জ্বলদর্চি

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়/আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী /একবিংশ পরিচ্ছেদ

প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
একবিংশ পরিচ্ছেদ

আনমনে তাকিয়ে জানলা পারের আকাশের টুকরো ফালিটুকুর দিকে তাকিয়ে সে কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ যেন বাঙ্ময় অতীত ফিসফিসিয়ে উঠলো কানে, কবে যেন এমনই বর্ষার সকালে ঘটেছিল ঘটনাটা…
 
সকাল থেকেই মেঘের ঘনঘটা। কয়েকদিন ধরেই মেজবৌয়ের শরীরটা খারাপ, খালি খালি বমি করে চলেছে। আবার পোয়াতী হয়েছে মনে হয়। কোলে কাঁখে আরও তিনটি, বড়টি বিয়ের যুগ্যি হতে চললো, সারাদিন মেজদাদার কাছে, সংসারের সবার কাছেই গঞ্জনা শুনে চলেছে, তবু এতো রসের সন্ধান পায় কোথা থেকে কে জানে! ঐ তো রোগা ভোগা শ‍্যামলা শরীর;তায় আবার বছর বিয়ানি!

তো সেদিনও যথারীতি বমি করে নেতিয়ে ক‍্যাঁদাল গোড়ায় পড়েছিল সে,মেজদাদা,বড়দাদার ‘তারা’ ‘তারা’ ডাক শুনে তড়িঘড়ি বিরজা রান্নাশাল থেকে বেরিয়ে কেরোসিনের প্রাইমাস স্টোভে চা বসিয়েছিল। একে ছেলেপুলেদের ইস্কুলের ভাত,কাঠের উনুনে ভিজে কাঠের ধোঁয়া;তারমধ‍্যেই আবার চা!পাম্প করতে করতে ঘাম বেরিয়ে যায়।
-'যত্তসব ঝামেলা!' মনে মনে গজগজ করতে করতেই চা বানানো হয় কলকাতা থেকে আনা চা-পাতি,গুড় আর দুধ ফুটিয়ে;ভাইবোনে খাওয়াও হয় আয়েস করে,ওদিকে উনুন নিভে যায়।
কি আর করা যাবে!বাড়ির কত্তাদের চা তো দিতে হবে!
চা খেয়ে বড়দাদা গেল গ্রামসফরে,ছুটিতে বাড়ি এলে এটি তার নৈমিত্তিক কর্ম ছিল।মেজদাদা গেল হাটে,বলতে গেলে সংসারের কত্তা তখন সেই।বিরজাও ফিরে এলেন রান্নাঘরে।
তখনকার দিনে,গ্রামের গৃহস্হ বাড়িতে কাজের প্রাচূর্য থাকলেও কর্মের সুচারু বন্টনও ছিল বেশ।তাদের বাড়িতে তো কখনোই কোন কাজের লোক ছিলনা,গ্রামেগঞ্জে সেসবের প্রচলনও ছিলনা, তবু জ‍্যাঠাইমার নিয়মে সবার কাজ ভাগ করা থাকতো, ধানসেদ্ধ,মুড়িভাজা,রান্না,হেঁসেল গুছোনো,মায় ঝাঁটপাট,গোবর লেপা পর্যন্ত…কারো কোন কষ্ট হতো না।
তবে মাঝেমধ্যে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেই হতো সমস্যা…ডবল ডিউটি পড়ে যেত।

তো সেদিনও তেমনই  ঘরে-বাইরের কাজ সেরে রান্নাশালের দাওয়ায় গায়ের কাপড় খানিক আলগা করে আয়েশ করছিল বিরজা,পাশের পুকুর থেকে হাওয়া আসছে,ভালো লাগছিল বেশ।
খানিকক্ষণ আগে মেজবৌদিদি ঘরে ঢুকেছে,তখনও দাদারা কেউ খেতে আসেননি।বড়বৌদিদি ঠাকুরঘরের পাটকর্ম সেরে আসন সেলাই নিয়ে বসেছে,কয়েকদিন আগে বিরজার কাছে সেলাই শিখে তার খুব নেশা হয়েছে তাতে।পাশের চালতা গাছটা বর্ষার জল পেয়ে ঝোপেঝাড়ে নিজেকে ভরিয়ে ফেলেছে,চারিদিকে বেশ একটা ছায়া ছায়া ভাব।
হঠাৎ কোথা থেকে বিশুর উদয়;
-'কি রে তারা!কেমন আছিস?'
-'আমার আর থাকা না থাকা!ঐ চলে যাচ্ছে দিন।তুই কেমন আছিস রে?'
বাল‍্যবন্ধুর সামনে নিজেকে ঢাকাঢুকি দেওয়ার কোন চেষ্টাও করেনি বিরজা। তবে আলগোছে একথা-ওকথার সঙ্গে সঙ্গে বিশুর চোখ যে এগলি-ওগলি ঘুরে বেড়াচ্ছে,নারীমন টের পাচ্ছিলো।,হঠাৎ ওর হাত ধরে বিশুর উতল স্বর,
-'তারা!সংসার করতে সখ হয়না তোর!'
-'মানে?কি বলছিস কি?জানিস না আমি বামুনঘরের ব‍্যাধবা!'
-'তো!তুই কি মানুষ না!তোর কি সখ থাকতে নেই!'
-'দ‍্যাখ বিশা!অকথা-কুকথা কইবি না এক্কেবারে!নেহাত ছেলেবেলার বন্ধু তুই,নাহলে উনুনের চ‍্যালাকাঠ এখনও জ্বলছে…'
-'সত‍্যি বলছি,সেই কোন ছোটবেলা থেকে তোকে ভালোলাগে আমার!আর কাউকে তেমন আপন ভাবতেই পারিনি।হলামই বা কায়েতের পো;চল না,দুজনে অনেকদূরে গিয়ে বাসা বাঁধি;আমাদের কুমুর বরও তো কায়েত,ওর বাবা তো জেনেবুঝেই বে দিয়েচে,ওদের সঙ্গে তো সেও থাকে।কি হয়েছে তায়!'
পাগলের মতো এসব আওড়াতে আওড়াতেই হঠাৎ বিশু কোন সুযোগ না দিয়ে বিরজার হাতদুটি ধরে হ‍্যাচকা টান মেরেছিল; বিরজা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল তার ঘাড়ে…
ভাগ‍্যিস  ঐ সময়েই মেজদাদা পৌঁছে গেছিল! তার ছায়াটি দেখেই বিশু দে-দৌড়।
মেজদাদা কি দেখেছিল,কি শুনেছিল,কি  বলেছিল বাড়ির অন‍্যদের,তা জানেনা বিরজা,তবে তারপর থেকে বৌদিদি সবসময়েই তার সঙ্গে থাকতো,এমনকি বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সময়ও তাকে সঙ্গে নিয়ে যেত।
সবসময় যে তা পছন্দ হতো তাঁর,তা নয়।বাধ্য হলেও ছোট থেকেই বড়ো স্বাধীনচেতা বিরজা;জ‍্যাঠাইমা ছাড়া আর কারো কথা বেদবাক‍্যের মতো মানেনি জীবনে।

🍂

এই বই সেই বই পড়ে তার মনোজগতে বেশ কিছু পরিবর্তন হয়ে উঠছিল ক্রমে। অজানা অচেনা যৌবনজ্বালা তো ছিলই,তায় সেবার জলপানি পেয়ে বড়োভাইপোর এনে দেওয়া 'রম‍্যানি বীক্ষ‍্য' পড়তে পড়তে দেশভ্রমণের ইচ্ছে জেগে উঠছিল মনে।
এতোবড়ো দেশ আমাদের,কতো কতো পাহাড়, নদী, সমুদ্র… পড়তে পড়তে ভেসে যেত কোন অদূরে! একলা নির্ঘুম রাতে অন্ধকার চালের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতো,সমুদ্দুর কেমন,তাদের পুকুরের থেকে ঠিক কতোটা বড়ো!অথবা পাহাড়ই বা কেমন!তার গায়ের রঙ কি সত্যিই বর্ষার মেঘের মতো!কখনো কি তাদের সঙ্গে দেখা হবে বিরজার!
কল্পচক্ষে এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যেন চোখের পাতায় নেমে আসতো ঘুম,অধরা স্বপ্নমাধুরীর মোহেই শুরু হোত পরের দিনের ধুলিযাপন।
তবে কখনো কখনো জীবন তো বড়ো বিচিত্র খেলা খেলে;পূর্ণতার অথবা রিক্ততার…
বিরজার জীবনেও এসেছিল তেমন দিন।
সেবার বড়বৌদিদির সঙ্গে তা বাবার বাড়ি গিয়ে দেখা হয়েছিল বৌদিদির দাদার সঙ্গে। তিনি কি কারণে যেন বিবাগী হয়েছিলেন,শুনেছিল বিরজা আগেই।সেবার দেখা হতে দেখলে,মানুষটি বয়সে বড়দাদারই বয়সী,সন‍্যিসিদের মতো ধরাচূড়ার বাহার নেই,ঘর ভালো লাগে না,তাই পথে পথে ঘুরে বেড়ান।মাঝেমধ্যে বিধবা মাকে দেখে যান।
তেমনই এসেছিলেন,ঘটনাচক্রে বিরজার সঙ্গে দেখা…
রাঁধতে ভালো পারেন,বৌদিদির আবদারে রান্না করে দাদাকে খাওয়াতে খাওয়াতে টুকটাক কথাবার্তা চলে দুজনে,পাহাড়,সাগর,নদী…
একদিন সাহস করে বলেই ফেলেন,জানেন দাদা,আমারও না খুব দেশ দেখতে ইচ্ছে করে।পাশেই ছিলেন পিসিমা,বৌদিদির মা।তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
-'তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে?আমি তো লোক খুঁজছি।আমারও বড়ো সখ চারধাম দেখে আসার,খোকা নিয়েও যাবে বলেছে;কিন্তু বুড়ো মানুষ…'
বিরজা তাকিয়েছিলেন বৌদিদির দিকে। 
তারপরের গল্প সত্যিই ছিল যুগের নিরিখে অন‍্যরকম।আদ‍্যোপান্ত সমব‍্যথী মানুষটি কেমন করে যেন বাড়ির সবাইকে রাজি করিয়ে ননদিনীকে তীর্থযাত্রার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
সে এক অন্য গল্প!বামনের পাহাড় ডিঙোনো সম;সামান্য জীবনের অসামান্য সঞ্চয়…(ক্রমশঃ)

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments