শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৫১ / সালেহা খাতুন
আমার থেকে কমবয়সী আত্মীয় স্বজনের অনেকেরই তখন বিয়ে গেছে। তাদের অভিভাবকরা আমার কাছে সৌজন্যবশত বলেছেন, ‘দেখ মণি ওদের তো পড়াশোনায় তেমন কোনো ইচ্ছাই নেই জোর করে পড়ানো হচ্ছে তাই আমরা বাধ্য হচ্ছি ওদের বিয়ে দিতে’। কিন্তু পাড়ায় কিছু হুল ফোটানো পড়শী থাকেন, তার ওপর সম্পর্ক যদি রসিকতার হয় তাহলে তো অনেক কটু কথাই শুনতে হয়। সেগুলোকে হেসে উড়িয়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। এক প্রতিবেশী তাঁর ঘর থেকে আমার ব্যালকনিতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন “কিরে তোদের গায়ে যে দেখি মাছিও বসছে না।” ইঙ্গিত বুঝে বললাম, দাদি আমরা তো গায়ে ফিনাইল লাগাই। অতএব চিন্তা করার দরকার নেই। তাঁর কন্যারা অতীব সুন্দরী। এই গরবে তাঁর মাটিতে পা পড়ে না।
জানি না, বাবা কি জানতেন তাঁর মেয়ে কিছু একটা চাকরি করবেই? তিনিও আমার পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে ভেবে আমার আগে বোনের বিয়ের যোগাযোগ শুরু করেন। কিন্তু ভবিতব্য মানতেই হবে। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটিতে যাবো কিনা এ নিয়ে আমারও দ্বিধা ছিল। যেমন এখনকার দ্বিধা জীবনের এই পর্ব নিয়ে কথা বলবো কিনা। উর্দু লেখিকা ইসমত চুঘতাই তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘কাগজি হ্যায় প্যারহান’-এ তাঁর বিবাহিত জীবন নিয়ে একটি কথাও বলেন নি দেখে ও পথে হাঁটবো ঠিক করি। কিন্তু ডিএসইতে ‘লাইফ হিস্ট্রিজ’ পড়া যদুবংশীয় কন্যা পথ দেখায় ‘তিনি করেছেন বলে তোমাকেও এমনটা করতে হবে তা কিন্তু নয়, তুমিই ঠিক করবে তুমি কী করবে’।
লাখকথা না হলে বিয়ে হয় না। চলুক সে কথা। আমি এম. এ. পার্ট টু পরীক্ষা নির্বিঘ্নে দিলাম। নেট সেট পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করলাম। তখনও এম.এ.-এর রেজাল্ট বেরোয়নি। ছিয়ানব্বইয়ের সেপ্টেম্বর থেকে সালাউদ্দিনের সঙ্গে বিয়ের যে কথা শুরু হয় তা চলে সাতানব্বইয়ের নভেম্বর পর্যন্ত। মাঝখানে আঠাশে মে বিয়ে গেল ভেঙে। সে এক যন্ত্রণা। মা আমাকে সুস্থ করে তুললেন। সতেরো বছর বয়সী ভাই সম্পর্ক জোড়া দিতে মানসিক-আধ্যাত্মিক-শারীরিক কী পরিশ্রমটাই না করলো। দুই বাবার লড়াই মেটালো। তবে বাবা এবং শ্বশুরমশাই যতদিন জীবিত ছিলেন বিয়ের পর কেউ কারো বাড়িতে যান নি। এতোটাই একগুঁয়ে তাঁরা।
বিয়ের দিনেও অশান্তি। পুওর রিসেপশনের দোহাই দিয়ে বর তুলে নিয়ে চলে যাবেন বলে হুমকি দেন শ্বশুরমশাই। শরবতের গ্লাস ছুঁড়ে মারেন আমার সেজোকাকিমার বাবাকে। বড়ো মেসো ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করেন। কিছুতেই কিছু হয় না। অবশেষে সালাউদ্দিন বরাসন ছেড়ে রঙ্গমঞ্চে নেমে আসেন নিজের বাবাকে শান্ত করতে। আমি তো অন্দরমহলে, এসবের কিছুই জানতে পারিনি। সত্যি বলছি যদি সেদিন তৎক্ষণাৎ এসবের বিন্দুমাত্র আভাসও পেতাম তাহলে আমি নিজেই বিয়ে ভেঙে দিতাম।
🍂
শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শুনেছি, বড়ো জার বিয়ের সময়ও শ্বশুরমশাই একই আচরণ করেছিলেন। শ্বশুরমশাই বাবামার একমাত্র সন্তান। পেশায় শিক্ষক। অত্যন্ত বদমেজাজী। কিন্তু পরোপকারী। গরিবের দুঃখে তাঁর প্রাণ কাঁদে। কেউ প্রার্থী হয়ে হাত পাতলে ফেরাতে পারেন না। এলাকায় পিরের মতো সম্মান পান। স্কুল প্রতিষ্ঠা করা, মসজিদ নির্মাণ, পাড়ার কবরস্থান প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা করা কী নেই তাঁর ভালো কাজের তালিকায়। অন্নহীনে অন্ন, বস্ত্রহীনে বস্ত্র, গেহহীনে গেহ দিতে সদা ব্যস্ত তিনি।
শাশুড়িমা,বড়ো জা ও আমি
বিয়ের আগে বারকয়েক আমাদের বাড়ি এসেছেন। উত্তর চব্বিশ পরগণা আর হাওড়া জেলার দূরত্ব অতিক্রম করা সেসময় বেশ ঝকমারি ব্যাপার ছিল। ফলে রাত্রিবাসও করেছেন। আর ছেলের জন্য খাঁটি মেয়ে নেওয়ার বাসনায় আমাকে বাজিয়ে নিয়েছেন। আমাকে বলেছেন তাঁর বাইশ বিঘা ন্যাংড়া আমের বাগান, সাতখানা পুকুর, চল্লিশ-পঞ্চাশ বিঘা ধানজমি তার ওপর ইঞ্জিনিয়ার ছেলে এসব নিয়ে আমি তো বড়োলোক হয়ে যাবো। প্রলোভিত হয়েছিলাম? কিন্তু এখনও তার বিন্দুমাত্র অংশের অধিকারী হইনি। তাঁর সাত সন্তান। এখন একে অন্যকে বঞ্চনায় মনোযোগী। অবশ্য আমি যাঁর ঘরণী তিনি দেবতা মানুষ। বিষয়কে বিষসদৃশ দেখেন। পাওয়ার আগেই দাতব্য করে বসেন।
আমি অবাক হয়েছিলাম আমার বিয়েতে দেনমোহর ধার্য করা হয় মাত্র পাঁচশ টাকা। এবং সে টাকা বিয়ের আসরেই দিয়ে শ্বশুর মশাই ঘোষণা করেন সালেহাকে আমার ছেলে পাঁচশ টাকায় কিনে নিলো। এই দেনমোহর ব্যাপারটা অনেকেই জানেন। আমি প্রায় সময়ই ক্ষিপ্র হয়ে ভাবতাম এবিষয়ে একটি কড়া প্রবন্ধ লিখবো। সেমিনারে পেপার দেবো। কিন্তু ঐ ভূমিকাটুকু লিখে থেমে গেছি। ভয় পেয়েছি স্পর্শকাতর বিষয়ে লিখে বিতর্কিত হতে চাইনি। দুহাজার তেইশের আগস্ট মাসে ইউ জি লেবেলে রিসার্চ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে দেনমোহর প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে এমন জোরালো তর্কবিতর্ক হয় যে রিসোর্স পার্শন হিসেবে আমিই সাবধান করলাম সোশ্যাল সায়েন্সের গবেষণায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ টপিক হলেও শিক্ষার্থীদের অন্য বিষয় নির্বাচন করাই ভালো।
যাক গে বাবা। কড়কড়ে পাঁচটা একশো টাকার নোট তো পাওয়া গেল। নিয়ম রক্ষা হলো। কত কী যে মেনে নিতে হয়। তবে সে টাকা দিয়ে প্রেস্টিজের একটি প্রেসার কুকার কিনে পরবর্তীতে দুজনের সাংসরিক জীবনে একত্র রান্নাবান্না শুরু হলো। ছেলেরা তখনও পর্যন্ত একটা রাঁধুনি পাওয়ার জন্যই বিয়ে করতো। ইন্ডাস্ট্রিতে ফ্যামিলি কোয়ার্টার পেতে গেলে বিয়েটা জরুরি। কোয়ার্টারে তো রান্নাবান্নার ব্যবস্থা হয়ে গেল। কিন্তু শ্বশুরবাড়িতে ছেলের বউ থাকবে না?ওখানে রান্নাবান্না কাজকর্ম কে করবে? সালাউদ্দিনের দাদিমা বললেন তুই আর একটা বিয়ে করে ঘরের কাজের জন্য বউ রেখে যা। বাবা রে এ কোথায় এসে পড়লাম? ওটা রসিকতা ছিল না সত্যিকথা?
(ক্রমশ)
0 Comments