধুলোয়, আর তা থেকে সৃষ্ট ধূলিঝড়ে  সব ঢাকা পড়তে চলেছে যেন। পদাতিক আর অশ্বারোহী মিলিয়ে অন্তত বঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে হাজার খানেকের ওপর সৈন্য দু-চারটি শিবির বানিয়ে এখানে ওখানে আছে। সবচেয়ে বড় শিবিরটিতে তো সুসীমারা দিনকয়েক ছিলেন। আর এই ছোটোমহলের আশপাশে ঘিরে প্রায় শ- পাঁচেক সৈন্য আর বিভিন্ন ধরণের রাজ কর্মচারী রয়েছেন। ঘোড়ার আস্তাবল, মোট টানবার জন্য গাধার দল, চাষ-আবাদ, সৈন্যদের জন্য ভাগাভাগি করে বিভিন্ন খাবারের ঘরের ব্যবস্থা, ছোটোমহলের আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ছোটোমহল রাজপ্রাসাদের মতনই এক নিরাপত্তার বেষ্টনীতে থাকা দূর্ভেদ্য দূর্গ। মনে হচ্ছে, সেনাপতি অনুর বঙ্গরাজ্যের বাইরে আর এক ছোটোরাজা। রাজাই বটে তিনি এখন। 

তবে সন্ধে গড়িয়ে গেল। রাত হয়েছে কিছুটা। সুসীমা জানত সেনাপতির অনুর আজ ফিরে আসবেনই। তাই কান খাড়া করে ছিল,  দূর থেকে কখন সেনাপতির ঘোড়ার খুরের আগমন ধ্বনি শোনা যায়। ঝড়ের মতন শব্দ শোনা যাচ্ছে, বঙ্গরাজের কন্যা ছোটোমহলের দাসদাসী কে সেনাপতির জন্য জল আর প্রয়োজনীয় সামগ্রীর ব্যাবস্থা করতে বললেন। আস্তাবলের চাকরেরা সবাই প্রস্তুত হয়ে গেল। রন্ধনশালায় তেলের প্রদীপ জ্বলে উঠলো। ছোটোমহলের ভেতরে বেশ সাড়া পড়ে গেল। সন্ধের থেকে ঝিমিয়ে থাকা ছোটোমহল কর্মচঞ্চল হয়ে উঠলো রাতে। 

সিংহবাহু আর সুসীমা বসে রয়েছেন ছোটোমহলের প্রশস্ত অলিন্দে। সেনাপতি অনুরও এসে বসলেন তাদের কাছাকাছি। সিংহসিবলী আপনকক্ষে ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রথমে বঙ্গেশ্বরের সমস্ত কুশল সংবাদ জানালেন। সেনাপতি বললেন-"  বঙ্গেশ্বর একাকীত্ব তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেনি ঠিকই, তবুও তিনি আপন অন্তঃপুরে এক নিঃসহায় অনলে দহন হচ্ছেন, এ আমি বুঝেছি প্রতিটি সাক্ষাৎকারে। প্রৌঢ় প্রধানমন্ত্রী বয়সের ভারে মন- প্রাণে শিথিল। রাজার সাথে তার সখ্যতা কোনদিনও তেমন গাঢ় নয়। রাজার অবসর কাটে একজন ঋষির সাহচর্যে। উত্তরের দেবপাহাড় থেকে তিনি এই বঙ্গদেশে এসে রাজার আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন। তার কাছে  রামায়ণ আর মহাভারতের কথা শুনে সময় কাটে। বঙ্গরাজ এখন প্রবীণ এবং ভীষণ প্রাজ্ঞ। রাজার কথা শুনে বোঝা যাবে সব, তবে কখনও রাজমেজাজে কথা বলেই ফেলেন। রাজা তো ততদিন উজ্জ্বল, যতদিন তার রাজমেজাজ থাকবে। কী বলো? তোমাদের কুশল জিজ্ঞাসা করলেন।বললাম। তিনি তো তাঁর প্রথা ভেঙে এখানে আসবেন না, তোমাদের যেতে হবে রাজমহলে। বঙ্গরাজ তোমাদের তিনজনকেই দেখতে চাইছেন চাক্ষুষে। " 

🍂

--" এখনও আসেনি সেনাপতি সেই শুভক্ষণ। আমি পিতার সাথে আমার পুত্র- কন্যাকে নিয়ে অবশ্যই দেখা করব।তবে, সেই দিনটি আমার মনেই চাপা পড়ে থাক এখন। " এই বলে সুসীমা থামলো। 

এইবার সুসীমার কাছে সেনাপতি বললেন, " রাজকন্যা তোমার সাথে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে, আমি আশা করছি তুমি সঠিক পরামর্শ দেবে, অথবা আমি তোমার পরামর্শ চাই এখন। " অনুর এ পাশে, ও পাশে তাকালেন। আর এতে সিংহবাহুর মনে হল সেনাপতি একদম একান্তে তার মায়ের কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ চায়। 

----" আমি নিদ্রায় যেতে চাই, তোমরা কথা বলো।" আসলে সিংহবাহু এখান থেকে চলে যেতে চাইছিলেন। কিন্তু অনুর আজ তাকে চলে যেতে নিষেধ করলেন। বললেন-" শোনো সিংহবাহু, আমি তোমাকে সবসময় নিজের পুত্রবৎ স্নেহ করি। মনে-মনে নিজের পুত্র বলেই ভাবি।  যদিও ঐ পশুরাজের ঔরসজাত তুমি। সেই চিহ্ন তোমার হাতে- পায়ে। তা নিয়ে বঙ্গদেশে, যদিও সে প্রবেশ করেনি সেই দেশে এখনও, তবুও রাজকন্যা সুসীমার আবির্ভাবের সাথে- সাথেই অনেক গল্প ছড়িয়ে গিয়েছে। অগাধ কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার গতিবেগ সাধারণ বাতাসের চেয়েও বেশি, দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তোমাকে ভবিষ্যতে এই বঙ্গদেশের রাজার সিংহাসনে বসতে হবে। তাই সিংহবাহু এই কথাগুলো তোমারও শুনে রাখা জরুরি, অতি প্রয়োজন। আজ আমাদের মাঝে তুমিও বসবে। রাজা আর তাঁর রাজত্ব চিরদিন ইতিহাস হয়ে রয়ে যায়। কারও ইতিহাস দীর্ঘ আর উজ্জ্বল, তেমনি কারো এক পলকের বিদ্যুৎপ্রভা বা কারোর অন্ধকারের মতন গভীরের বুনট। তোমাকে নিয়ে এক উজ্জ্বল ইতিহাসের স্বপ্ন দেখি। তুমি বসো। " সিংহবাহু এ আদেশ বা অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে পারলো না। সেনাপতি রাতের গভীরে চোখ আর কানপেতে নিরীক্ষণ করলেন তাদের তিনজনের বাইরে এই মুহূর্তে আর কোনও কান আড়ালে পাতা আছে কিনা! ধীরলয়ে কথা শুরু হল। আড়ালের আড়িপাতা কর্ণ ভীষণ ভয়ংকর! তার চেয়েও ভয়ংকর, অনুমান করে  কল্প-রটনা। সেনাপতি তার দীর্ঘ কর্মজীবনে দেখেছে, রাজপুরীর অন্দরে কেমন করে ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতা চলে। মুখ নয় মুখোশের আড়ালে অন্তঃপুরের সব রাজকর্মচারী এক একজন সহজ সরল  মানুষ নয়, ভয়ানক জীব। আর এইটি হলো রাজনীতি। অনুরের কাছে সমস্ত গোপন খবর প্রতিদিন দূতের মাধ্যমে আসে। আর এই দূতেরা পুরোটা রিলে প্রথায় ছোটোমহলে কিংবা সেনাপতি অনুরের কাছে পৌঁছে দিত প্রতিদিন। এছাড়াও  সেনাপতির আচমকা বঙ্গের রাজমহলে বিশেষ  সফরে রাজকর্মচারীরা ভয়ে তটস্থ থাকেন। এও বঙ্গরাজের সাথে সেনাপতি অনুরের গোপন শলাপরামর্শতে ঠিক হয়েছে।


পরদিন সকালে উপ- সেনাপতি যদু আর রামকে নিয়ে ছোটোমহলের সভামঞ্চে জনা পঞ্চাশেক লোকজনের সাথে সেনাপতি অনুরের সভা শুরু হল। সইবানার আচ্ছাদন ,  সবাই তার তলে বসে একমনে গভীর মনোযোগে কথা শুনছে। সেনাপতি অনুরের নির্দেশ, কোনও মতেই সিংহকে কেউ মারতে পারবে না। তার জীবিত সিংহ কিংবা তার অবস্থান চাই। মোটকথা জীবিত পশুটিকে চাই। কোথায় আর কিভাবে রয়েছে? এটাই বের করতে হবে আগে। সবাই সভা শেষে বেরিয়ে যাবার পর যদুপতিনাথ আর রায়মঙ্গলচাঁদকে সেনাপতি নিজের কাছে ডেকে নিলেন। এই দুজন তাকে চিরদিন বিশ্বাসযোগ্যতার পরিচয় দিয়ে এসেছেন। সেনাপতির অনুপস্থিতিতে তারা সবকিছু বেশ সুন্দরভাবে সামলে নেন। তার নির্দেশ কখনও অমান্য করেন না। বিশেষ করে উপ-সেনাধ্যক্ষ যদুপতিনাথ তার বিচক্ষণতা আর উপস্থিত বুদ্ধির জন্য অনুরের ভীষণ পছন্দের মানুষ। অনুর তাদের বললেন- " আমি এই ছোটোমহলের সব সেনা শিবির আজকে একবার প্রদক্ষিণ করে দলপতিদের সাথে তাদের অভাব অভিযোগ আর অন্যান্য কিছু অসুবিধা থাকলে সেটা জেনে নিতে চাই। আপনারাও আমার সঙ্গে থাকবেন। "

দশজন লোক, হয়ত দশ জায়গা থেকে রাজার সেনাবাহিনী আর কর্মচারী হিসেবে কাজে নিযুক্ত হয়েছেন। তাদের দশরকমের সমস্যা থাকবেই। রাজা আর দেশের সেবা সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে করতে গিয়ে তারা ধীরে- ধীরে সব মেনে নেন, তারপর তাদের ভাবনাচিন্তাও কখন একীকরণ হয়ে যায়। এই চিরন্তন ধারাই শত সহস্র বছর ধরে ইতিহাসে ঘটে চলেছে এবং আজও তাই ঘটে চলেছে। খাদ্যশস্যের মজুত, তাদের খাদ্যের যোগান সব ঠিকঠাক আছে কিনা রাজা খোঁজ নিলেন। তবে সন্তুষ্টির মুখ সেনাপতির নজরে পড়ল সব জায়গায়। সেনারা জঙ্গল কেটে কোথাও চাষাবাদ করছেন নিজস্ব খাদ্যের যোগান ঠিক রাখতে। উপ- সেনাপতিরা একদম ঠিকঠাক খেয়াল রেখেছেন , যাতে শুয়ে বসে থেকে সৈন্যরা অকর্মন্য না হয়ে পড়ে। গৃহপালিত পশুরাও রয়েছে মাংসের আর অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যাদির  যোগান দিতে। সেনাপতি অনুর যদু আর রামের কাজের প্রশংসা করলেন, অনেকদিন পর তার এই পর্যবেক্ষণ। আগামীকাল সূর্যোদয়ের পর যদুপতিকে সঙ্গে করে এক বিরাট রাউতদল নিয়ে তাতুলিপাহাড়ের দিকে যাবেন। রামমঙ্গল এই দিকটা সামলাবেন বাকিদের নিয়ে। সামনের বড়শিবিরেও দূত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আগামবার্তা দিয়ে। সূর্যদেবের তাপশক্তি কমে গিয়ে পৃথিবীতে সান্ধ্যকালীন সময় শুরু হবো হবো। পশ্চিমদিক রাঙা হয়ে উঠেছে। সেনাপতি অনুর ছোটোমহলের টানা  অলিন্দে সারাদিনের পর, জলাশয়ের স্নিগ্ধজলে নিজের ধুলোবালি মাখা চেহারাকে স্নানে ধৌতকরে, তরতাজা হয়ে একাকী বসে রয়েছেন। সামনের বড় ময়দানে এতক্ষণ নিপুণভাবে অনুশীলন করছিলেন সিংহবাহু। আলো কমে আসতেই, তা থেকে বিরত হয়েছে সে। সেনাপতি অনুরের এই মুহূর্তে নিকট ভবিষ্যতের এক পরিকল্পনা আঁকা হয়ে গেল। অলিন্দের বামপাশে তাকিয়ে অসহায়ের মতন কোনও সহায় অবলম্বন খুঁজে পেতে চাইছিলেন। 

পৃথিবীর আলো আর অন্ধকার দূরের সৌরশক্তির কাছে বাঁধা। কোটি- কোটি বছর ধরে সূর্যদেব পালন করে চলেছেন তার এই মহান কর্তব্য, প্রকৃতির সমস্ত শক্তির উৎস তো তিনি। রাঢ়ের বনাঞ্চলে শুক্লপক্ষের হালকা আলোর ছোঁয়াচ। শিবাদলের উল্লাস চিৎকার কানে এসে ধরা দিচ্ছে। অনুরের হৃদয়ে শতদলের পাপড়ি যেন হঠাৎ জেগে উঠলো, বামদিক হতে শিঞ্জন ভেসে এলো। সেনাপতি অনুর সেই আধো আলো - অন্ধকারে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। 

তারপর আগামী সংখ্যায় ...........

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments