জ্বলদর্চি

ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৪ /বিজন সাহা

শোকের স্কয়ারে মৃত পুত্র কোলে শোকার্ত মা


ভোলগা নদীর খোঁজে – ৫৪ 

বিজন সাহা 

মামায়েভ কুরগান 


মামায়েভ কুরগান ঐতিহাসিক ভাবেই ভোলগাগ্রাদের এক বিশেষ এলাকা যদিও স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের পর থেকে সে একেবারেই ভিন্ন রূপ নিয়েছে। সেখানকার «রদিনা মাত জাভিওত» বা জননী জন্মভূমি ডাকছে নামক মাতৃ মূর্তি এক ভিন্ন বার্তা নিয়ে আসে মানুষের কাছে। রদিনা মাত মানে জন্মভূমি মা, তবে আমার মনে হয় জননী জন্মভূমি নামই বাংলায় সঠিক, তাই সেভাবেই লিখব। আমরা এর আগে চেবকসারির মাতৃ মূর্তির কথা বলেছি। সেটা ছিল এক সাধারণ মায়ের মূর্তি। কিন্তু এখানে সেটা ঠিক সে রকম নয়। লক্ষ্মী বা সরস্বতীর মত রূপ নয় তাঁর, তিনি হিন্দু পুরানের দুর্গা বা কালীর মত। তলোয়ার হাতে উদাত্ত কণ্ঠে সন্তানদের আহ্বান জানাচ্ছেন শত্রুর হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করার জন্য। কুরগান শব্দটি এসেছে কুরগন নামক তুর্ক শব্দ থেকে। এর অর্থ টিলা বা ছোট পাহাড় যা সাধারণত সমাধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেকোনো সমাধি যা কিনা মাটি, পাথর ইত্যাদির ঢিপির কথা মনে করিয়ে দেয় সেটাই কুরগান। সে হিসেবে মিশরের পিরামিডও এক ধরণের কুরগান।  

মামায়েভ কুরগানে আমরা যাই ২০২১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। সেটা ছিল আমার কাছে অনেকটা তীর্থে যাবার মত। এখানকার স্মৃতিসৌধ সম্পর্কে অনেক শুনেছি, অনেক ছবি দেখেছি। এবারই প্রথম চাক্ষুষ দেখব। যদিও সোভিয়েত আমলে আমাদের অল্প পয়সার বিভিন্ন জায়গা এক্সারশনে নিয়ে গেছে, তবে আমার ছুটি কেটেছে হয় নির্মাণ দলে কাজ করে অথবা ছাত্র সংগঠনের সম্মেলনে। আসলে আমার ভোলগা ট্রিপের অনেক কারণের একটা ছিল এই উপলক্ষ্যে মামায়েভ কুরগান ঘুরে আসা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মৃতদের পুণ্য স্মৃতি ধরে রাখতে সমস্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়েই অসংখ্য মেমোরিয়াল ছিল। এখনও তৈরি হচ্ছে। মস্কোর পাক্লোন্নায়া গারা, বেলারুশের খাতিন, লেনিনগ্রাদের পিস্কারেভস্কোয়ে সমাধি …তবে মামায়েভ কুরগান একেবারেই অনন্য। 

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বীর বুক দিয়ে আগলে রেখেছে জননী জন্মভূমিকে

ভোলগাগ্রাদের সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্টে ভোলগার দক্ষিণ তীরে অবস্থিত এই মালভূমি এলাকায় ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধের ভয়ঙ্কর লড়াই চলে। আমাদের সময় মামায়েভ কুরগান বিখ্যাত মূলত «স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের বীরদের প্রতি» স্মৃতিসৌধের জন্য। এই স্মৃতিসৌধের কেন্দ্রীয় মনুমেন্ট জননী জন্মভূমি ডাকছে। মামায়েভ কুরগানে কয়েকটি গণ কবর এবং কিছু পৃথক কবর অবস্থিত। এসব সমাধিতে ৩৫ হাজারের বেশি স্তালিনগ্রাদ রক্ষীদের দেহাবশেষ সমাহিত।    

গোল্ডেন হোর্ডদের সময় থেকেই মামায়েভ কুরগানের নাম শোনা যায়। এর চূড়ায় ছিল টহল। লোক মুখে শোনা যায় মঙ্গোল সেনাপতি মামাই এখানে ফাঁড়ি তৈরির নির্দেশ দেন। মামাই কুরগানের অনতিদূরেই গোল্ডেন হোর্ডদের দুটো রাজধানী সারাই-বাতু ও সারাই-বেরেক অবস্থিত ছিল।       

আমাদের যাত্রা শুরু হয় বেশ সকালে। পথে আমরা বেশ কিছু মনুমেন্টের দেখা পাই যাদের একটি ৎসারিৎসিনে যারা সোভিয়েত রাজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য লড়েছিলেন সেই সব বীরদের। এরপর আমরা আসি মামায়েভ কুরগানে। শুরুতেই আমরা দেখা পাই এক আর্মেনিয়ান ভদ্রলোকের যিনি যুদ্ধকালীন সময়ের পোশাক পরে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছিলেন। এরপর আমরা চলে যাই «স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের বীরদের প্রতি» স্মৃতিসৌধে। বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই স্মৃতিসৌধের মূল কম্পোজিশনগুলো হল  

প্রজন্মের স্মৃতি – যা দিয়ে শুরু হয় আমাদের যাত্রা; পিরামিড আকারের পপলারের গলি; মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা বীরদের স্কয়ার; ধ্বংসপ্রাপ্ত দেওয়াল; বীরদের স্কয়ার; সামরিক বীরত্বের হল; শোকের স্কয়ার; জননী জন্মভূমি ডাকছে; মেমোরিয়াল সমাধি; মেমোরিয়াল পার্ক এবং গির্জা। ২৬ হেক্টর জমির উপর তৈরি এই কমপ্লেক্সে যে গণ কবর রয়েছে তার দেয়ালের দৈর্ঘ্য ১৩০০ মিটার। কমপ্লেক্স তৈরি কাজ শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। প্রখ্যাত সোভিয়েত স্থপতি ভুচেতিচের নেতৃত্বে সারা সোভিয়েত ইউনিয়নের শিল্পী ও আর্কিটেক্টরা এই কমপ্লেক্সের পরিকল্পনা করেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত কমপ্লেক্সের কাজ করা হয়। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তৈরি হয় জননী জন্মভূমির মাথা। ১৯৬৭ সালে তলোয়ার স্থাপন করা হয়। আর ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত মনুমেন্ট তৈরি হয়। ১৯৬৭ সালে কমপ্লেক্স উদ্বোধন করা হয়।  

জননী জন্মভূমি, ডাইনে বীরদের স্কয়ার

মামায়েভ কুরগানের নীচ এসে তার বিশাল উচ্চতা দেখে দিলীপকে জিজ্ঞেস করলাম উপরে যাবে কি না। আসলে এত দিনের অনবরত যাত্রায় সবাই ক্লান্ত। মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। তখন মায়ের সাথে বিভিন্ন তীর্থস্থানে বেড়াতে যেতাম। কিছু কিছু দেবতা মানুষের ভয়ে অথবা মানুষের চেয়ে নিজেরা যে উঁচু স্থানে অবস্থান করছেন সেটা দেখানোর জন্য পাহাড়ের চূড়ায় বাস করতেন। মা, মাসীমারা যখন ধীরে ধীরে উপরে উঠতেন আমি ততক্ষণে দৌড়ে পাহাড়ের চূড়ায় চলে যেতাম। এবারও তাই হল। দিলীপ আর দেমিদকে নীচে রেখে চললাম জননী জন্মভূমির পদতলে। প্রজন্মের স্মৃতি নামক সিঁড়ি বেঁয়ে চলে এলাম মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা বীরদের স্কয়ারে যা আসলে এক সৈনিকের মূর্তি যে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে শত্রুর অপেক্ষা করছে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে। সে যেন নিজের বুক দিয়ে আগলে রেখেছে দূরে পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা জননী জন্মভূমিকে। ওখানে প্রচুর লোকজন ঘুরে ঘুরে দেখছে, ছবি তুলছে। একজন এসে বললেন আমার ছবি তুলে দেবেন কি না। আমি স্মার্টফোন দিলাম তার হাতে যদিও ওনার ইচ্ছে আমার আমার ডিএসএলআর দিয়ে ছবি তোলার। এরপর ধ্বংসপ্রাপ্ত দেওয়াল। এখানে বিভিন্ন সেনাদের যুদ্ধকালীন জীবনের চিত্র, মনে হয় এখনও তারা যুদ্ধ করছে। এটা অনেকটা বিশাল ছবি, তবে রঙ তুলির পরিবর্তে এখানে সিমেন্ট আর কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে। দেওয়ালের বিভিন্ন জায়গায় লেখা সেনাদের ভালোবাসার কথা, জন্মভূমির প্রতি তাদের প্রতিজ্ঞার কথা। বীরদের স্কয়ারে দেখা যাবে যোদ্ধাদের মূর্তি - কেউ তার মৃত সহযোদ্ধাকে কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ লড়াই করছে সর্প রূপী শত্রুর সাথে। সামরিক বীরত্বের হল গোলাকার জানালাবিহীন হল। ওখানে আমি যাই দিলীপ আর দেমিদের সাথে। ভেতরে জ্বলছে অনির্বাণ শিখা। আর দেওয়ালে লেখা আছে «আমরা ছিলাম মরণশীল মানুষ এবং আমাদের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক মানুষই জীবিত আছে। কিন্তু আমরা সবাই জননী জন্মভূমির প্রতি আমাদের দেশপ্রেমিক দায়িত্ব পালন করেছি।» সেই দেওয়ালে খোঁদাই করে লেখা আছে যুদ্ধে প্রাণ হারানো সেনাদের নাম ও পদবী। এই হলে সব সময় বাজে রবার্ট শ্যুম্যানের মিউজিক ড্রিমস।

🍂
 শোকের স্কয়ারে এক মাকে দেখা যাবে মৃত সন্তানকে কোলে করে আর্তনাদ করতে। এদের মনুমেন্টগুলো এত জীবন্ত যে মনে হয় পুত্রশোকে মা সত্যিই কাঁদছে। এখান থেকে শুরু হয় মূল স্তম্ভের দিকে আরোহণের পথ। সাপের মত আঁকাবাঁকা পথের পাশে ৩৪৫০৫ জন স্তালিনগ্রাদের রক্ষীর দেহাবশেষ। আর সবার উপরে, এই পাহাড়ের চূড়ায় তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে কেন্দ্রীয় মূর্তি – জননী জন্মভূমি ডাকছে। তিনি যেন তাঁর সন্তানদের আহ্বান জানাচ্ছেন যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য। ২০১৮ সাল পর্যন্ত এটা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্ট্যাচু। ৫২ মিটার উঁচু এই জননী জন্মভূমির হাতের দৈর্ঘ্য ২০ মিটার আর তলোয়ার ২৯ মিটার। মূর্তিটির উচ্চতা তলোয়ার সহ ৮৫ মিটার। ৫৫০০ টন কংক্রিট ও ২৪০০ টন ধাতুর তৈরি এই মনুমেন্ট একবারেই ঢালাই করা হয়েছিল যাতে কোন রকম সিম না থাকে। ভেতরে ফাঁকা এই মনুমেন্টের দেয়াল ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার পুরু। ভেতরে আছে ৯৯ টি স্টিলের দড়ি যাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য আছে ঘর ও সিঁড়ি। হাতল সহ ৩০ মিটার দীর্ঘ ও ১৪ টন ওজনের তলোয়ার ফ্লোরিনেটেড স্টিলের তৈরি। বাতাসের চাপ কমানোর জন্য তলোয়ারে বেশ কিছু ছিদ্র আছে। এই মূর্তিটি  দুই মিটার উঁচু একটি স্ল্যাবের উপর দাঁড়িয়ে আছে যা মূল ভিত্তির উপর স্থাপিত। এই ভিত্তির উচ্চতা ১৬ মিটার, যদিও মাটির নীচে লুকানো বিধায় সেটা প্রায় দেখাই যায় না। দূর থেকে দেখলে জননী জন্মভূমিকে যুদ্ধংদেহী মনে হলে খুব কাছ থেকে মনে হয় মেরিলিন মনরোর মত বাতাসে যার স্কার্ট উড়ে যাচ্ছিল। মামায়েভ কুরগানের পাদদেশ থেকে এর শীর্ষ পর্যন্ত ২০০ গ্র্যানাইটের তৈরি সিঁড়ি যার প্রতিটির উচ্চতা ১৫ সেন্টিমিটার আর প্রস্থ ৩৫ সেন্টিমিটার। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ চলেছল ঠিক ২০০ দিন আর সে কারণেই সিঁড়ির সংখ্যাও ২০০। সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়ায় এখানে তৈরি হয় সব সন্তদের গির্জা, যার ধারণা প্রথমে আসে ১৯৯৩ সালে। গণ কবরের পাশে এই গির্জার উচ্চতা জননী জন্মভূমির চেয়ে কিছুটা কম। ২০০২ সালের এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয় আর ২০০৪ সালে এর কাজ সম্পন্ন হয়। ২০০৫ সালে ৯ মে বিজয়ের ৬০ বছর উপলক্ষ্যে সাধারণের জন্য গির্জা কাজ করতে শুরু করে।       

উল্লেখ করা যেতে পারে যে খ্রুশেভের সময় স্তালিনগ্রাদের নাম পরিবর্তন করে ভোলগাগ্রাদ রাখে হলেও বছরে বেশ কয়েকটি দিন এই শহর স্তালিনগ্রাদ নাম ফিরে পায়। সেসব দিনগুলো হল – ৯ মে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মিত্র বাহিনীর বিজয় দিবস, ২২ জুন স্মরণ ও শোক দিবস – এদিন ১৯৪১ সালে জার্মান বাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে, ২৩ আগস্ট ফ্যাসিবাদী জার্মানির বিমান বাহিনীর বোমাবর্ষণে স্তালিনগ্রাদের মৃতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে, ০৩ সেপ্টেম্বর – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তি দিবস, ১৯ নভেম্বর স্তালিনগ্রাদের জার্মান বাহিনীর পরাজয়ের শুরু।  

মামায়েভ কুরগান

https://www.youtube.com/watch?v=oyGMfQZ21Ps&t=14s

ছবিতে মামায়েভ কুরগান

http://bijansaha.ru/album.php?tag=260

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments