জ্বলদর্চি

কবি কালীকৃষ্ণ গুহ-র সাক্ষাৎকার নিলেন কামরুজ্জামান


কবি কালীকৃষ্ণ গুহ-র সাক্ষাৎকার নিলেন কামরুজ্জামান

কালীকৃষ্ণ গুহ স্বভাবে যেমন, কবিতায়ও তেমনি, অত্যন্ত মিতভাষী। বাহুল্যবর্জিত এবং আড়ম্বরহীন। তাঁর উচ্চারণ এতই বিনম্র যে কখনো কখনো মনে হয়, তিনি কথা বলেছেন নিজেরই সঙ্গে।

কামরুজ্জামান: আপনার কবিতায় আসা কীভাবে? কোন বয়স থেকে লিখছেন? 

কালীকৃষ্ণ গুহ: ইশকুল ম্যাগাজিনে লেখার জন্য নোটিশ দেয়া হতো তখন। জানি না, এখনো হয় কি না। কৌতূহলবশত সেখানে একটা কবিতা লিখে পাঠাই। নবম বা দশম শ্রেণি তখন। একটা কবিতা ছাপা হয়।

কামরুজ্জামান: আপনি তো সেভাবে বাণিজ্যিক কাগজে লেখেননি। তবে প্রায় সব লিটলম্যাগে লিখেছেন। লিটল ম্যাগ নিয়ে কিছু বলুন! 

কালীকৃষ্ণ গুহ: একসময় দেশ ও অমৃত পত্রিকায় কবিতা লিখেছি। অমৃত বন্ধ হয়ে যায়। দেশ-এ লেখা পাঠানো বন্ধ করে দিই।

লিটলম্যাগগুলির জন্যই এত কাল ধরে টিকে আছি। প্রথম জীবনে 'শতভিষা' এবং 'উত্তরসূরি' পত্রিকায় প্রধানত নিয়মিত লিখতাম আলাক সরকার ও অরুণ ভট্টাচার্যের বদান্যতায়। ভাবতে ভালো লাগছে যে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের 'পূর্বাশা' পত্রিকাতেও কয়েকটি কবিতা লিখেছি সেই ষাটের দশকের মাঝামাঝি।

কামরুজ্জামান: আপনার কবিতা চর্চার সময় হাংরি ও শ্রুতি আন্দোলন হয়েছে। আপনি কোন আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এবং কেন? 

কালীকৃষ্ণ গুহ : হাংরি'র সঙ্গে কখনো কোনো যোগাযোগ করার উৎসাহ বোধ করিনি। শ্রুতি-র বন্ধুদের খুব কাছাকাছি থাকলেও তাদের ঘোষিত তত্ত্বের/জিগিরগুলি গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।

কামরুজ্জামান : পাঠক এমনিতেই কম। তারওপর কবিতার পাঠক আরও কম--- আপনি কবিতা লেখাটি বাছলেন কেন? 

কালীকৃষ্ণ গুহ : প্রশ্নটা স্পষ্ট নয়। তবে পাঠক নেই বা কম জেনেই সবাই সব যুগে কবিতা লিখেছে! কবিতালেখা একটা আত্মপ্রকাশের কাজ। নিজেকে বারবার করে চেনার নেশার আনন্দ তাছাড়া আর কিছু পাবার নেই কবিতা লিখে।

কামরুজ্জামান : কবিতা লিখতে লিখতে বহু প্রবন্ধ লিখেছেন। স্বতস্ফূর্তভাবে না ফরমায়েশ? 

কালীকৃষ্ণ গুহ: প্রবন্ধ লিখেছি প্রধানত ফরমায়েশ পেয়ে। তবে কিছু অবশ্যই স্বতঃস্ফূর্তভাবে, নিজের তাগিদেই কিছু বলার জন্য লিখেছি।।

কামরুজ্জামান: 'আরেক রকম'( সম্পাদক: অশোক মিত্র) পত্রিকায় স্মৃতি ও কবিতা নির্ভর একটি গদ্য ('আসা যাওয়ার পথের ধারে'), বিভিন্ন উপশিরোনামে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন। পরে বইও হয়েছে। পাঠক মহলে বিশেষ করে কবি মহলে কেমন সাড়া পেয়েছিলেন? 

কালীকৃষ্ণ গুহ: প্রায় পাইনি বললেই চলে। আমাদের বই বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছোয় না। কারণ পাঠকের মধ্যে তেমন আগ্রহ তৈরি হয়নি। শুধু একজন বিদগ্ধ বন্ধু পাঠক বলেছিলেন,' বইটি আমি আটাশবার পড়েছি।' অর্থাৎ, ধরে নেয়া যায়, বইটি তাঁর ভালো লেগেছিল।

কামরুজ্জামান : আপনার বেশির ভাগ কবিতা গদ্যে লেখা। পদ্য ছন্দে লিখেছেন কম --- কেন? ভালো লাগে, না লিখতে চাননি? 

কালীকৃষ্ণ গুহ: পদ্য অর্থাৎ ছন্দ শিখতেই কিছু সময় লেগে গিয়েছিল। আমরা তো একেবারে রাস্তার লোকের মতো, কিছুই না জেনে, লেখা শুরু করি। ছন্দে লিখতে আমি ভালবাসি। তবে গদ্যের খোলা মাঠ ধরেই তো শুরু। তাকেও সঙ্গে রেখেছি। এতে বিচরণক্ষেত্র অনেক বড়ো হয়েছে সন্দেহ নেই ।

কামরুজ্জামান: কবিতায় কী সমাজ- দেশ- কালের ঊর্ধ্বে! কবিতায় কী রাজনৈতিক কিংবা প্রতিবাদের কথা বলা যাবে না! বললেই কী বিপদে পড়বেন বা পড়তে পারেন? 

কালীকৃষ্ণ গুহ: ঊর্ধ্বে কেন হবে? এটা কোনো প্রশ্নই নয়। রাজনৈতিক বা প্রতিবাদের কথা কবিতায় কি কম বলা হয়েছে? রবীন্দ্রনাথ-নজরুল থেকে শুরু। জীবনানন্দের হাতেও রচিত হয়েছে প্রতিবাদের কবিতা। তারপর সুকান্ত -সুভাষ-বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-শঙ্খ ঘোষ অসাধারণ সব প্রতিবাদের কবিতা লিখেছেন। স্বাধীন ভারতে খুব একটা বিপদ তো কারো হয়নি শুধু কবিতা লেখার জন্য! তবে অনেকে রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য 'দেশবিরোধী' কাজের অজুহাতে নিগৃহীত হয়েছেন বলে জানি যাদের মধ্যে কবিতা লেখকও ছিলেন।

কামরুজ্জামান : কবিতা লিখে কী সমাজ, দেশ, রাষ্ট্র বদলানো সম্ভব! একজন কবির দায়বদ্ধতা ও স্বাধীনতা কতখানি? 

কালীকৃষ্ণ গুহ : কবিতা লিখে সমাজ বদলানো সম্ভব নয়, তবে বদলের কাজে উৎসাহ জোগানো সম্ভব। কবি হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা অবশ্যই আছে প্রত্যেক সচেতন মানুষের। এই দায়বদ্ধতার মূল কথা হলো: আমি সমাজের কোনো ক্ষতি করব না, যদি কোনো উপকার না-ও করতে পারি। এই সমাজ শুধু মানুষকে নিয়ে নয়, সমস্ত প্রাণীজগৎ ও উদ্ভিদজগৎ নিয়ে এই সমাজ।

কামরুজ্জামান : কবিতা, কবিতা। কবিতার দুর্বোধ্যতা কিংবা আধুনিক- অত্যাধুনিক বলে কিছু হয় কী? 

কালীকৃষ্ণ গুহ: কবিতা হওয়াটাই একমাত্র কথা। আধুনিক -অত্যাধুনিক হওয়া নিয়ে তাত্ত্বিকরা মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করে থাকেন। মাথাও ঘামানো হয়। তাতে কবিতার বা কবির কিছু যায় আসে না। তবে ক্রমবিবর্তমান ভাষা মূল্যবোধ বা শৈলীর সঙ্গে মিশে থেকেই সমস্ত সৃষ্টিকর্ম প্রবাহিত থাকে -- বলা যায় সময়প্রবাহের সঙ্গে মিশেই তা এগিয়েছে। তা যেমন যুগের সাধারণ কিছু লক্ষণের সঙ্গে মিশে গেছে আবার, পাশাপাশি, ব্যক্তিমানুষের রচনা হিসেবে আলাদাভাবে চিহ্নিত থেকেছে।

কামরুজ্জামান : কবিদের গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে। গোষ্ঠী ছাড়া কী বাণিজ্যিক সাফল্য আসতে পারে না? 

কালীকৃষ্ণ গুহ : বাণিজ্যিক সাফল্যের কথা উঠছে কেন? গোষ্ঠীর সঙ্গে এর কী সম্পর্ক তাও স্পষ্ট নয়। বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য দরকার লেখকের জনপ্রিয়তা যা প্রায়শই বাণিজ্যিক পত্রিকায় লেখার ফলে ঘটে। একটি গোষ্ঠীর সকল সদস্য লেখক তো জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক/কবি হন না! তবে মহৎ লেখকরাও জনপ্রিয়তা পান যা চিরস্থায়ী/দীর্ঘস্থায়ী হয়, যেমন বিভূতিভূষণ বা জীবনানন্দ। বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল বা রবীন্দ্রনাথের কথা নাই-বা তুললাম।

কামরুজ্জামান : আপনি কেন কবিতা লেখেন? 

কালীকৃষ্ণ গুহ : এই প্রশ্নের উত্তরে নীরবতা পালন করছি, কারণ কোনো উত্তরই যথেষ্ট হবে না। কেন একজন মানুষ কবিতা লেখেন, ছবি আঁকেন বা গান করেন সেই প্রশ্নের উত্তর জ্ঞানীরা যুগ যুগ ধরে দিয়ে গেছেন।

কামরুজ্জামান : এতো বছর কবিতা বা সাহিত্য চর্চা করার পর, আপনার কী মনে হয়েছে আপনি সফল? 

কালীকৃষ্ণ গুহ : না। আমি সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলেই মনে করি! তবে হা-হুতাশ করি না।

কামরুজ্জামান : সাহিত্য ও সংস্কৃতি আজকাল পণ্য হয়ে উঠেছে-- আপনার কী মনে হয়? 

কালীকৃষ্ণ গুহ : সাহিত্য ও সংস্কৃতি  তখনই সেই অর্থে পণ্য যেখানে অনেক সেই শিল্পের চর্চা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এটা চিরকাল হয়ে এসেছে। অনেকে জনরুচির কথা মনে রেখে লেখেন, অনেকে তা করেন না। অবস্থা বা দৃষ্টিভঙ্গির উপর এসব নির্ভর করে।

কামরুজ্জামান : সাহিত্য ও শিল্প সৃষ্টির পেছনে কারও -না কারও প্রেরণা থাকে। আর সবচেয়ে বেশি নারীর-- আপনি কী মনে করেন? 

কালীকৃষ্ণ গুহ : প্ররণা আসে প্রধানত আত্মজিজ্ঞাসা থেকে।

কামরুজ্জামান : কবি ও সাহিত্যিকদের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে তাঁর সাহিত্য ভাবনার বা সাহিত্য জীবনের কোনও সমন্বয় খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্যক্তিগত জীবনকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র সাহিত্য জীবনের কী প্রকৃত মূল্যায়ন হবে? 

কালীকৃষ্ণ গুহ : অবশ্যই যায়। লেখক তো জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, সুখ-দুঃখ কামনা-বাসনা বিরহ-মিলন ও সর্বোপরি বিশ্ববোধের ভিতর থেকে গড়ে ওঠা জীবনদৃষ্টি নিয়ে লেখায় আত্মনিয়োগ করেন। তবে সাহিত্যের মূল্যায়নের জন্য ব্যক্তিজীবনের মূল্যায়ন বা অনুসন্ধান জরুরি নয়।

কামরুজ্জামান : কবিতা, বিশেষত বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ কী? 

কালীকৃষ্ণ গুহ: বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। বাংলাভাষা টিকে থাকলে বাংলাভাষায় কবিতাও লেখা হবে। তবে ভবিষ্যতে তার রূপ কী দাঁড়াবে তা তো বলা সম্ভব নয়। কে জানত 'সাধুভাষা' ফিরে আসবে আবার যেমন অনেকের লেখায় এসেছে দেখতে পাই! হয়তো এ একটা ভঙ্গি যা চোখ ভোলাতে এসেছে। হয়তো এই প্রত্যাবর্তনই সত্য হয়ে উঠবে। আমরা তো বেশি দূর দেখতে পাই না!

🍂

Post a Comment

2 Comments