জ্বলদর্চি

বিদ্রোহী কবি ও তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ/ রাজীব শ্রাবণ

বিদ্রোহী কবি ও তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ 

রাজীব শ্রাবণ 


তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ বলতে বোঝায় ভারতের  অন্যতম অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গর  হুগলী জেলার তারকেশ্বর মন্দিরের মন্দিরের পুরোহিতের অনাচারের বিরুদ্ধে সংঘটিত এক আন্দোলন। 

হুগলির তারকেশ্বর মন্দিরের পুরোহিতকে বলা হত 'মোহান্ত'। বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের মোহান্ত'দের নিয়ে নানারকম অনাচারের অভিযোগ ছিল। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে (১২৮০ বঙ্গাব্দ) মোহান্তের নামে প্রথম নারীঘটিত অভিযোগ উঠেছিল। তখন থেকেই মোহান্তদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাৎ-সহ নানা ধরনের অনাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ছিল। দীর্ঘদিন পর ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ (১৩৩১ ৩১ বঙ্গাব্দ) দিকে তৎকালীন মোহান্ত সতীশচন্দ্র গিরির নামে নারীঘটিত এবং অর্থ আত্মসাতের মতো অভিযোগ ওঠে। এই সময় স্থানীয় মানুষ এর প্রতিবাদ শুরু করে। এরই সূত্রে ধরে ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ২৭শে জ্যৈষ্ঠ (মঙ্গালবার ১০ জুন ১৯২৪) থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ  তারেকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সূচনা করেন।
এইসব অনাচারের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে উঠলেন স্বামী সত্যানন্দ ও বিশ্বানন্দ নামে দুই মহারাজের নেতৃত্বে মহাবীর দল। তাদের পিছনে এসে দাঁড়ালো কিছু সাধারণ মানুষ। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে একসময় কংগ্রেসের প্রাদেশিক কমিটির কাছে আবেদন করা হলো, যাতে তারা আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের উপর দায়িত্ব দেওয়া হলো কংগ্রেস কমিটির পক্ষ থেকে। এবারে কেঁপে উঠলো মোহন্তর আসন। এই আন্দোলন ভাবিয়ে তুলল ব্রিটিশ সরকার কেও।
🍂

কবি নজরুল ইসলাম সবে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে হুগলি বিদ্যামন্দিরে কিছুদিনের জন্য বসবাস করছেন। তারকেশ্বর সত্যাগ্রহের যোগ দিতে তিনি এসে পৌঁছলেন তারকেশ্বরে। মহন্তের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গান লিখলেন তিনি, পথে পথে ঘুরতে লাগলেন সেই গান গেয়ে।

এই সময়ে একটি ঘটনা আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। সত্যাগ্রহের প্রস্তুতির উদ্দেশ্যে মন্দিরের মাঠে কংগ্রেসের একটি বিরাট সভার আয়োজন করা হয়েছে। উপস্থিত আছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র বসু, স্বামী বিশ্বানন্দ, নজরুল ইসলাম প্রমূখ। এদের প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত মহন্তর লেঠেল বাহিনী। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ভয়ঙ্কর লাঠিয়াল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন কবি নজরুলকে উদ্বোধনী সংগীত গাওয়ার অনুরোধ করলেন। নজরুল দৃপ্ত ভঙ্গিমায় তাঁর গান শুরু করলেন।

“জাগো আজ দন্ড হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী

ওই ডুবালো পাপ চন্ডাল তোদের বাংলাদেশের কাশি।

জাগো বঙ্গবাসী।

মোহের যার নাইকো অন্ত

পূজারী সেই মহন্ত

মা-বোনের সর্বস্বান্ত করছে বেদীমূলে।”

একের পর এক লাইন গেয়ে যাচ্ছেন নজরুল ইসলাম। শিহরিত হয়ে উঠছে সভার লোকজন। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে মহন্তর লেঠেল বাহিনীও। একপাশে দাঁড়িয়ে আছে তাদের নেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। আদেশ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে সত্যাগ্রহীদের উপর। সবাই ভয়ে ভয়ে আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে আর মৃত্যুর প্রহর গুনছে।

গান শেষ হল। সবাই আশ্চর্য হয়ে দেখল, কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর চোখ তখন ছল ছল করছে। মঞ্চে এগিয়ে এসে বললেন, “কাজীদা আরেকবার গাও।” নজরুল তাঁর গান শেষ করার পরেই সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পায়ের কাছে সেই ভয়ঙ্কর লাঠিটা রেখে ওই সভায় মহন্তের সর্বনাশ করার শপথ নিলেন। আন্দোলনের মোড় ঘুরে গেল। বেশিরভাগ লাঠিয়াল নিয়ে সত্যবাবু সত্যাগ্রহে শামিল হলেন। নজরুল ইসলাম শুধু কন্ঠ দিয়ে গান গাইতেন না, গান গাইতেন “কলজে” দিয়ে, হৃদয় দিয়ে, এই ঘটনাই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇

Post a Comment

0 Comments