জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—উগান্ডা (আফ্রিকা) লাল পাপড়ির শালুক/ চিন্ময় দাশ

চিত্র-শুভম দাস
দূরদেশের লোকগল্প—উগান্ডা (আফ্রিকা) 
লাল পাপড়ির শালুক 
চিন্ময় দাশ


উগান্ডার রাজার বাড়ি কাম্পালায়। সে দেশের রাজার একটি ছেলে জন্মেছে। ফুটফুটে বাচ্চা। একদিন এক দাসি বাচ্চাটাকে নিয়ে বাগানে বেড়াচ্ছে। এক সময় একটা সিডার গাছের তলায় বাচ্চাটাকে ঘুম পাড়িয়েছে মেয়েটি। খানিক বাদে, একটা ঈগল ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গেল বাচ্চাটাকে। 
হইহই পড়ে গেল রাজবাড়িতে কিন্তু ঐ পর্যন্তই। খোঁজখবর শুরু হোল বটে, ততক্ষণে ঈগল তো বেপাত্তা। আকাশে কোথাও তার চিহ্নটুকুও নাই। 
ঈগলের বাসা অনেক দূরে, বাদামি রঙের এক পাহাড়ে। সেখানে পৌঁছে গিয়েছে রাজার ছেলেকে নিয়ে। বাচ্চাটাকে নামিয়ে খোবলাতে যাবে, নিজেই থমকে গেল পাখিটা। আহা রে, এমন ফুটফুটে একটা শিশু! ভারি মায়া হোল পাখির। থাক, খাবো না এটিকে!
বাসায় নিজের বাচ্চাগুলোর সাথে রেখে দিল রাজার ছেলেকেও। পাখির বাচ্চাদের সাথে বড় হতে থাকল ছেলেটি। বেশ বন্ধুত্বও হয়ে গেল সকলের।
কিছুদিন না যেতেই, পাখিদের ভাষা বুঝতে শিখে গেল ছেলেটি। পাখি পশু আর ফুলেদের কত আদব-কায়দাও রপ্ত হয়ে গেল রাজার ছেলের।
একদিন দুটো ছাগলছানা তুলে এনেছে ঈগল। বাচ্চাদের নিয়ে ভোজ শুরু হবে, রাজার ছেলে বলল—খেয়ো নাগো, এরাও আমাদের বন্ধু হবে। সবাই খেলাধুলো করবো একসাথে। 
ঈগল রাজি হয়ে গেল। হাসি মুখ করে বলল—আচ্ছা, তাই হোক। 
সেদিন থেকে ছাগলছানাগুলোও পাখির বাসায় বড় হতে থাকল।
এমনিভাবে দিন কাটে। রাজার ছেলের। প্রতিদিন ছাগলছানাগুলোকে নিয়ে পাহাড়ের ধারে বেড়াতে যায়। অন্যান্য পশুপাখিদের সাথে খেলা জমে ওঠে তাদের।
দেখতে দেখতে বসন্তকাল এসে গেল। বৃষ্টিও হয়েছে কিছু। কী মিষ্টি আবহাওয়া! ফুল ফুটতে শুরু করেছে। পাহাড়ে ফুল, জঙ্গলে ফুল, জলাভূমিগুলোতে ফুল। সারা পাহাড় জুড়ে যেন ফুলেদের মেলা বসে গিয়েছে।
কত যে ফুল ফুটেছে, তার লেখাজোখা নাই। সাদা পাপড়ির বড় বড় পদ্ম, লাল আর হলুদ রঙের টাইগার লিলি, সাদা হলুদ আর বেগুনি রঙের শত শত অর্কিড। কত শত মৌমাছি আর ভোমরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে ফুলেদের ওপর! 
পাহাড়ের পায়ের কাছে ছোটখাটো একটা হ্রদের মতো। তাতে শালুক ফুটেছে। সাদা, নীল আর বেগুনি রঙ তাদের। যেদিকে তাকানো যায়, চোখ জুড়িয়ে যায়। মন ভরে যায় পুলকে। সকলেরই কী নাম, কী তাদের পরিচয়—সব জেনে গিয়েছে ছেলেটি।
একদিন এরকমই বেড়াতে নেমেছে। এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছেলেটি। হঠাৎই ধারালো পাথরে পা পড়েছে, খেয়াল করেনি। পা কেটে গিয়েছে ছেলেটির। বেশ গভীর হয়েই কেটেছে। রক্ত বেরোতে লেগেছে গলগল করে। 
এদিক ওদিক থেকে পশু পাখি সবাই ছুটে এসেছে। কিন্তু রক্ত কী করে আটকানো যায়, কারও মাথায় আসছে না। এদিকে রক্ত তো ঝরেই চলেছে!  
হঠাৎই একটা কাঠবেড়ালি এসে হাজির—সরো সবাই। সরে যাও সামনে থেকে। দেখতে দাও আমাকে।
একটা শেয়াল ব্যঙ্গ করে বলল—সরো গো সকলে। এ রাজ্যের বড় বদ্যিমশাই এসেছেন। দেখতে দাও তাকে।
টিটকিরি গায়ে মাখলো না কাঠবেড়ালি। সামনে গিয়ে, ঘাড় তুলে দেখল ঘটনাটা। লেজ উঁচিয়ে বলল—এসো তুমি আমার সাথে। আগে চলো, পা-টা জলে ডোবাতে হবে এখুনি।
কাছেই একটা জলাভূমি। তার জলে পা ডোবানো হোল ছেলের। পায়ে জল লাগায়, একটু আরাম হোল ছেলেটার। কিন্তু রক্ত বন্ধ হোল না তাতে। হ্রদের জলই লাল হয়ে যাচ্ছে তাতে।
একটা শালুক ফুটেছিল কাছেই। জল থেকে উঁচানো ফুল। তার চোখে পড়ে গল ব্যাপারটা। সে ঝটপট ছুটে এলো ছেলেটার কাছে। বলল—তাড়াতাড়ি ডাঙায় ওঠো তুমি। আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। 
সাদা রঙের শালুক। দুধের মতো ধবধবে সাদা পাপড়ি তার। নিজেই একটা বড় পাপড়ি ছিঁড়ে, কাটার ওপরে চেপে বসিয়ে দিল শালুক। 

🍂

বেশ কাজ হোল তাতে। রক্ত ঝরাটা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু শালুকের সাদা পাপড়ির রঙটা একটু একটু করে লাল হয়ে উঠতে লাগল।
কয়েকজন পাখি মিলে ঈগলকে ডেকে আনা হোল। সব দেখেশুনে, ঈগল বলল—রাজকুমার, তুমি অনেক দিন থেকেছ আমাদের সাথে। আমরা কৃতজ্ঞ তোমার কাছে। তোমাকে আমাদের ধন্যবাদ। তবে, এবার সময় হয়েছে তোমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসবার। আমাদের সৌভাগ্য,আজ ছোটর ওপর দিয়ে গিয়েছে। বড়সড় কিছু হলে, তখন আমরা কী করব? রাজার ছেলের সামান্যও ক্ষতি হয় যদি, নিজেদের আমরা ক্ষমা করতে পারব না কোনদিন। চলো, তোমাকে রাজবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। 
সকলেই সায় দিল সে কথায়। সবাইকে বিদায় জানিয়ে, রাজার ছেলে রাজবাড়িতে ফিরে চলল।
বড়সড় ডানা ঈগলের। ছেলেটিকে পিঠে চাপিয়ে, উড়ে চলল ঈগল। রাজবাড়ির দেউড়ির সামনের মাঠে পৌঁছে, চক্কর কাটতে লাগল পাক দিয়ে। সেপাই ছিল ফটকে। সে পাখিটাকে দেখতে পেয়ে গেল।
সভাসদদের নিয়ে রাজা মশাই তখন দরবারে বসেছে। সেপাই দৌড়ে এসে বলল—মাঠের উপর বড়সড় একটা ঈগল এসে মাঠের উপর চক্কর কাটছে। পিঠে ওপর একটা ছেলে। 
ভরা দরবার অবাক। হুড়মুড়িয়ে সবাই বেরিয়ে এলো বাইরে। সামনে রাজামশাই। পাখিটা ঝুপ করে নীচে নেমে এল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার সময় পেল না। ছেলেটাকে রাজার পায়ের কাছে নামিয়ে, আবার আকাশে ডানা মেলে দিল ঈগল। 
সকলেই আনন্দে আটখানা। অন্দর মহল থেকে রানিমা দৌড়ে এলো। বুকে জড়িয়ে ধরল ছেলেকে। পেছন পেছন দাস-দাসি, লোক-লস্কর সবাই ছুটে বেরিয়ে এসে। ছেলেটার নাম হয়ে গেল—ঈগল রাজপুত্র। 
ছেলের পায়ের দিকে চোখ পড়ে গেল রানির। জানতে চাইল—তোমার পায়ে কী হয়েছে, বাবা? 
রাজার ছেলে তার পাহাড় জীবনের গল্প শোনাতে লাগল সকলকে। কাহিনী শুনতে শুনতে বেলা গড়িয়ে গেল। সূজ্জিমামা চলে গেল পাহাড়ের আড়ালে।
রাজামাশাই খুব খুশি। বলল—শালুক ফুলটাই প্রাণ বাঁচিয়েছে আমার ছেলের। ধন্যবাদ দিতেই হবে তাকে।
রাজার সেনাপতিও ছিল ভীড়ের ভিতর। রাজা বলল—ব্যবস্থা করো, সকালে বেগুনি পাহাড়ে যাব আমরা। 
সাত ঘোড়ার বাহিনী সাজল। সকাল হলে, রাজামশাই চলল পাহাড়ে। অনেক দূরের পথ। বাহিনী যখন জলাভূমিটার ধারে পৌঁছল এসে, মাথার উপর পৌঁছে গেছে সূর্যদেব। রাজা শালুক ফুলকে ডেকে বলল—আমি শুনেছি সব কথা। নিজের পাপড়ি ছিঁড়ে, আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছ তুমি। গোটা রাজবাড়ি, গোটা রাজ্য তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।  
ছেলের পা থেকে তুলে, রক্তে লাল হয়ে যাওয়া পাপড়িটা রাজা এনেছিল হাতে করে। পাপড়িটাকে আবার ফুলের বুকে গুঁজে দিয়ে, রাজা বলল—আমার ছেলের রক্তে তোমার পাপড়ি লাল হয়েছে। আজ থেকে তোমার রঙ হবে লাল। তুমি চলো আমার সাথে। রাজার বাগানে থাকবে তুমি।
শালুক নিয়ে ফিরে এল রাজার বাহিনী। রাজবাড়ির বাগানে পুকুর। সেখানে রোপন করা হোল লালশালুককে। রাজা বলল—আজ থেকে যারাই দেখবে তোমাকে, কেবল লাল রঙে মুগ্ধ হবে না তারা। গোটা দুনিয়া জানবে, নিজের অঙ্গ খুইয়ে, একটি শিশুর জীবন বাঁচিয়েছিলে তুমি। অমর হয়ে থাকবে তুমি।
যারা এই গল্প পড়বে, কোনদিন লাল রঙের শালুক চোখে পড়লে, শালুক ফুলটার মহান কাজের কথাটা একবার স্মরণ কোর সবাই।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments