জ্বলদর্চি

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা নিয়ে লিখেছেন সুমিত্রা মাহাত

কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা নিয়ে লিখেছেন সুমিত্রা মাহাত

ঋত্বিক ত্রিপাঠী মহাশয়ের 'কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে কলম ধরেছেন অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষেরা। আমি তাঁদের তুলনায় নিতান্তই গড়পড়তা। সেই সামান্য বোধগম্যতা থেকে যতটুকু পারি তুলে ধরার চেষ্টা করি। যাঁর কাছ থেকে নিজের লেখা প্রকাশ করার সাহস পেয়েছি, তাঁর ভাবনার বিশ্লেষণে সামান্য প্রয়াস এই আর কি!

কাব্যগ্রন্থ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে প্রথমত যে বিষয়টা মনে আসে তা হোল কোন লেখা সে যেমনই হোক না কেন, ছোটো-বড়ো,ভালো-মন্দ,গদ্য-পদ্য,তার মধ্যে সেই ব্যক্তি মানুষটার প্রভাব থাকবেই। অর্থাৎ কবি মানুষ হিসেবে কেমন, কোন সংস্কারের মধ্যে তিনি বেড়ে উঠেছেন, কেমন মানুষের সান্নিধ্য তিনি পেয়েছেন তার প্রভাব অনস্বীকার্য। গভীর তত্ত্ব বা দর্শনের কথা আমি বলতে পারি না। তবে এই কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে একথা বলতে পারি কবিতাগুলো পড়ে পড়ে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রচয়িতা কবি মানুষটিও যেন ধীরে পরিস্ফুট হতে থাকেন। প্রকাশিত হয় তাঁর মন মানসিকতা। এক উচ্চ ভাবনার শিখরে কবি অবস্থান করেন , আর দিক নির্দেশ করেন তাঁর পাঠককুলকে। যে ভাবনার বীজ কবি বুনেছেন কবিতার প্রতি ছত্রে ছত্রে, বর্তমান সময়ে খুব কম মানুষই সাধনার এই উচ্চ স্তরে পৌঁছোতে পারেন। ভাবনার এই পর্যায়ে উত্তরণ খুব সহজ কথা নয়। উদার মানসিকতা ও বাস্তব জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত এক অদ্ভূত সম্পৃক্ততা দান করেছে কবি হৃদয়ে,তারই স্ফূরণ ঘটেছে বইয়ের প্রতি পাতায়। যা পাঠ করতে করতে কখনও মন ভিজে যায়, কখনও প্রতিবাদী হয় আবার কখনও সাহসে বুক বাঁধে। মন বলে মূল্যবোধের মৃত্যু ঘটেনি, এরকম ভাবে ভাবার মানুষ এখনও দু একজন আছেন।
 অভিমান ঝরে পড়ে কবির কথায় ' চেয়েছি বলেই দেশ নইলে একটাই পৃথিবী হয়'। সত্যিই তো যত রকমের বিভাজন সৃষ্টি করেছি আমরাই। তা না হলে সমস্ত পৃথিবী তো একটাই। কজন মানুষ এমন করে ভাবার সাহস দেখান?আশ্চর্যের বিষয় ভাবনার এই উচ্চ স্তরে কবি শুধু নিজেই বিচরণ করেন নি,পাঠক কুলকেও তার আস্বাদ দিয়েছেন। ভাবনাকে কোন পথে চালানো উচিত তার দিক নির্দেশ পাঠিয়েছেন। এখানেই কবির সার্থকতা।
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
দ্বিতীয়ত যে বিষয়ে আমি অত্যাশ্চর্য হয়েছি তা হল প্রতিটি কবিতার নামকরণ। কাব্যগ্রন্থের নামকরণ 'কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা' নিয়ে সুগভীর আলোচনা হয়েছে। সে প্রসঙ্গে আমি যাচ্ছি না। সত্যি কথা বলতে আলাদা ভাবে প্রতিটি কবিতার নামকরণই স্বকীয়তার দাবী রাখে। আত্মস্বীকার,আশ্চর্য নততল, মহাকবির ব্যঞ্জনা ইত্যাদি। এই নামগুলো এতটাই শক্তিশালী যে প্রতিটাই কাব্যগ্রন্থের নাম হতে পারত। আবার অপরদিকে এই নামগুলো অনেকটা ম্যাজিক ডোর এর মতো। একেকটা স্পর্শ করলেই যেন একেকটা ভাবনার জগৎ উন্মুক্ত হয়ে যায়। যা পাঠককুলকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। তারা নিজের অজান্তেই কাব্যগ্রন্থ পড়ে শেষ করে।

তৃতীয়ত কবিতার ভাষা, শব্দের ব্যবহার ও গঠন শৈলী। ভাষা ও শব্দ বিষয়ে কবি যথেষ্ট সজাগ তা বোঝাই যায় এবং তা যথেষ্ট উচ্চ মার্গের। শব্দ চয়ন অসাধারণ। ভাষা শব্দের পথ ধরে মূল ভাব ও ব্যঞ্জনা বুঝতে আমার মতো
সাধারণ মানুষকে কবিতাগুলো দু-তিন বার পড়তেই হয়। গঠন শৈলী বিষয়েও কবি সচেতন। সুনির্দিষ্ট স্থানে ভাবনার ছেদ টানেন। কোথাও এতটুকু বাহুল্য নেই যা পাঠককুলের বিরক্তি উদ্রেক করে। সীমিত পরিসরে নিটোল ভাবনা উপস্থাপিত। কবিতাগুলির ভাব, দর্শন এককথায় অসাধারণ। 

এবারে আসি মূল কবিতার বিষয়বস্তুতে। কবিতাগুলির বিষয়বস্তু বৈচিত্র্যময়। কি নেই! 'আত্মস্বীকার' কবিতাটিতে কবি উৎসর্গের পরও ঋণ স্বীকার করেছেন। 'খড়ের ওপর কোমল মাটির প্রলেপ' কি অদ্ভূত ব্যঞ্জনা! 'আশ্চর্য নততল' এ কবি বলেন ' সিঁড়ি, ওপর থেকেও যা, নীচ থেকেও তাই' জীবন তো এমনই। কখনও তুলে ধরেন প্রকৃতির খণ্ড চিত্র 'স্বাতী নক্ষত্রের আকাশ'। ' রাষ্ট্রকে যিনি পৃথিবী থেকে আলাদা করে দেখেন না — তিনি কবির কবি।' এমন কবি হওয়া কি সহজ কথা! কবি বলেন 'কোনো মানুষকে গভীর ভাবে নিয়ো না।' যদিও বলা সহজ কিন্তু তার প্রয়োগ এত সহজ নয়। কবি হৃদয় তো সৃষ্টিশীল অনুভূতির ঢেউ এর আকাঙ্খায় সর্বদা আকুল। তা না হলে সৃষ্টি সম্ভব নয়। তুচ্ছ হিসেব নিকেশ, চোখের ভালোলাগা, টানাপোড়েন মান, অভিমান, দুঃখ, রাগ,আনন্দ, সহানুভূতি, ভালোবাসায় হৃদয়ের দরজায় ঝাঁকুনি পড়লে তবেই স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টিধারা উৎসারিত হয়। তবে 'মানুষ তো মানুষই!' এ যেন এক চূড়ান্ত বাস্তবতা। 'এই আমাদের জীবন'। জীবনকে নানান আঙ্গিকে ধরতে চেয়েছেন কবি। কখনও সহজভাবে কখনও জটিল আঙ্গিকে। কখনও বা মানস চক্ষু দিয়ে। সক্রিয় তৃতীয় নয়নের সাহায্যে কবি জীবনকে রূপ রেখায় বাঁধতে চান। ' আগুনে আগুন দিতেই শিখেছি আমরা' এও এক জীবনবোধ। 'ভুবন জাগানো মরুভূমির মাঝে' 'গোমড়ামুখে ঘনীভূত পদার্থের পিণ্ড' তুলনা বোধগম্যতার পর্যায়ে আসতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। 

কখনও কমনীয়তা, কখনও দৃঢ়তা কখনও বা সংশয় সব মিলেমিশে ঋত্বিক ত্রিপাঠীর ' কীলক লিপিতে ভূমি ও ভূমা ' যেন এক অনবদ্য জীবন চিত্র। তাতে নানা রং এর কাব্যিক নকশা তোলা। ভাববস্তুর ক্রমশ সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠা। কাব্যগ্রন্থটি পাঠকদের জন্য এক অসামান্য উপহার। 'ছায়ার প্রলাপ','প্রজাপতি উপহার' ইত্যাদি তুলনার মাধ্যমে কবি জল রঙ এ নরম তুলি ভিজিয়ে ছবি আঁকেন। আবার কখনও ডুব দেন বিষয়বস্তুর গভীরে যখন বলেন 'বর্ণনা তো উপাখ্যানের সিঁড়ি'।'অভিজাত ডুবোজাহাজ' এক অসাধারণ নামকরণ। পরের কবিতায় পাঠক শোনে জীবন সম্পর্কে এক বাস্তব তত্ত্ব 'নিগূঢ় কালজয়ী এই জীবন'।
'তোলপাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা বলছি' এখানেও প্রতিধ্বনিত হয় এক চরম বাস্তবতা। 'দাবানল জানে ঝড়ের আত্মপ্রলাপ' এক নিদারুণ ব্যঞ্জনার উপস্থাপনা। পাঠক কুলকে পুনরায় দিশা প্রদান করেন কবি,'ভক্তি যোগেই মধুর ' উক্ত লাইনটির মাধ্যমে। 'স্বপ্নও আসলে জীবন উৎসর্গ একক গোলার্ধ উদ্ যাপন' সঠিক দিশা পেতে সাধারণ পাঠক কুলকে ভাবনার সমুদ্র মন্থন করতে হয়।'বিপরীতেই হয় বন্ধুত্ব গভীর, আত্মশুদ্ধি/শ্রাবণে ভিজে যায় যেমন শাল ও সেগুন' লাইনদুটির মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে অসাধারণ অভিব্যক্তি। কখনও ফুটে ওঠে কবি মনের অসহায়তা,'দাবানলের আগেই তো চেয়েছিলাম পালাতে'। কবি যখন সাধারণের ভিড়ে মিশে গিয়ে তাদের মনের কথা বলেন, ' মানুষের কথা মানুষকেই বলতে হয়'। কবি বলেন, 'পবিত্র যোগ' এর কথা। 'এ সবই মুক্তি ', এ এক অনন্য উক্তি। সাধারণ বিষয়কেও আমরা নতুন ভাবে ভাবতে পারি,যখন কবি বলেন, 'আগুনেরও থাকে সীমা','চন্দ্র-সূর্যের পাশেই সাপ ও ফণা '। কখনও কখনও প্রস্ফুটিত হয় সুন্দর প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপট, 'বৃষ্টি শেষে অপরূপ হচ্ছে লক্ষ লক্ষ তারা','উদার আকাশে','ছায়ার মতো মেঘ কালো করে বৃষ্টি নামে','অরণ্য জুড়ে আঁকিবুকি'। ' স্মিত হাসির অঙ্কুরিত বীজ ' কি সুন্দর তুলনা! এমন তুলনাহীন বিষয়বস্তু ছড়িয়ে কবিতার ছত্রে ছত্রে। যেমন 'শীর্ণ দু'হাতে আগুনজ্বলা গল্পেরা খেলা করছে' , ' অদৃশ্য অমরত্বের পাশে হরিণ আবেশ','চোরা লন্ঠনের আলো','চিনে নিচ্ছি ব্ল্যাকহোল','এখন মহার্ঘ সন্ধে।','পদচিহ্নে জমে থাকা জল ','আগুন মানে ছাই','শান্তি পুরুষের আঙ্গুল ' ইত্যাদি। অসাধারণ শেষ কবিতার শেষ লাইন ' ভূর্জপত্রে লেখা থাকে সমাসবদ্ধ রোদনের গান।'

পরিশেষে যে কথা বলতে চাই সম্পাদক কবির হাত ধরে যে পরিমাণ মানুষ লেখালেখির জগতে আসেন। সেই তুলনায় তাঁর নিজের লেখালেখি কিছুটা কম। ফলত পাঠককুলকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয় তাঁর মূল্যবান জীবন দর্শন পাঠ করতে। তাই মনে আশার বাণী নিয়ে বলতে চাই ফল মূলের মতো অন্তত বছরে একটা কাব্যগ্রন্থ হলে বেশ হয়!

🍂

Post a Comment

0 Comments